বার্সেলোনার জার্সিতে ২০১৪-১৬ শেষ দুই মৌসুম দারুণ ফর্মে ছিলেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার জুনিয়র। যেখানে ১০০ ম্যাচে ৭০টি গোলের পাশাপাশি ৩৮টি গোলে অ্যাসিস্ট করেন এই তারকা ফরোয়ার্ড। এর ভেতর এক মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ শিরোপার ট্রেবল ঘরে তোলে বার্সা। তার সেই ফর্মই কী কাল হলো? নইলে কেন লিওনেল মেসি ও লুইস সুয়ারেজের সঙ্গে দুর্দান্ত কম্বিনেশন চুকিয়ে তিনি পাড়ি জমান পিএসজিতে! ২০১৭ সালে ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিশ্বরেকর্ড গড়া সেই ট্রান্সফারের পর আর কোনোকিছু ঠিক থাকেনি নেইমারের!

এরপর প্যারিসের ক্লাবটিতে তিনি ঘটনাবহুল ছয়টি মৌসুম কাটিয়েছেন। তবে বিতর্ক আর ইনজুরিই ছিল তার সাময়িক এই অধ্যায়ের প্রায় নিত্য সঙ্গী। যদিও নেইমার মাঠে যতক্ষণ ছিলেন, ‘ফর্ম’ তাকে দারুণ সঙ্গ দিচ্ছিল। কিন্তু দলীয় পারফরম্যান্সই যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ১৩টি লিগ টাইটেল জিতলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ‍চূড়ান্ত সাফল্য পাচ্ছিল না কাতারি ধনকুবের নাসের আল খেলাইফির পিএসজি।

সে কারণে প্যারিসিয়ানরা কয়েক মৌসুম ধরেই ব্রাজিল ফরোয়ার্ডকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল। গত মৌসুমেও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে পিএসজির। এরপর খেলাইফি আর রাখডাক রাখেননি, তিনি বলেই বসেন আর দলে রাখবেন না নেইমারকে। যদিও লুইস এনরিকে দলটির ডাগআউটে আসার পর অনেকেই ভাবছিলেন, সাবেক কাতালান ক্লাবের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা নেইমারের সঙ্গে ভালো ‍জুটি গড়তে সাহায্য করবে। কিন্তু তার মাঝেই ক্লাব ছাড়ার পরিকল্পনা এঁটে ফেলেন তিনি।

আরও পড়ুন >> নেইমারের বিদায়ে যা বলছে পিএসজি

এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার বার্সেলোনায় ফেরার আগ্রহের কথাও জানান নেইমার। কাতালান ক্লাবের সভাপতি হুয়ান লাপোর্তাও সেই প্রস্তাবে সায় দিচ্ছিলেন প্রায়। তবে এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ান নেইমারেরই এক সময়ের সতীর্থ ও বর্তমান কোচ জাভি হার্নান্দেজ। তার অনিচ্ছার কারণেই বর্তমান এই আল-হিলাল ফরোয়ার্ডের বার্সায় ফেরার পথে বড় বাধা বলে উল্লেখ করেন ট্রান্সফার বিষয়ক প্রখ্যাত ইতালিয়ান সাংবাদিক ফ্যাব্রিজিও রোমানো।

শেষ পর্যন্ত সেটাই সত্যি হলো। সৌদি আরবের ক্লাব আল-হিলাল কয়েকদিন ধরে পিএসজি ফরোয়ার্ডের জন্য যে প্রস্তাব নিয়ে ধরনা দিচ্ছিল, তাতেই সায় দিয়ে বসলেন নেইমার। আগে থেকে ক্লাবটির সঙ্গে চুক্তিতে যেতে তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও, তার প্রাধান্য ছিল বার্সেলোনার প্রতি। অবশেষে মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) ৩১ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান তারকাকে দলে টানার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিশ্চিত করে সৌদি প্রো লিগের দলটি। পিএসজিতে বছরে আড়াই কোটি ইউরো বেতন পেতেন নেইমার। বিপরীতে আল হিলালে মৌসুমপ্রতি তিনি ১৬ কোটি ইউরো পাবেন বলে শোনা যাচ্ছে। ক্লাবটির সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছে দুই বছরের। পরবর্তীতে নেইমার চাইলে আরও এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে পারবেন।

কিন্তু তার এমন সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না ব্রাজিল ও বিশেষত নেইমারভক্তরা। তাদের প্রশ্ন, ইউরোপে থেকে যাওয়ার আর কোনো বিকল্পই কি ছিল না নেইমারের সামনে? যখন ৩৫-ঊর্ধ্ব মেসি-রোনালদোরা আগেই ইউরোপ থেকে বিদায় নিয়েছেন, তখন অনেকের মনে বড় তারকা হিসেবে নেইমারের নামটাই সবার আগে এসেছিল। কিন্তু মেসি-রোনালদোর পর সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী তারকাও ৩১-এর কোঠায় এসে ইউরোপের জনপ্রিয় মঞ্চ ছেড়ে দিলেন!

