উদাসীন বাফুফে, হারানোর পথে কৃষ্ণাও!
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অন্যতম স্তম্ভ কৃষ্ণা রাণী সরকার। অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের পর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা-সামর্থ্যে কৃষ্ণাই বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড়। সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম কারিগর গত বছর এশিয়ান গেমসে খেলতে পারেননি। দেশের মাটিতে সিঙ্গাপুরের পর এবার চাইনিজ তাইপের বিপক্ষেও দলে নেই। কৃষ্ণার মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় দীর্ঘদিন ইনজুরিতে অথচ বাফুফের তেমন কোনো উদ্যোগই নেই।
কৃষ্ণার পায়ের আঙুল শুকিয়ে আসে। তাই ব্যথা অনুভব করায় স্বাভাবিক অনুশীলন ও দৌড়াতে পারেন না। এই সমস্যা নিয়েই এক বছরের বেশি সময় কাটাচ্ছেন। ঝুঁকি নিয়েই এবার লিগে নাসরিন স্পোর্টস একাডেমীর কিছু ম্যাচে খেলেছেন এবং গোলও করেছেন। ঘরোয়া লিগে খেললেও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পরিস্থিতিতে নেই তিনি। নারী দলের বৃটিশ কোচ পিটার বাটলারের সাফ কথা, 'সে পূর্ণাঙ্গ ফিট নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনফিট খেলোয়াড় আমি নিতে পারি না।' দেশের মাটিতে খেলা আবারো সুযোগ না পাওয়ায় সামাজিক মাধ্যমে কৃষ্ণা নানা হতাশামূলক স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
কৃষ্ণা তার সমস্যার শুরুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরির পরামর্শ নিয়েছিলেন। কৃষ্ণা এখনো বিদেশে চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ায় আজ সুদূর নিউইয়র্ক থেকে বেশ বিস্ময় প্রকাশ করলেন ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্ট ডাক্তার দেবাশীষ, 'কৃষ্ণার ইনজুরিটি সাধারণ নয়। এটা খুবই আলাদা ও সেনসেটিভ। নার্ভের সাথে পায়ের সম্পর্ক রয়েছে। তাকে পোডিয়াট্রিস্ট (পায়ের চিকিৎসক) দেখানো খুবই আবশ্যক। আমাদের এখানে সেই রকম বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থা নেই। তাই আমি আরো মাস দশেক আগেই তাকে উন্নত দেশে যেতে বলেছিলাম যেখানে ফুটবলারদের এ জাতীয় ইনজুরির কাজ হয়। ইংল্যান্ড, জার্মানি ব্যয়বহুল তাই অন্তত ভারতে তো অবশ্যই যাওয়া উচিত ছিল এতদিনে।’
কৃষ্ণা চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চেয়েছিলেন। ফেডারেশন তার চিকিৎসার ব্যয়ভার এড়াতে উদাসীনতাই প্রদর্শন করেছে বার বার এমনটাই ভাবনা কৃষ্ণার। এই বিষয়ে অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করলেন মহিলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ, 'ও একবার নিজেই ভারত যেতে চেয়েছিল। আমরা ভিসার ব্যাপারে সহায়তা করেছিলাম। ওকে ফিজিও প্রতিনিয়ত দেখছে এবং দেশীয় চিকিৎসকরা তত্ত্ববধায়ন করছে।’
ফিজিও এবং দেশীয় চিকিৎসকদের অধীনে রেখে কৃষ্ণার কার্যত কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তার বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়টি নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান অনুধাবন করলেও আর্থিক কারণে মূলত আড়ালের চেষ্টা। ফেডারেশনের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও ফেডারেশনের কর্মকর্তারা অনেকেই বিত্তবান ও স্বচ্ছল। মাত্র কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে এই গুণী খেলোয়াড়ের চিকিৎসা করাতে না পারলে তাদের পদে থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
