ক্লাবের মূল ফটকের সামনের তালা খুলতেই জমাবদ্ধ পানি। কিছু জায়গায় আবার মশার আবাদও! যেন ডেঙ্গুর চারণভূমি। ক্যাসিনো কান্ডের প্রায় সাড়ে তিন বছর পর তালা খুলল শতবর্ষী ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। 

দীর্ঘদিন ক্লাব বন্ধ থাকায় আগেই অনুমেয় ছিল ট্রফি ও কাগজপত্রাদি নষ্ট হয়ে যাওয়ার। তবে আজ তালা খুলার পর ক্লাব কর্তারা একেবারে নিঃস্ব অবস্থা দেখে হতবাকই হয়েছেন। ক্লাবের অফিস বা ক্যাম্প কোনো অংশেই আসবাবপত্র, কাগজপত্রাদি কিছুই নেই। কিছু অংশে বৈদ্যুতিক তার, টিনের চালও নেই। এর মধ্যে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতাও তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের অন্যতম প্রাচীন ও সফল ক্লাবটি এখন রীতিমতো ভুতুড়ে বাড়ি!

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় দুই যুগ ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন শওকত আলী খান জাহাঙ্গীর। দীর্ঘদিন পর ক্লাব প্রাঙ্গন খোলার উপলক্ষ্যে আজ এসেছিলেন এই বর্ষীয়ান সংগঠক। প্রিয় ভিক্টোরিয়ার এই পরিস্থিতিতে বেশ ব্যথিত জাহাঙ্গীর, 'অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে এগুলো হয়তো সময় এবং অর্থের মাধ্যমে রিকভার করা যাবে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী ট্রফিগুলো তো আর পাব না। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলের অনেক ঐতিহ্য ছিল। সেগুলো তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এটাই সবচেয়ে দুঃখের।’

বাংলাদেশে শতবর্ষী ক্লাব দু’টি (শীর্ষ পর্যায়ে )। সবচেয়ে প্রাচীন ক্লাব ওয়ারীর প্রতিষ্ঠা ১৮৯৮ সালে। এর পাঁচ বছর পরেই জন্ম ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ওয়ারীর জৌলুস ক্রমেই কমেছে। পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবল, ক্রিকেটে ওয়ারীর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড সেভাবে নেই। 

ওয়ারীর গা ঘেষে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের পাকিস্তান আমলেও ছিল ব্যাপক দাপট। এক যুগ আগেও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটে শিরোপা ফাইট করেছে। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল সহ অনেক তারকা ক্রিকেটার খেলেছেন ভিক্টোরিয়ার হয়ে। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল, হকিতেও ভিক্টোরিয়ার সাফল্য রয়েছে। এর সব কিছুই এখন শুধুই স্মৃতি।

মতিঝিল ক্লাব পাড়ায় ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, দিলকুশা, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ও মোহামেডান ক্লাব (একাংশ) ক্যাসিনো অভিযানের পর সাড়ে তিন বছর বন্ধ ছিল। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা ক্লাব খুলেছে। আজ খুলল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। আজ সাবেক ফুটবলার আব্দুল গাফফার এবং দুই বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক হারুনুর রশিদ ও মোজাফফর হোসেন পল্টু বন্ধের পর খোলা ক্লাবগুলো পরিদর্শন করেন।

চার ক্লাব পরিদর্শন শেষে সাবেক ফুটবলারদের সংগঠন সোনালী অতীত ক্লাবে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ আব্দুল গাফফার বলেন, ‘মাস তিনেক আগে মেরিনার্স ক্লাবের মসজিদ নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের সময় যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আমাকে ক্লাবগুলোর অচলাবস্থা নিরসনের বিষয়ে সমন্বয়ের অনুরোধ করেন। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, র‌্যাবের ডিজির সঙ্গে ক্লাব প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করেছি। নানা আইনগত প্রক্রিয়া শেষে ১ সেপ্টেম্বর ক্লাবগুলো খোলার দিনক্ষণ ঠিক করি। ঐ দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মসূচি,পরের দিন সুধী সমাবেশ থাকায় আমরা আজই আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাবগুলো পরিদর্শন করলাম ও নতুনভাবে যাত্রা শুরু করল। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীও সামনে ক্লাবগুলো পরিদর্শনে আসবেন।’

 

মতিঝিল ক্লাব পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের। মূল অফিস ও ক্লাব পাড়া অক্ষতই রয়েছে এবং কর্মকান্ড চলমান রয়েছে। অডিটরিয়ামে ক্যাসিনো কান্ড পরিচালনা হওয়ায় সেই অংশটুকুই তালাবদ্ধ ছিল। অন্য পাঁচ ক্লাবই (ওয়ান্ডারার্স এখনো খুলেনি) কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতি দৃশ্যমান ভিক্টোরিয়ার। চার ক্লাব পরিদর্শন শেষে আব্দুল গাফফারের পর্যবেক্ষণ, 'ক্লাবগুলোর সংস্কার কাজ করতেই কোটি টাকার ওপরে লাগবে। ক্লাবগুলোর সহায়তার জন্য ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং বিসিবি সভাপতিকে অনুরোধ করব।’ ক্লাবগুলো পুনরায় শুরু হতে যাচ্ছে কড়া বিধি নিষেধের মধ্য দিয়ে এটাও স্মরণ করিয়েছেন এই কৃতি ফুটবলার, 'অনেক চড়াই উতরাইয়ের পর ক্লাবগুলো খুলছে। রাত ১১ টার পর খেলোয়াড় ও ক্লাব স্টাফ ছাড়া কেউ থাকতে পারবে না। স্থানীয় কমিশনার এবং থানা এটি পর্যবেক্ষণে রাখবে। ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িতরাও এই ক্লাবগুলোর সঙ্গে জড়িত হতে পারবে না।’ ভুক্তভোগী ক্লাবগুলো বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক-সভাপতিরা গাফফারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, 'আমরা সবাই অঙ্গীকারনামা দিয়েছি। সেই অঙ্গীকার মোতাবেকই ক্লাব পরিচালনা করব এর কোনো ব্যতয় হবে না।' 
 
এজেড/এইচজেএস