রেফারির শেষ বাঁশি। প্যারিসের পার্ক দ্য প্রিন্সেস স্টেডিয়াম যেন ‘ইউএসএ’ শব্দে ভেঙে পড়ল। গ্যালারির অর্জন ও মাঠে খেলোয়াড়-কোচিং স্টাফের উল্লাসের দৌড়ের তীব্রতা চলছিল সমানভাবেই। অন্যদিকে, সুবিশাল স্টেডিয়ামের এক অংশে পীনপতন নিরবতা। ব্রাজিলের নারী ফুটবলের কিংবদন্তী মার্তার ক্যারিয়ার শেষ হচ্ছে অলিম্পিকে স্বর্ণ ছাড়াই!

প্যারিস অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের তীব্র লড়াই চলছে চীন-আমেরিকার মধ্যে। নারী ফুটবলে এই স্বর্ণ আমেরিকার জন্য তাই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকান ফুটবলাররা মাঠে কিছুক্ষণ উল্লাস করে ড্রেসিং রুমে ফিরে যান। তখনও ব্রাজিল দল কিক অফ সেন্টারে গোল করে দাড়িয়ে। অনেকক্ষণ আলোচনার পর যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছিল ব্রাজিল দল। তখন প্রায় পুরো স্টেডিয়াম আবার করতালিতে জেগে উঠল। বিশ্ব নারী ফুটবলের কিংবদন্তী মার্তার শেষ অলিম্পিক। তাই ফুটবলপ্রেমীদের কেউ হাততালি আবার কেউ দাড়িয়ে সম্মান দেখালেন। ব্রাজিল স্বর্ণের লড়াইয়ে হেরে গিয়েও যেন মার্তা দর্শকদের হৃদয় জিতেছেন! 

ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলেও নারী ফুটবল ততটা আলোচিত নয়। নারী ফুটবলে গত দেড় যুগের মহাতারকা ব্রাজিলিয়ান মার্তা। পাচ বারের বেশি ফিফার সেরা নারী বর্ষসেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। নারী বিশ্বকাপ ফুটবলে টানা পাচ আসরে গোল রয়েছে। যা পুরুষ ফুটবলের বিশ্বকাপেও নেই। ব্রাজিলকে অলিম্পিকের দুই বার ফাইনালে তুললেও স্বর্ণ জেতাতে পারেননি। আজ ছিল তৃতীয় ও শেষ চেষ্টা। সেই চেষ্টাতেও ব্যর্থ হওয়ায় কিংবদন্তীর মার্তার অলিম্পিক ক্যারিয়ার শেষ হলো অপূর্ণতায়।

ফ্রান্স যেন ব্রাজিলের ফুটবলের জন্য যেন ‘অপয়া’। ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে কেঁদেছিলেন রোনালদো-রিভালদোরা। দুই যুগ পর অলিম্পিক ফুটবলের ফাইনালে সেই ফ্রান্সেই কাঁদলেন ব্রাজিলের নারী দলের ফুটবলাররা। ১৯৯৮ সালের ম্যাচটি হয়েছিল স্তাদে দ্য ফ্রান্সে। ফ্রান্সের ফুটবলের মূল ভেন্যু স্তাদে দ্য ফ্রান্স হলেও অলিম্পিকের ফুটবল মূলত হয়েছে প্যারিসের বাইরের শহরে। নারী-পুরুষ দুই ইভেন্টের ফাইনালই প্যারিসের প্র্যাক দ্য প্রিন্সেস স্টেডিয়ামে হয়েছে। 

পিএসজি (প্যারিস সেন্ট জার্মেই) হোম ভেন্যুর স্টেডিয়াম কিছু সময়ের জন্য ব্রাজিল আবার কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছে আমেরিকার হোম স্টেডিয়াম। সুবিশাল স্টেডিয়ামে অনেক গ্যালারিতেই দেখা গেছে ব্রাজিলের হলুদ জার্সি। সেই তুলনায় একটু কমই ছিল আমেরিকার লাল জার্সি বা পতাকা। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যালরি সানসোস ব্রাজিলের জালে বল পাঠাতেই ‘ ইউএসএ’ স্লোগানে ফেটে উঠল পুরো স্টেডিয়াম। 

গোল হজমের আগ পর্যন্ত ব্রাজিল ভালোই লড়ছিল। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময়ে অফ সাইড ট্র্যাপ করতে গিয়ে ব্রাজিল উল্টো বিপদে পড়ে। দ্রতগতির কাউন্টার অ্যাটাকে আমেরিকা ব্রাজিলের রক্ষণভাগ ভেঙে বক্সের ভেতরে প্রবেশ করে। ম্যালরি ব্রাজিলের আগুয়ান গোলরক্ষককে বোকা বানাতে ভুল করেননি।

ফ্রান্স শীত প্রধান দেশ হলেও গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ত্রিশের উপরই থাকে। আজ দুপুর থেকেই একটু বেশি গরম। দ্বিতীয়ার্ধে তিনবার কুলিং ব্রেক দিয়েছেন রেফারি। খেলায় খানিকটা ছেদ পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। ব্রাজিল গোল হজমের পর আর ছন্দে ফিরতে পারেনি। ইনজুরি সময়ের শেষ দশ মিনিট একটি গোলের মতো আক্রমণ করলেও ফিনিশিং দক্ষতায় আর পূর্ণতা পায়নি।

অলিম্পিক ফুটবলে ব্রাজিলের পুরুষ দল কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ২০০২ সালের পর ব্রাজিল বিশ^কাপ ফুটবলের শিরোপা নেই। এমনকি ফাইনালও খেলতে পারছে না। তাই অলিম্পিকে মার্তার নারী দলের উপরই ছিল ভরসা। মার্তার ফুটবল শৈলীতে পুরো বিশ্ব বুদ থাকলেও তার আজ সমাপ্তি হয়েছে বিষাদেই।

পুরুষ ফুটবলে আমেরিকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। নারী ফুটবলে আবার একচ্ছত্র প্রাধান্য। ১৯৯১ সাল থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল ও ১৯৯৬ সাল থেকে অলিম্পিকে নারী ফুটবল অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই আমেরিকা সর্বাধিক বারের চ্যাম্পিয়ন। অলিম্পিকে পুরুষ ফুটবলে ২৩ বছরের বেশি তিন জন ফুটবলার অর্ন্তভূক্ত করা গেলেও নারী ফুটবলে অবশ্য সিনিয়ররাই অংশগ্রহণ করেন। তাই অলিম্পিকে পুরুষ ফুটবলের চেয়ে নারী ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানদণ্ডে এগিয়ে।

এজেড/এমএসএ