আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে মনোনয়ন দিয়ে চমক দিয়েছে। তারকা ক্রীড়াবিদ মনোনয়ন দেয়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সংস্কৃতিরই অংশ। এর শুরুটা হয়েছিল ১৯৯১ সালে আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু ও বাদল রায়ের মনোনয়ন দিয়ে।

হাল আমলে ক্রিকেট সাকিব-মাশরাফির যেমন জনপ্রিয়তা আশির দশকেই তেমনই জনপ্রিয় ছিলেন ফুটবলাররা। বিশেষত আবাহনী-মোহামেডানের তারকা ফুটবলারদের দেশের সবাই চিনতেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ থেকে চুন্নু ও কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে বাদল রায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন।

বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম কিংবদন্তী আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু আসন্ন নির্বাচনের আগে স্মরণ করলেন তিন দশক আগে নিজের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি,‘ আমার জীবনের বিশেষ ঘটনা। নারায়ণগঞ্জে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কখনো জাতীয় নির্বাচন করব এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হব এটা কখন ভাবিনি। পুরোটাই সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্যই। তিনিই আমাকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ-ফতুল্লা থেকে মনোনয়ন নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ’ 

দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আবাহনীর প্রতিষ্টাতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। আবাহনীর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব মোহমেডানের প্রতিও সমান আন্তরিকতা শেখ হাসিনার, ‘জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার হলেও আমার পরিচয় মূলত আবাহনীর চুন্নু। আপা নির্বাচনকালীন সময়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই আবাহনীর, মোহামেডান থেকেও একজন মনোনয়নকে দেব। ৯১ সালের নির্বাচনে আমার সঙ্গে বাদলও ( বাদল রায় ) মনোনয়ন পায়।’

তারকা ফুটবলার বাদল রায় দুঃসময়ে ছাত্রলীগ করেছেন। ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। মোহামেডানের তারকা ফুটবলার ১৯৯১ সালে নিজ জেলা কুমিল্লা দাউদকান্দি থেকে নির্বাচন করেছিলেন। বাদল রায় ২০২০ সালে অসুস্থ হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেন। জীবিতবস্থায় ক্রীড়াঙ্গনে অনেক আড্ডায় তিনি ’৯১ সালের মনোনয়ন আওড়াতেন এভাবে, ‘ক্রীড়াবিদদের রাজনীতির অঙ্গনে জায়গা দেয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই তৈরি করেছে। ৯১ সালে চুন্নু ভাই এবং আমার মনোনয়ন পাওয়া উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১৭ গোল করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গোলদাতা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু। ১৯৭৫-’ ৮৮ সাল ঢাকা আবাহনীর হয়ে খেলেছেন। ৮৮ সালের বন্যায় জনস্বার্থে কাজটি চোখে পড়েছিল আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর, ‘৮৮ সালের বন্যায় আমি আবাহনী সমর্থক গোষ্ঠীর মাধ্যমে ত্রাণ কার্য করেছিলাম। এটি নেত্রীর খুবই পছন্দ হয়েছিল এবং তিনি আমাকে আমার এলাকায় কাজের নির্দেশনা দেন এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন’ বলেন চুন্নু। 

দুই বছর পর চুন্নু নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন, ‘আপা (শেখ হাসিনা) আমাকে আগেই বলেছিলেন ‘তুই কাজ করে যা’। আমি আবাহনীর পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জেও সময় দিয়েছি অনেক তখন। '৯১ নির্বাচনেই আমাকে মনোনয়ন দেবে এটা কেউ ভাবিনি। এমনকি আমিও না। আসলেই আমার এবং বাদলের মনোনয়ন ঐ নির্বাচনে বেশ চমক ছিল।'

বাদল রায় এবং চুন্নু দুই জনই ৯১ সালে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। বাদল রায় নির্বাচনে পরাজিত হলেও আমৃত্যু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের ক্রীড়া বিষয়ক সহ-সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। নিজ জেলা কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের নানা পদেও ছিলেন। 

বাদল আজীবন আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করলেও চুন্নু ৯৬ সালের পর থেকে আর রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি। এর কারণটিও বললেন,‘ ৯১ সালে নির্বাচনে আমি পরাজিত হলেও লক্ষাধিক ভোট পেয়েছিলাম। যা আগের নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীও পায়নি। পরাজিত হওয়ার পরেও আমি পরের চার বছর নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ’৯৬ নির্বাচনে নেত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই এবার মনোনয়ন নিস না।’ নেত্রীর বারণের পর আমি আর মনোনয়ন কখনো নেইনি। এরপর জাতীয় রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রয় হয়ে পড়ি। ’

চুন্নু-বাদল দুই জনই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন অবসর নেয়ার পর। দুই জনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। গত নির্বাচনে মাশরাফি এবং আসন্ন নির্বাচনে সাকিব জাতীয় দলে থাকাবস্থায় নির্বাচন করছেন। এই বিষয় নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও চুন্নু দেখছেন ভিন্নভাবে, ‘আমি অবসর নেই ৮৮ সালে। বাদল আরো দেড় বছর পর। খেলোয়াড় থাকাবস্থায় নির্বাচন করা যাবে না এ রকম কোনো আইন নেই। তাছাড়া দুই জনই যখন নির্বাচনে আসছে ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায়। জাতীয় তারকা জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দলের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায় ও নির্বাচনও আকৃষ্ট হয়।’

রাজনৈতিক অনেক ব্যস্ততা থাকলেও ক্রীড়াবিদদের জন্য অনেক উদার ও আন্তরিকতা শেখ হাসিনার। চুন্নু তার প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি স্মরণ করলেন এভাবে, ‘১৯৮১ সালে নেত্রী দেশে ফেরার কিছু দিন পরই ধানমন্ডির বাড়িতে দেখা করতে যাই। তখন আপার (শেখ হাসিনা)  ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন মৃণাল দা। তিনি নেত্রীকে জানান, ‘আবাহনীর ফুটবলার চুন্নু এসেছে দেখা করতে’ নেত্রী এসেই প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, ‘কিরে কেমন আছিস?  তোরা তো ভালোই খেলছিস’ প্রথম সাক্ষাত হলেও খুব দ্রুতই যেন আপন করে নিয়েছিলেন। এরপর খেলা, রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত অনেক সময় অনেক কাজই গিয়েছি আন্তরিকতা সমানভাবেই পেয়েছি।’

এজেড/জেএ