গত বছরের ১৪ এপ্রিল বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ফিফা। এরপর সাবেক ফুটবলাররা বাফুফের শীর্ষ কর্মকর্তা সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। এক বছর পর ফিফা আবার সোহাগের নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোসহ বাফুফের কয়েকজন স্টাফ এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে জরিমানা করেছে। তাই আবারও সাবেক ফুটবলাররা বাফুফে থেকে সালাউদ্দিন-সালাম মুর্শেদীর অপসারণ চেয়েছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি তোলেন সাবেক তারকা খেলোয়াড়রা। 

‘ঘোর অমানিশায় দেশের ফুটবল–দুর্নীতিবাজ ও ব্যর্থ বাফুফে কর্মকর্তাদের অপসারণ চাই’ নামক ব্যানারে সাবেক ফুটবলাররা একত্রিত হয়েছিলেন। আব্দুল গাফফারের সঞ্চালনায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, শামসুল আলম মঞ্জু, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, আবু ইউসুফ, মো. সুলতান, কাজী আনোয়ার, সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির, আরমান মিয়া ও বিপ্লব ভট্টাচার্য্য। উপস্থিত প্রায় সবাই ফেডারেশনের নানা অসঙ্গতি ও সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ফিফা রিপোর্টে ফেডারেশন কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছেন।

সাবেক জাতীয় ফুটবলার আব্দুল গাফফারই মূলত এই সম্মেলনের আয়োজক। এমন আয়োজনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন অনেকে ব্যবসায়ী, কেউ রাজনীতিবিদ আবার কেউ প্রবাসী। সবার পরিচয়ই ফুটবলার হিসেবে। ফুটবল ফেডারেশনের দুই শীর্ষ ব্যক্তি সাবেক ফুটবলার, অথচ আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা ফিফার জরিমানায় পড়ছে এবং স্টাফরা নিষিদ্ধ হচ্ছে। যা অত্যন্ত লজ্জার ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। আমরা এর প্রতিবাদ স্বরূপ এখানে একত্রিত হয়েছি। তারা নৈতিকভাবে পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। ফুটবলের স্বার্থে তাদের সরে যাওয়া উচিৎ, এটাই আমাদের দাবি।’

ফিফার অর্থে কেনাকাটায় অনিয়ম নিয়ে সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। একই ঘটনায় সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীর শুধু জরিমানা হওয়ায় খানিকটা বিস্মিত সাবেক তারকা ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, ‘প্রায় একই ঘটনায় দুই জনের একই শাস্তি হওয়ার কথা। সেখানে একজনকে শুধু জরিমানা করেছে।’ সালাম মুর্শেদীর ফিফার রিপোর্টে ফেডারেশন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের নামও এসেছে। তাই সালাউদ্দিনের এক সময়ের সতীর্থ আশরাফ উদ্দিন চুন্নুর কাঠগড়ায় সভাপতিও, ‘ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে তাকেও এর দায় নিতে হবে। দায় হিসেবে পদত্যাগ করা উচিৎ।’

সালাউদ্দিন-সালামের সতীর্থ ফুটবলার ছাড়াও আজকের সংবাদ সম্মেলনে পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সাবেক জাতীয় তারকা ফুটবলার আরমান মিয়া বলেন, ‘আমরা গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাফুফের অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলছি। আমাদের কথা কেউ কর্ণপাত করেনি। এখন স্বয়ং ফিফাই বলছে বাফুফের অনিয়মের বিষয়গুলো। এটা আমাদের ফুটবল সমাজ ও দেশের জন্য খুবই লজ্জার।’ সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির এর সঙ্গে যোগ করে বলেন, ‘আমরা যখন খেলতাম তখন বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিং অনেক ভালো ছিল। সালাউদ্দিন ভাইয়ের নেতৃত্বে ১৬ বছর দেশের ফুটবলে অবস্থা ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এখন ১৮৪ নম্বরে, এক সময় দু’শোর কাছাকাছি ছিল। ফলে ফুটবল দিনকে দিন নিচে নামছে, তারা উন্নয়ন করতে ব্যর্থ। তাদের হাতে ফুটবল আর নিরাপদ নয়।’ 

সাবেক ফুটবলাররা অনেকদিন থেকেই কাজী সালাউদ্দিন-সালাম মুর্শেদীর সমালোচনা করে আসছেন। দাবিও করেছেন অপসারণের। সাবেক মন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের কাছেও স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। এরপরও কোনো প্রতিকার হয়নি। নতুন মন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপনের ওপর আশা করছেন সাবেক তারকা ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, ‘সাদেক হোসেন খোকার পর আমরা আরেকজন মন্ত্রী পেলাম যিনি ক্রীড়াঙ্গনের লোক। তিনি আবাহনীর সঙ্গে যুক্ত ও ক্রিকেট বোর্ডে আছেন অনেক দিন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও বেশ কাছের। তিনি জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের গুরুত্ব ও ফুটবল ফেডারেশনের সমস্যার বিষয়টি অনুধাবন করবেন নিশ্চয়ই।’ টুটুলের সঙ্গে গাফফার যোগ করে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। সম্প্রতি পুলিশের সাবেক আইজিপির ব্যাপারে তদন্ত চলছে। ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারাও নিশ্চয়ই পার পাবে না। কারণ শুধু ফিফার ফাণ্ড, সরকারি অনেক অর্থও তারা সঠিকভাবে ব্যবহার করেনি। রাসেল সাহেবের আমলে ১০ কোটি টাকার সঠিক হিসাব দিতে পারেনি।’

