চ্যাম্পিয়ন বানিয়েই বিদায়ের সংস্কৃতি!
কাঠমান্ডুতে সাবিনা খাতুনদের সাফ চ্যাম্পিয়ন করেই ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার নারী ফুটবলে আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার অবশ্য দায়িত্ব ছিল সাফ পর্যন্তই। এটিও ঠিক যে, চ্যাম্পিয়ন কোচকে না পাওয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশের বহু পুরোনো।
১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতেই এসএ গেমসের ফুটবলে স্বর্ণ জিতেছিল বাংলাদেশ। সেই দলের কোচ ছিলেন বিশ্বকাপ খেলা ইরাকি ফুটবলার সামির শাকির। চ্যাম্পিয়ন করে কাঠমান্ডু থেকে আর বাংলাদেশে ফেরেননি তিনি। দেশের চ্যাম্পিয়ন ফুটবলাররা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গণভবনে সংবর্ধনায় গিয়েছিলেন কোচ ছাড়াই। আবাহনীর সাবেক ফুটবলার সামির শাকির বাংলাদেশের কোচ হয়ে ভিন্ন ঘটনার জন্ম দেন। যদিও এর পেছনে ফেডারেশনের কর্তাদেরও দায় রয়েছে। বিশ্বমানের খেলোয়াড় ও কোচকে ঢাকা থেকে বিকেএসপি যেতে হয়েছে পাবলিক বাসে। আরও অনেক বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলেন সামির শাকির।
বিজ্ঞাপন
সাবিনারা দুই বার সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলেও পুরুষ ফুটবলে এই কীর্তি একবারই ঘটেছে। ২০০৩ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই দলের কোচ ছিলেন অস্ট্রিয়ার জর্জ কোটান। বাংলাদেশকে সেকেন্ড হোম মনে করা এই কোচও বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করে বেশি দিন থাকেননি। সামান্য একটা ল্যাপটপকে কেন্দ্র করে ফেডারেশন ও কোটানের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। ফলে চ্যাম্পিয়ন কোটান চলে যান দায়িত্ব ছেড়ে। যদিও পরবর্তীতে বাংলাদেশে দুই দফায় ফিরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও আবাহনীর কোচ হয়ে।
সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ পুরুষ দল আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এসএ গেমসে ফুটবলের স্বর্ণ আবার পুনরুদ্ধার করেছিল ২০১০ সালে। ততদিনে অবশ্য গেমসে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলের পরিবর্তে শুধু ২৩ বছরের বেশি বয়সে মাত্র তিনজন খেলার নিয়ম। ২০১০ সালে এসএ গেমসে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করান সার্বিয়ার জোরান জর্জেভিচ। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির শেষেই এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের বাছাই ছিল। জোরান জর্জেভিচের সেই দলের দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও বাফুফের চুক্তিতে টিল/আনটিল ফেব্রুয়ারি বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত জোরানের জায়গায় শ্রীলঙ্কায় যান সাইফুল বারী টিটু। আর চ্যাম্পিয়ন করেই জোরানের প্রস্থান হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত বাংলাদেশের ফুটবলে প্রথম ট্রফি আসে ১৯৯৫ সালে। মিয়ানমারে চার-জাতি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করান জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। ফিস্টার অবশ্য চ্যাম্পিয়ন করার পর আরও বছর দেড়েক ছিলেন। ১৯৯৭ কাঠমান্ডু সাফে বাংলাদেশ গ্রুপ থেকে বিদায়ের পর তার ইতি ঘটে। ফিস্টারের মন্তব্য, ‘বাংলাদেশে সবাই ফুটবল বোঝে, কোচ ছাড়া’ —এখনও ফুটবলাঙ্গনে শোনা যায়। বাংলাদেশ-জার্মানি সাংস্কৃতিক চুক্তির আওতায় ফিস্টারকে বাফুফের বেতন দিতে হয়নি। শুধু স্থানীয় ব্যয় বহন করতে হয়েছে। বাংলাদেশও রাখতে পারেনি ফিস্টারকে। অথচ ফিস্টার ২০০৬ সালে টোগোকে বিশ্বকাপ ফুটবলে কোচিং করিয়েছেন।