কৃষ্ণার মতো খেলোয়াড় দীর্ঘদিন খেলার বাইরে। এ নিয়ে তেমন আলোচনাও নেই মহিলা ফুটবল কমিটি বা ফেডারেশনের নীতি-নির্ধারকদের। মহিলা ফুটবল কমিটির এক সদস্য নিজেদের দায় স্বীকার করে কোচ-ম্যানেজারকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে বলেন, 'কৃষ্ণার মতো খেলোয়াড়কে আমরা মাঠে নামাতে পারিনি এটা অবশ্যই আমাদের উদাসীনতা এবং গাফিলতি অস্বীকার করার উপায় নেই। কোচ, ম্যানেজারেরও দায় রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমাদের বারংবার উপস্থাপন করা উচিত ছিল।’ এই প্রতিবেদক কর্তাদের বিষয়টি অবহিত করার পর শীঘ্রই কার্যকরী উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন৷
নারী ফুটবলারদের সুখ-দুঃখ সব দেখতেন গোলাম রব্বানী ছোটন। তিনি চলে যাওয়ার পর নারী দল সেভাবে আর অভিভাবক পায়নি। সাইফুল বারী টিটুর কোচিংয়ে বাংলাদেশ এশিয়ান গেমস ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে খেললেও তার সঙ্গে ফুটবলারদের আত্নীকরণ হয়নি সেভাবে। এখন দায়িত্বে থাকা পিটার বাটলার তো অনেক কিছুই অজ্ঞাত। সহকারী কোচ লিটু ও অনন্যা বিষয়টি জানলেও তারা মূলত হেড কোচের নির্দেশেই চলেন।
জাতীয় দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন কৃষ্ণার সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে ধূম্রজালের মধ্যে রয়েছেন। তার বক্তব্য, 'কৃষ্ণাকে কয়েকটি ম্যাচ খেলতে দেখলাম নাসরিনে। সে হিসেবে তাইপে দলে কোচ তাকে রাখতে পারত। তার ইনজুরি ঝুঁকিপুর্ণ এরপরও ক্লাব কেন খেলাল আর সে ক্যাম্পেই থাকত (নাসরিনের ক্যাম্প বাফুফেতেই হয়েছে) এরপরও তারা (বাফুফে) কিভাবে তাকে খেলতে দিল।'
২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাংলাদেশের নারী ফুটবল যে গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেভাবে হাটেনি। বেতন বিদ্রোহ, খেলা বারবার পিছিয়ে যাওয়া এ নিয়ে অনেক অসন্তোষ ছিল ফুটবলারদের। তাই অনেকে জাতীয় দলের ক্যাম্প ছেড়েও দিয়েছে। কৃষ্ণা উল্টো শঙ্কায় রয়েছেন ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ার। একের পর এক সিরিজ ইনজুরির জন্য মিস করছেন। এভাবে চললে এক সময় ক্যাম্প থেকেই বাদ পড়ে যেতে পারেন।
কৃষ্ণার শঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। জাতীয় দলে এক সময় নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার ছিলেন মিসরাত জাহান মৌসুমী। জুনিয়র দলে তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। সেই মৌসুমে ইনজুরিতে পড়ে ফুটবল থেকেই হারিয়ে গেছেন। এখন পড়াশোনাতেই ব্যস্ত। নিজের মতো আর কেউ যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে অনুরোধ মৌসুমীর, 'জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকাবস্থায় ঘরোয়া লিগে খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ি। ক্যাম্পে ফিরলেও ইনজুরির জন্য পারফরম্যান্স করতে পারিনি। চিকিৎসা সেভাবে হয়নি ফলে পারফরম্যান্সের ঘাটতিতে বাদ পড়লে আর ফিরতে পারিনি। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের অবশ্যই সুচিকিৎসার বিষয়টি ফেডারেশনের নিশ্চিত করা প্রয়োজন। না হলে অনেক প্রতিভা হারিয়ে যাবে।'
এজেড/এইচজেএস