সালাউদ্দিন-সালাম মুর্শেদী ২০০৮ সাল থেকে ফুটবল ফেডারেশনের দুই শীর্ষ পদে রয়েছেন। প্রতি নির্বাচনের আগেই তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হয়। এরপরও কাউন্সিলররা ভোট দিয়ে তাদের প্যানেলকেই নির্বাচিত করেন। নির্বাচনের কাউন্সিলর প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতি নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কাপ্রাপ্ত ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বলেন, ‘জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন থেকে সাবেক জাতীয় ফুটবলারদেরই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। সেই হিসেবে আমি ঢাকা বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশন থেকে কাউন্সিলর হয়েছিলাম ২০১২ ও ২০১৬ সালে। ২০২০ সালে আমাকে বলা হয় জাতীয় ফুটবলারের প্রমাণ দিতে। জনির (সাবেক জাতীয় অধিনায়ক) ক্ষেত্রেও একই হয়েছিল। বাফুফের নির্বাহী সদস্য কাউন্সিলর হতে পারবে না, এরপরও রহিম ভাইকে ঢাকা বিভাগের ফুটবল এসোসিয়েশন কাউন্সিলরের বৈধতা দিয়েছিল ফেডারেশন।’

ফুটবলসহ অনেক ফেডারেশনের নির্বাচনের ফলাফলের নিয়ন্ত্রক জেলা-বিভাগীয় সংগঠক পরিষদ ফোরাম। এরা যাদের পক্ষে থাকে তারাই নির্বাচনে জয়লাভ করে। অনেক জেলায় ফুটবল হয় না এবং জাতীয় পর্যায়েও অনেক জেলা অংশগ্রহণ করে না। এরপরও ভোটের সময় ঠিকই থাকে, এ নিয়ে আপত্তি রয়েছে টুটুলের, ‘আসলে গঠনন্ত্র অনুযায়ী কোনো জেলা যদি দুই বছর জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ না করে তাহলে তারা ভোটাধিকার পাবে না। গঠনতন্ত্রে থাকলেও প্রয়োগ নেই।’ গঠনতন্ত্রের আরেকটি বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ফুটবল ফেডারেশনের অনেকেই রয়েছে আমাদের বন্ধু ও ছোট ভাই। তারা প্রায়ই বলেন, ‘সভাপতির রুলিং।’ এটা গঠনতন্ত্রের কোথাও নেই। যা সিদ্ধান্ত হবে নির্বাহী কমিটির সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।’

ফুটবল ফেডারেশন ২১ জনের নির্বাহী কমিটি হলেও সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের হাতেই মূল ক্ষমতা। তার ঘনিষ্ঠ দুই-তিন জন ফেডারেশনের নীতি-নির্ধারক হিসেবে কাজ করেন। বাকিরা থাকেন একেবারে অজ্ঞাত। এদের নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন গাফফার, ‘ফেডারেশন সালাউদ্দিন ও তার দুই একজন লোকই চালায়। কমিটির অনেকে অনেক কিছু জানে না। আমাদের ফুটবলার ইলিয়াস, রুপু অনেকেই আছেন তারা কিছু বলতে পারেন না, তাও থাকেন। মুন একমাত্র প্রতিবাদ করে সরে এসেছে।’ সালাউদ্দিনের আস্থাভাজন সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিককে ইঙ্গিত করে গাফফার বলেন, ‘ফুটবল ফেডারেশনে অনেক সাবেক ফুটবলার রয়েছে। ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান এমন একজনকে করেছে যিনি একজন ঠিকাদার। ফুটবল সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। প্রতি নির্বাচনে সালাউদ্দিন সাহেব একজন করে লোক নির্বাচন করেন। প্রথমে ছিলেন রব্বানী হেলাল, এরপর মঞ্জুর কাদের, তারপর তরফদার রুহুল আমিন, এখন তিনি (আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক)।’

সাবেক ফুটবলাররা অনেক দিন থেকেই ফুটবল ফেডারেশনের অনিয়ম নিয়ে সমালোচনা করে আসছেন। এরপরও নিজের মতো করেই ফেডারেশন চালাচ্ছেন সালাউদ্দিন। অনেক সাবেক তারকা এর প্রতিবাদমূলক সংবাদ সম্মেলনে আসার আগ্রহ হারিয়েছেন। তাই আজ বেশ কয়েকজন সাবেক তারকাকে দেখা যায়নি। 

এজেড/এএইচএস