১৯৯৫-২০০৩ বাংলাদেশের তিনটি চ্যাম্পিয়ন দলেই ছিলেন হাসান আল মামুন। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক চ্যাম্পিয়ন কোচদের প্রস্থান সম্পর্কে বলেন, ‘আসলে আমরা খুব গুণী কোচদের রাখতে পারিনি। তারা আরও দীর্ঘ সময়ে থাকলে আমাদের ফুটবলের জন্য অনেক ভালো হতো।’ সাবেক জাতীয় ফুটবলার শফিকুল ইসলাম মানিক প্রায় তিন দশক ফুটবলের কোচিংয়ে। চ্যাম্পিয়ন হয়েই কোচদের প্রস্থান সম্পর্কে তার মত একটু ভিন্ন, ‘ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে আসা কোচরা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কাজ করেন। যখন দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়, তখন আর পুনরায় কাজ করার পরিবর্তে শ্রেয় মনে করেন চ্যাম্পিয়ন তকমা নিয়েই চলে যাওয়া। যদিও সামির শাকিরের বিষয়টি সবচেয়ে ভিন্ন।’
সিনিয়র ফুটবলের মতো জুনিয়র পর্যায়েও প্রায় একই চিত্র। দক্ষিণ এশিয়ায় যুব পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা আসে ২০১৫ সালে। সিলেটে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ দলকে চ্যাম্পিয়ন করান সৈয়দ গোলাম জিলানী। সেই জিলানী পরে আর কোনো দলের দায়িত্ব পাননি। ২০১৮ সালে বাধ্য হয়ে ফেডারেশন ছেড়ে ক্লাব কোচিংয়ে যান। এ নিয়ে খানিকটা বেদনাবোধ রয়েছে সাবেক এই চ্যাম্পিয়ন কোচের, ‘এএফসির অর্থায়নে বাফুফেতে আমি ও নিপু ভাই প্রথম যোগ দিয়েছিলাম ২০০৪-০৫ সালে। আজ জিলানী হয়ে ওঠার পেছনে ফেডারেশনের অবদান পুরোটাই । ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করার পর দেশের জন্য আরও বেশি কাজ করতে চেয়েছি। ২০১৬ সালে ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর আসার পর কাজের সুযোগ পাইনি। দুই বছর অপেক্ষায় থেকে পরে ক্লাবে যেতে হয়েছে।’
আরও পড়ুন
খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে সাফের শিরোপা জেতার কৃতিত্ব একমাত্র পারভেজ বাবুর। ২০০৩ সালে খেলোয়াড় হিসেবে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাবু ২০১৮ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ দলকে কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন করান। বছর দুয়েক অপেক্ষার পর ক্ষোভ নিয়ে ফেডারেশন ছাড়েন বাবু। চ্যাম্পিয়ন কোচ হিসেবে তার সম্মানী যেখানে বাড়ার কথা, সেখানে ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি আরও কমানোর প্রক্রিয়ায় ছিলেন। তাই ২০২১ সালে বাধ্য হয়েই সরে যান।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী ফুটবলের সাফল্যের শুরু ২০১৫ সাল থেকে। এএফসি অ-১৪ সেন্ট্রাল এন্ড সাউথ এশিয়ান টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নের মাধ্যমে মারিয়া-মারজিয়া ও সানজিদাদের পথ চলা শুরু। সেই শুরু থেকেই ছিলেন গোলাম রব্বানী ছোটন। সাফের বয়সভিত্তিক কয়েকটি শিরোপার পর যখন ২০২২ সালে সিনিয়র সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পূর্ণতা পেলেন। চ্যাম্পিয়নের পর সাবিনাদের অনুশীলন করালেও আর ম্যাচের ডাগআউটে দাঁড়াতে পারেননি। ছোটনের কাজ ছাড়ার পেছনেও অন্যতম কারণ সেই পল স্মলিই।
সম্প্রতি সাফ অ-২০ চ্যাম্পিয়ন করেছেন মারুফুল হক। তিনি শুধু অ-২০ দলের সাফ ও এএফসি বাছাইয়ের জন্য ছিলেন। বাফুফে ও বাংলাদেশের ফুটবল সংস্কৃতি অনুযায়ী তিনি আর দায়িত্ব পান কি না সন্দেহ রয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ দলের প্রথম সাফল্য ধরলে ১৯৮৯ সালের প্রেসিডেন্টস গোল্ডকাপ। ওই টুর্নামেন্টে সবুজ ও লাল বাংলাদেশের দু’টি দল অংশগ্রহণ করেছিল। কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে ফাইনালে টাইব্রেকারে হারিয়ে কায়সার, আসলাম, রুপু ও জনিদের লাল দল চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই দলের কোচ ছিলেন সাবেক ফুটবলার আব্দুস সাদেক। বিদেশি দলের বিপক্ষে বাংলাদেশকে প্রথম চ্যাম্পিয়ন করানো কোচ আব্দুস সাদেক পরবর্তীতে আর জাতীয় দলের দায়িত্ব পাননি।
এজেড/এএইচএস