২০১১ সালে বিশাল এক বিপ্লবই দেখেছিল ফুটবল বিশ্ব। এর কিছুদিন আগেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ মনসুর ম্যানচেস্টার সিটি কিনে নিয়েছিলেন। তবে কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি যা করেছেন তা হয়ত চিরদিনের জন্যই বদলে দিয়েছে ফুটবলের চালচিত্র। পিএসজি ক্লাবটিকে মূলত কিনেছিল কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট (কিউএসআই)। 

১৫-২০ মিলিয়নের ঋণ তারা শোধ করেছিল। সেই বছরের ১৯ মিলিয়ন ইউরোর লোকসানটাও পুষিয়ে দিয়েছিল তারা। রাতারাতি ফুটবল বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্লাব হয়ে ওঠে পিএসজি। এরপরেই শুরু হয়েছিল পিএসজির নতুন যুগ। নাসের আল খেলাইফিকে প্রধান করে ফ্রান্সের ক্লাবটি শুরু করে সুদূরপ্রসারী এক চিন্তাভাবনা। 

কিন্তু লম্বা সেই পথে সাফল্য আসেনি তাদের। যে ক্লাবে একটা সময় ইব্রাহিমোভিচ, বেকহ্যাম, ডি মারিয়া, নেইমার কিংবা মেসিরা খেলেছেন, সেই দল জেতেনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। মাঝে এসব অভিজ্ঞ নামের ভিড়ে কিলিয়ান এমবাপে নামের এক আনকোরা হীরের টুকরা পেয়েছিল তারা। এমবাপেকে কেন্দ্র করে অভিজ্ঞদের সাজিয়ে ইউরোপসেরা হতে চেয়েছিল তারা। 

কিন্তু তা আর হয়নি। ডি মারিয়া, নেইমার, মেসিরা ক্লাব ছেড়েছেন। শেষ পর্যন্ত নতুন এক দল তুলে দেয়া হয়েছিল এমবাপের হাতে। ভিতিনহা, নুনো মেন্ডেস, ফ্যাবিয়ান রুইজ, বারকোলা, ওসমান ডেম্বেলে কিংবা র‍্যানডাল কোলো মুয়ানিদের পিএসজি এনেছিল। তবে এইবারেও ব্যর্থ পিএসজি। আর এই হারটা যেন ১৩ বছর ধরে চলা এক অধ্যায়েরই ইতি টেনে দিল। 

গতকাল রাতে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিরুদ্ধে পিএসজি যে স্কোয়াড নিয়ে নেমেছিল তার মূল্য ছিল ৪৬৩ মিলিয়নের বেশি। যেখানে ডর্টমুন্ড খেলেছিল ১০০ মিলিয়নের স্কোয়াড নিয়ে। সেই ম্যাচেও ব্যর্থ তারা। আর এই ম্যাচ দিয়েই পিএসজিতে কিলিয়ান এমবাপের অধ্যায়টাও ফুরোলো। চলতি মৌসুমের পরেই প্যারিসকে বিদায় জানাবেন তিনি। ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া পিএসজির ‘নতুন যুগ’টাও তাই এখানেই শেষ হচ্ছে। 

কাতারি মালিকানা আসার পর আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার হ্যাভিয়ের পাস্তোরেকে দিয়ে শুরু। সেই মৌসুমে পিএসজিতে আসেন ১৬ জন খেলোয়াড়। একে একে তারা দলে টানে থিয়াগো মোত্তা, জেরেমি মেনেজ, ব্লেইস মাতুইদি, ম্যাক্সওয়েল, কেভিন গামেইরোর মতো নামী মুখেদের। 

২০১২-১৩ মৌসুমে পাকাপাকিভাবে অলস্টার টিম তৈরি করে ফেলে পিএসজি। যে দলে এসেছিলেন জলাতান ইব্রাহিমোভিচ, ডেভিড বেকহ্যাম, থিয়াগো সিলভা, ইজাকুয়েল ল্যাভেজ্জিদের মতো সুপারস্টার। সঙ্গে মার্কো ভেরাত্তি, লুকাস মৌরার মতো অনেকেই। পিএসজি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জন্য যাত্রা শুরু করে ওই বছর থেকেই। 

ইউরোপিয়ান স্বপ্নযাত্রার মিশনে পিএসজিকে অবশ্য ছিটকে ফেলার মতো দলের অভাব ছিল না। পরের মৌসুমে তাই দলে টানে মার্কিনিওস আর এডিনসন কাভানি। এই দলটাই অবশ্য পরে দেখেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেরা কামব্যাক। ঘরের মাঠে বার্সেলোনাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে, পরবর্তীতে হেরেছিল ৬-১ গোলে। ‘লা রেমোনটাডা’ নামের সেই কামব্যাক আজও হয়ত পিএসজি ভক্তদের তাড়িয়ে বেড়ায়। 

এরপরেই ট্রান্সফার জগতের বিশ্বরেকর্ড গড়ে নেইমার জুনিয়রকে দলে টানে তারা। এডিনসন কাভানি এবং নেইমারের পাশে যুক্ত হন তরুণ সেনসেশন কিলিয়ান এমবাপে। শেষ পর্যন্ত সেটাও সফল হয়নি তাদের জন্য। মেসি এবং নেইমার দুজনেই ক্লাবকে ইউরোপিয়ান শিরোপা দিতে পারেননি। ক্লাবের সমর্থকদের দুয়োধ্বনিতে অনেকটা তিক্ততা নিয়েই সরে গিয়েছেন দুই মহাতারকা। 

শেষ সম্বল ছিলেন এমবাপে। চলতি গ্রীষ্মে তিনিও ছাড়বেন ক্লাব। পিএসজিকে এবার হয়ত খুঁজতে হবে নতুন কোনো মহানায়ক। আরও একবার শুন্য থেকে শুরু করতে হবে নাসের আল খেলাইফির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার প্রজেক্ট। গত তের বছরে দুই বিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে পিএসজি। নতুন শুরুর বেলায় এবার পিএসজি কতদিন সময় নেয়, তাইই এখন দেখার বিষয়। 

যদিও এমন এক শেষের পর নতুন করে আবার শুরুর ইঙ্গিতটাও কাল দিয়ে রেখেছেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট নাসের আল খেলাইফি। ম্যাচ শেষে বলেছেন ‘খেলোয়াড় ও কোচ তাদের সবকিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ডর্টমুন্ডকে অভিনন্দন। এর থেকে ভাল আমাদের খেলা উচিৎ ছিল। এটা কঠিন একটি ম্যাচ ছিল। আমি দলের পারফরম্যান্স দারুণ গর্বিত। ইউরোপে আমরাই সবচেয়ে তরুণ দল। পাঁচ বছরে তিনবার আমরা সেমিফাইনালে খেলেছি। এটা আমাদের লক্ষ্য নয়, এখনো আমরা ফাইনাল খেলতে চাই। এটাই ফুটবল, সবাইকে এটা মেনে নিতে হবে। অনেক সময় হয়তো সবকিছু সঠিকভাবে হবে না, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করাটাই সামনে এগিয়ে যাবার ক্ষেতে সবকিছু সহজ করে দেবে।’

জেএ