‘ভাগ্যিস এমিলিয়ানো আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেন’
হিউস্টনের এনআরজি স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়া আর্জেন্টাইন ভক্তদের অপেক্ষা ছিল বাড়ি ফেরার। ৯০ মিনিটের খেলা শেষ। ১-০ গোলে এগিয়ে আর্জেন্টিনা। লিসান্দ্রো মার্টিনেজের ৩৫ মিনিটের গোলটাই ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণী হতে পারত। সবাই যখন ম্যাচ শেষের অপেক্ষায় তখনই স্কোরশিটে পরিবর্তন। কেভিন রড্রিগেজের ৯১ মিনিটের গোলে ইকুয়েডর ফেরে ম্যাচে।
কোপা আমেরিকার নিয়ম মেনে ম্যাচ চলে গেল সরাসরি পেনাল্টি শ্যুটআউটে। এরপরের গল্পটা সবার চেনা হয়ে গেছে এতিদিনে। ডি-বক্সের ওই ঘরটায় স্ট্রাইকাররা যেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সামনে থাকা এক শিকার। আর এমিলিয়ানো সেই দানব। এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে ছোট্ট ওই ডিবক্সের একক রাজা বললেও কম হয়ে যায়। সার্জিও গায়কোচিয়ার ৯০ এর বিশ্বকাপের গল্প শুনে বড় হওয়া প্রজন্ম দেখে, পেনাল্টিতে কীভাবে একজন রাজা হতে পারেন।
বিজ্ঞাপন
ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচে লিওনেল মেসি প্রথমেই এসে প্যানেনকা শট মিস করেন। ক্রসবারে লেগে বল চলে যায় বাইরে। তবু এমিলিয়ানো নির্ভার। মেসিকে ইশারা করে জানান দেন তিনি আছেন। এরপরের দৃশ্যটা খুব চেনা। এমি পেনাল্টি ঠেকান। হয়ে যান বীর। শুন্যে লাফিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছোঁড়া কিংবা গোলবারের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনব নাচ। এসব দৃশ্য খুব চেনা এখন।
ইকুয়েডরের আনহেল মেনা আর অ্যালান মিন্দার শট অনায়াসে ঠেকিয়ে দেন এমি। এরপর উদযাপনটাও হয় বুনো। আর্জেন্টিনা গোল করল পরের চার শটেই। ইকুয়েডরকে সেখানেই হারাল আলবিসেলেস্তেরা। ৪-২ ব্যবধানে টাইব্রেকারে জিতে আর্জেন্টিনা চলে যায় সেমিফাইনালে। যেখানে নায়ক হন একজনই। গোলবারের নিচে থাকা এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
ম্যাচের শেষে দলের গোলরক্ষক এমি মার্টিনেজের ওপর আস্থার কথা অকপটে স্বীকার করে নেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি, ‘পেনাল্টি শ্যুটআউটে দলের সবাই অন্ধভাবে গোলরক্ষকের ওপর বিশ্বাস করেছিল আর এটাই স্বাভাবিক। যদিও লিও (মেসি) মিস করেছিল, তারপরেও পুরো দল জানতো, ভাল কিছু হতে যাচ্ছে।’
আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে এখন পর্যন্ত চারবার টাইব্রেকার শুটআউটে দাঁড়িয়েছেন মার্টিনেজ। জিতেছেন এর সবকটিতেই। মোট ১৮টি শট হয়েছে তার বিরুদ্ধে, ৯টিতেই প্রতিপক্ষ গোল করতে পারেনি। একটি ছিল পোস্টের বাইরে, বাকি আটটি মার্টিনেজ ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এরপরেই নিজের গোলরক্ষককে নিয়ে ভিন্ন এক মন্তব্য করলেন স্কালোনি। বোঝালেন কেন এমিই সবার চেয়ে আলাদা, ‘আমি গোলকিপিং কোচ নই। কিন্তু যখন তারা গোল সেইভ করে তারা বিপক্ষ দলের ওপর আধিপত্য দেখায়, খেলা থেকে ছিটকে দেয়। আর সে (এমি মার্টিনেজ) গোল বাঁচায়। এমনভাবে গোল ঠেকায়, যেন সে মাঠকেই আওয়াজ করতে বাধ্য করে। এটা ভাল দিক, সে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলে।
এমি মার্টিনেজের চরিত্রটাই এমন। যার সামনে অরেলিন চুয়ামেনি আর কিংসলে কোম্যানের মতো বিগ ম্যাচের খেলোয়াড়রাও স্নায়ুচাপে ভুগতে বাধ্য হন। ফিফা বাধ্য হয় পেনাল্টির আগে গোলরক্ষকের আচরণের নিয়ম বদল করতে। স্ট্রাইকারদের সামনে নার্ভাস করার উপায় বন্ধ করে দেয়া হয়।
আরও পড়ুন
কিন্তু তাতে কি এমিলিয়ানোকে ঠেকিয়ে রাখা যায়? পেনাল্টি ঠেকিয়ে শুন্যে লাফিয়ে কিংবা কোমর দোলানো নাচে প্রতিপক্ষকে তিনি করেন আরও বেশি বিভ্রান্ত।
পরিসংখ্যানের পাতা থেকেই কিছু তথ্য দেখে নেয়া যাক। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে এখন পর্যন্ত চারবার টাইব্রেকার শুটআউটে দাঁড়িয়েছেন মার্টিনেজ। জিতেছেন এর সবকটিতেই। মোট ১৮টি শট হয়েছে তার বিরুদ্ধে, ৯টিতেই প্রতিপক্ষ গোল করতে পারেনি। একটি ছিল পোস্টের বাইরে, বাকি আটটি মার্টিনেজ ফিরিয়ে দিয়েছেন।
সবচেয়ে বড় কথা এমিলিয়ানোর নিবেদন। যিনি কথা রাখতে জানেন। নিজের ক্লাব অ্যাস্টন ভিলাকে কথা দিয়ে তুলে নেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। মেসির জন্য যুদ্ধে যাওয়ার অঙ্গীকার করে ছিনিয়ে আনেন কোপা আমেরিকা কিংবা বিশ্বকাপের মত প্রেস্টিজিয়াস ট্রফি। ব্রাজিলে যেদিন পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ওপর, সেদিন এমি মার্টিনেজ এগিয়ে যান পুলিশের লাঠি থামাতে। সেদিন বুঝিয়েছিলেন গোল না, দরকার পড়লে সমর্থকদেরও তিনি বাঁচাতে জানেন।
ম্যাচ জয়ের পর আবেগী কণ্ঠে শোনালেন সমর্থকদের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা, ‘ চেষ্টা করি সব সময়ই ভালো অবস্থানে থাকতে। আমার দেশের এটা প্রাপ্য। মানুষ টাকা খরচ করে আমাদের খেলা দেখতে চায়। আমি তো মানুষের কণ্ঠের আবেগ মিস করি, তাদের উল্লাস মিস করি। এসব নিয়ে আমি গর্বিত। একজন গোলকিপার হিসেবে ও ব্যক্তি হিসেবে আমি আরও উন্নতি করতে চাই।’
এমিলিয়ানো ক্ষ্যাপাটে, এমিলিয়ানো বুনো। বিশ্বকাপ কিংবা কোপা আমেরিকার ম্যাচ শেষে ভেঙে পড়েন কান্নায়। আবেগটাও তার মাঝে পুরোদমে বিরাজ করে। সব দেখেশুনে হয়ত আর্জেন্টিনার ভক্তরাও বলে বসেন, ভাগ্যিস এমিলিয়ানো আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেন।
জেএ