আরও পড়ুন >> নেইমারকে সরাতেই এমবাপের এমন নাটক!

ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যম গ্লোবো বলছে, আসলেই নেইমারের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তিনি যেকোনো মূল্যে পিএসজি ছাড়তে চেয়েছিলেন। এমনকি এনরিকেও সম্প্রতি জানিয়ে দেন, পিএসজির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নেই নেইমার। অথচ তার সঙ্গে ক্লাবটির চুক্তি ছিল ২০২৭ সাল পর্যন্ত। এর পেছনে অবশ্য ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপেরও দায় দেখছে সংবাদমাধ্যমটি। এমবাপেকে নিয়ে প্যারিসিয়ানরা এগিয়ে যেতে চায় বলে একই স্কোয়াডে নেইমারের উপস্থিতি ‘অসম্ভব’ পর্যায়ের। এছাড়া পার্ক দ্য প্রিন্সেসের উগ্রবাদী ‘আল্ট্রাস’ সমর্থকগোষ্ঠী নেইমারকে নিয়ে বিতৃষ্ণায় ভুগছেন। যদিও এর আগে তারা মেসি-এমবাপেকে নিয়েও ঘৃণার বিষ ছড়িয়েছিল।

ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর ‘অদ্ভুত’ নীরবতা
চলতি দলবদলের বাজার শুরুর আগে থেকে আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, নিউক্যাসলসহ বেশকিছু ক্লাব নেইমারকে নিতে চায় বলে খবর বেরিয়েছিল। কিন্তু খেলোয়াড় কেনার ভরা মৌসুম শুরু হতেই তারা সেই আলোচনায় দাঁড়ি টেনে বসেন। গত ১০ দিনে ব্রাজিল তারকার জন্য প্রস্তাব পাঠায়নি কোনো ইউরোপীয় ক্লাবই। অন্যদিকে বার্সার মৃদু আগ্রহ থাকলেও, বাধ সাধছিল তাদের অর্থসংকটের পুরনো বিষয়টি। একইসঙ্গে জাভির ব্যক্তিগত পরিকল্পনাতেও ছিল না নেইমারের নাম। সেক্ষেত্রে নেইমার ও পিএসজি উভয়পক্ষের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে পানি এনে দেয় আল-হিলাল। যাতে সম্মতি দিতে কোন পক্ষই আর বিলম্ব করতে রাজি ছিল না।

আরও পড়ুন >> প্রেমিকার সঙ্গে থাকাসহ সৌদি ক্লাবকে যত শর্ত নেইমারের

এদিকে, নেইমার পুরনো ক্লাব ত্যাগের পরই বিভিন্ন শর্তে রাজি হয়ে পিএসজিতে থেকে গেছেন এমবাপে। বলা হচ্ছে ব্রাজিল তারকাকে সরাতেই ক্লাব ছাড়ার নাটক সাজিয়েছেন ফরাসি অধিনায়ক। তার সঙ্গে চলা ফরাসি ক্লাবটির অস্বস্তিকর সম্পর্কও বদলে গেছে মুহূর্তেই। সংবাদ মাধ্যম ফুটমার্কাতোর দাবি, পিএসজি প্রেসিডেন্ট নাসের আল খেলাইফির সঙ্গে চুক্তি নবায়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ফ্রান্স স্ট্রাইকারের। এমনকি আরও একবছরের জন্য তিনি ঐচ্ছিকভাবে চুক্তি নবায়ন করতে সম্মত হয়েছেন।

স্বদেশি ক্লাব সান্তোস ছেড়ে ইউরোপে পা রাখার পর বহুল কাঙ্ক্ষিত অধ্যায়ের ১০ বছরেই ইতি টেনেছেন নেইমার। নতুন ক্লাবেও ১০ নম্বর জার্সিতেই খেলতে দেখা যাবে তাকে। এশিয়া চ্যাম্পিয়ন আল-হিলালের হয়ে তিনি নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে ছয় বছরের জার্নির জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নেইমারকে ‘ক্লাব লিজেন্ড’ বলে উল্লেখ করেছে পিএসজি।

ফ্রেঞ্চ ক্যাপিটালের দলটিতে নেইমার সবমিলিয়ে ১৭৩টি ম্যাচ খেলেছেন। যেখানে ১১৮টি গোলের পাশাপাশি এই তারকা ফুটবলারের অ্যাসিস্ট সতীর্থদের করা ৭০ গোলে। ওই সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৩১৮টি ম্যাচ খেলে পিএসজি। অর্থাৎ, অর্ধেকেরও বেশি ম্যাচে নেইমার ইনজুরির কারণে মাঠে ছিলেন না। পিএসজি অধ্যায়ে ৫টি ফ্রেঞ্চ চ্যাম্পিয়নশিপসহ মোট ১৩টি টাইটেল জেতেন এই তারকা ড্রিবলার। এছাড়া ২০২০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে হন রানার-আপ।

এএইচএস