কবি জীবনানন্দ দাস লিখেছিলেন, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়। ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ অনায়াসে গুঁড়িয়ে দিতে যিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত, তিনিও শেষমেশ হার মেনেছিলেন জীবনের ময়দানে। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ৮২ বছর বয়সে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন এডসন অ্যারান্তেস দো নসিমন্তে; ফুটবলের রাজা পেলে নামেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি যার। ব্রাজিল কিংবদন্তির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। 

অনন্তলোকের ডাক এড়ানোর সাধ্য কার। দরিদ্র পল্লীতে জন্মের পর জীবনযুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করে টিকেছিলেন। বল পায়ে জাদুকরী ছোঁয়ায় দশকের পর দশক মাতিয়ে রেখেছেন কোটি ভক্তকে। মরণঘাতী ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শারীরিক শক্তি হারিয়েছেন। তবুও ফুটবল থেকে দূরে থাকতে পারেননি। গেল বছর কাতার বিশ্বকাপের সময় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। কেমোথেরাপি কাজ করছিল না বলে ‘এন্ড-অফ-লাইফ’ ইউনিটে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাকে। সে অবস্থায় থেকেও ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রাণভরে উপভোগ করেছেন বিশ্বকাপ।

নিজ দলের উত্তরসূরীদের সাফল্যে আনন্দিত হয়েছেন, আবার চূড়ান্ত পতনে ব্যথিতও হয়েছেন। হয়তো আরও আগেই সময় পুরিয়ে এসেছিল কালো মানিকের। ডাক্তাররা আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু ফুটবলের রাজা হয়তো বিশ্বকাপের আনন্দটা ম্লান করতে চাননি বলেই লড়াইটা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন আরও কটা দিন। তবে বয়সটা আর সায় দিচ্ছিল না। শেষমেশ হার মানলেন। 

১৯৫০ সালে বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ব্রাজিলের মাটিতে। সেবার শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়েও ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে হেরে দেশটির প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফির স্বপ্ন ধুলিস্ম্যাৎ হয়ে যায়। মারাকানার সেই স্বপ্নভঙ্গের পর বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে দশ বছরের এক কিশোর বলেছিলেন, ‘কেঁদো না বাবা, দেখো একদিন ওই বিশ্বকাপটা ঠিকই এনে দেব আমি।’ বাবা ও দেশবাসীর স্বপ্ন পূরণে সময় নিলেন মাত্র ৮ বছর। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দেশকে প্রথমবারের মতো বিশ্বজয়ের স্বাদ পাইয়ে দিয়ে হয়েছেন ইতিহাসে অমর। বিশ্ববাসীর ভালোবাসা জিতে হয়েছেন সবার প্রিয় ‘পেলে’। এরপর নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে গেছেন বারংবার। একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিন তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি কিংবা হাজার গোলের রেকর্ডে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছেন।

সত্তরের দশকে রাজনৈতিক কারণে ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচের পদ থেকে ছাঁটাই হওয়া সালদানাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ব্রাজিলের সেরা গোলকিপার কে? সালাদানা বলেছিলেন, ‘পেলে’। পাল্টা জানতে চাওয়া হয়, তাহলে সেরা রাইটব্যাক? এবারও উত্তর এলো ‘পেলে’। মোটামুটি দলের অর্ধেক পজিশনে পেলের নাম বলার পর সালাদানা খানিক হেসে বলে ফেলেন, পেলে যে কোনো পজিশনেই বিশ্বের সেরা ফুটবলার।’

চার দশকেরও বেশি সময় আগে ১৯৭৭ সালে অবসর নেওয়ার পরও সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন তিনি। ফুটবল খেলায় পেলে যে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন সেটা মানুষের কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফুটবলপাগল বাংলাদেশেও ব্রাজিলের সমর্থক তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখেন কিংবদন্তি পেলে। ষাট-সত্তরের দশকে ফুটবলে রাজ করেন ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’। দেশের স্কুলের পাঠ্যবইয়েও স্থান করে নেন এ ফুটবল গ্রেট। তখন থেকেই এ দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে পেলের নাম। শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, তিনি মোহিত করে রেখেছেন বাইরের জগতকেও।

তবে তার শুরুটা অতো সহজ ছিল না। ১৯৪০ সালে ব্রাজিলের এক বস্তিতে জন্ম হয়েছিল পেলের। দারিদ্র্যের কারণে ছোট বয়সে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু হৃদয়ে ছিল ফুটবল। ব্রাজিলের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই গলির ফুটবল ছিল তারও অবসরের সঙ্গী। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বলে মোজার ভেতরে খবরের কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চলত তার অনুশীলন। তবে পেলের ছিল সহজাত প্রতিভা। যে প্রতিভা তাকে কালো খনিতে রূপ দিয়েছিল। একবার এক সাক্ষাৎকারে পেলে বলেছিলেন, ‘ফুটবল খেলার জন্যই আমার জন্ম। যেমন বিথোভেনের জন্ম সংগীত লেখার জন্য এবং মাইকেল এঞ্জেলার জন্ম হয়েছিল ছবি আঁকার জন্য।’

শৈশবে তার প্রতিভা চোখে পড়ে যায় সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। পেলে জীবনের মোড় ঘুরে যায় তখনই। সে সময় পেলের বয়স ছিল ১৫ বছর। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সান্তোস ক্লাবে, যোগ দেন ‘বি’ টিমে। সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মধ্যেই মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন পেলে। আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্যারিয়ারে এক হাজার ৩৬৬ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন এক হাজার ২৮৩টি। আর ব্রাজিলের জার্সিতে ৯২ ম্যাচে ৭৭টি গোল করেন তিনি। কদিন আগেই যে রেকর্ড ভেঙেছিলেন নেইমার। 

শুধু সর্বকালের সেরা ফুটবলার নয়, অসাধারণ ব্যক্তি হিসেবেও পেলের যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে। উন্নত জীবনের আশায় ফুটবলাররা ইউরোপের ক্লাবগুলোতে পাড়ি জমান। কিন্তু দেশের স্বার্থে সেটা হাসিমুখে ছেড়ে দিয়েছিলেন পেলে। তারকাখ্যাতি পাবার পর পেলে ভুলে যাননি তার নিজের দারিদ্র্যেভরা শৈশবকেও, ব্রাজিলের দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে খেলোয়াড়ি জীবনেই গড়েছেন বিশেষ ফাউন্ডেশন। আর খেলা ছাড়ার পর কখনও ইউনিসেফের বিশেষ দূত, কখনও জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত, কখনও বা ব্রাজিলের ‘বিশেষ’ ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তাদের সাহায্য করতে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোষের হয়ে খেলতে একবার নাইজেরিয়ার গিয়েছিলেন পেলে। সে সময় আফ্রিকার দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছিল। শুধু পেলেকে দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলগুলো ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল। যদিও এমন ঘটনার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এমনকী ১৯৭৭ সালে পেলের যে আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় সেখানে এই ঘটনার কোনো উল্লেখ ছিল না।

ফুটবলের বাইরে রুপালি পর্দাতেও পেলেকে দেখা গেছে। ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলিয়ান টেলিভিশনের ধারাবাহিক ওস এস্ত্রানহোতে প্রথম দেখা গিয়েছিল কালো মানিককে। হলিউডের ছবি এসকেপ টু ভিক্টোরিতে মাইকেল কেইন, সিলভেস্টার স্ট্যালোনদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক যুদ্ধবন্দির চরিত্রে অভিনয় করেছেন পেলে।

এফআই