২৬ জুলাই ১৯৭৩ সাল। এ দিনে মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ ফুটবল দলের অভিষেক হয়। বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। ৮৩ বছর বয়স্ক পিন্টু এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জীবনের সায়াহ্নে এসে অনেক স্মৃতিই এখন পিন্টুর হৃদয়পটে ধূসর। এরপরও বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের স্মৃতি পিন্টুর কথায় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের। 

আমার ৮৩ বছর জীবনে প্রায় ৭০ বছরের বেশিই ফুটবলের সঙ্গে। কখনো খেলেছি, কখনো কর্মকর্তা। আমার এই দীর্ঘজীবনে অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত দেশের প্রথম ফুটবল অধিনায়কত্ব করা। শুধু ফুটবলই নয়, হয়তো দেশের সব খেলার মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক অধিনায়কও বোধ হয় আমি। এটা আমার আজীবনের গর্ব। 

সেই গর্বই এখন আমার হতাশা। কারণ বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচের অনেক ঘটনাই যে মনে নেই। ৫০ বছর আগের ঘটনা কি আর মনে থাকে। তাও থাকতো গত বছর দুয়েক ধরে আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারি না। 

যতদূর মনে পড়ে, মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে আমরা প্রথম খেলতে যাই। স্বাধীনতার পর মালয়েশিয়ার আগেও কিন্তু আমরা বিদেশে গিয়েছি (৭২ সালে ভারতের আসামে বরদলুই ট্রফি) সেটা অবশ্য বাংলাদেশ নামে নয় অন্য নামে (ঢাকা একাদশ)। মারদেকার জন্য কত দিনের কেমন প্রস্তুতি ছিল একদম মনে নেই। 

জীবনের সায়াহ্নে এসে অনেক স্মৃতিই এখন পিন্টুর হৃদয়পটে ধূসর।

যাই হোক, মারদেকায় কয়েকটি ম্যাচ খেলেছিলাম। আমিই অধিনায়কত্ব করেছি। আমার একটা আত্মবিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ দলের প্রথম অধিনায়ক আমিই হব। কারণ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক আমি ছিলাম। দেশের স্বাধীনতার জন্য ফুটবলাররা বিদেশের মাটিতে লড়েছে। এমন ঘটনা বিশ্বের কোথাও নেই। স্বাধীনতার পর ঢাকায় কয়েকটি ম্যাচ হয়েছিল (মুজিবনগর একাদশ, ঢাকা একাদশ) সেগুলোতেও অধিনায়ক ছিলাম। সেই ধারাবাহিকতাতেই হয়তো প্রথম বাংলাদেশ দলের অধিনায়কও আমাকে করা হয়। স্বাধীন বাংলা দলের মতো বাংলাদেশ প্রথম ফুটবল দলের সহকারীও প্রতাপ ( প্রতাপ শঙ্কর হাজরা)। 

বাংলাদেশের পতাকা মারদেকা কাপের আগে কিন্তু আমি ভারতের নদীয়াই তুলেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমরা পতাকা তোলায় নদীয়ার ডিসি ( ডি.কে হালদার) বরখাস্তও হয়েছিল। এত কথা বলছি আসলে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের ঘটনা মনে করার জন্য। 

(কিছুক্ষণ থেমে) মারদেকায় আমরা কয়েকটি ম্যাচ খেলেছিলাম। প্রথম ম্যাচে আমরা শুরুতে মনে হয় গোল খেয়ে যাই। তখন এনায়েতকে বললাম ভাই তুমি একটা গোল করো। এনায়েত বলেছিল পিন্টু ভাই গোল করব চিন্তা কইরেন না। এনায়েতই বাংলাদেশের প্রথম গোল করে। এরপর আরেকটি গোল করি আমরা। কে করেছে মনে করতে পারছি না ( দ্বিতীয় গোলটি কাজী সালাউদ্দিনের )। আমাদের প্রথম খেলাটি ড্র ছিল। পরে বোধ হয় টাইব্রেকারও হয়েছিল। কেন-ই বা টাইব্রেকার হয়েছিল আমরা পরে হারলাম না জিতলাম মনে নেই ( গ্রুপ নির্ধারণের জন্য টাইব্রেকার ছিল। বাংলাদেশ টাইব্রেকারে হেরেছিল থাইল্যান্ডের কাছে)।

অভিষেক ম্যাচের বাংলাদেশ দল। 

ঐ টুর্নামেন্টে আমাদের ফলাফল মনে নেই তবে যতটুকু মনে পড়ে প্রতি ম্যাচই বোধহয় গোল করেছি। ৭৩ সালের দলকে আমার কাছে বাংলাদেশের সেরা দলই মনে হয়। গোলরক্ষক সান্টু থেকে শুরু করে ফরোয়ার্ড সালাউদ্দিন-নওশের সবাই সেরা। বিশেষ করে সান্টু তো অনন্য মানের খেলোয়াড় ( পূর্ব পাকিস্তান থেকেও পাকিস্তান দলে খেলেছেন)। মারদেকায় প্রথম টুর্নামেন্টেও দারুণ খেলেছে দারুণ খেলেছে সে।

৫০ বছর আগের কথা কি আর এত মনে থাকে। এই ইতিহাসটা সংরক্ষণ করা দরকার। ফুটবল ফেডারেশনেও বোধ হয় এই ম্যাচের কোনো কিছুই নেই। সেই দলের অনেকেই দুনিয়াতে নেই। আমি, প্রতাপ মারা গেলে ঐ ম্যাচের কথা আর কেউ সেভাবে হয়তো বলতেও পারবে না। আমাদের ইতিহাস কি এভাবে চলেই যাবে।

অনুলিখন- জাকারিয়া পিন্টু: বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক।

এজেড/এফআই