বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকার্স সিরাত জাহান স্বপ্না গত বৃহস্পতিবার বাফুফের ক্যাম্প ত্যাগ করে নিজ জেলা রংপুরে চলে গেছেন। জাতীয় দলের অন্য সতীর্থরা ক্যাম্পে থাকলেও অনেকটা অবসাদ ও অভিমানে স্বপ্না ক্যাম্প ত্যাগ করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। নেপালের মাটিতে স্বাগতিকদের হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের আসর সাফ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। সেই সাফজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সিরাত জাহান স্বপ্না।

হঠাৎ স্বপ্নার ফুটবলকে বিদায় জানানোর ঘোষণায় তোলপাড় ফুটবলাঙ্গনে। এর কারণ জানতে বিভিন্নভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে অপারগতা প্রকাশ করেন স্বপ্না। তাকে এবং পরিবারকে এ নিয়ে যেন সংবাদকর্মীরা বিরক্ত না করেন, সেটি উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দেন এই খেলোয়াড়। যদিও পরে স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলেছেন তিনি।

রোববার (২৮ মে) দুপুরে ফুটবলকন্যাদের গ্রামখ্যাত রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুস্কুরণী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রামে গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ‘স্বপ্নার ফুটবল অধ্যায়ে হঠাৎ বিদায়’ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়। ওই গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন সিরাত জাহান স্বপ্না। তার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় স্বপ্নাসহ তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে।

সিরাত জাহান স্বপ্না বলেন, ‘পরিবার আর নিজেকে সময় দিতেই ফুটবল থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা তো সারা বছরই ক্যাম্পের মধ্যে একটা টাইট শিডিউলে থাকি। ওইভাবে আসলে নিজেকেও সময় দিতে পারি না এবং পরিবার কেউ সময় দিতে পারি না। তাই মনে হলো এবার একটু ফ্যামিলিকে টাইম দেওয়া উচিত। একটু নিজেকে সময় দেওয়া দরকার।’

দলে না থাকলে আসন্ন ম্যাচগুলোতে কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে সাফজয়ী এই ফুটবলকন্যা বলেন, ‘না আসলে ওই দিক থেকে কোনো তো সমস্যা হওয়ার কথা না। সেপ্টেম্বরে আমাদের এশিয়ান গেমস আছে এবং পুরা টিমের ভালো প্রিপারেশন চলছে। আমি নিজেও অনেক হার্ডওয়ার্ক করেই কিন্তু বাসায় ফিরেছি। এ কারণে সমস্যা হওয়ার কোনো প্রশ্ন আসে না।’

তিনি আরও বলেন, ‌‘দেশের নারী ফুটবল এখন ভালো জায়গায় রয়েছে। জুনিয়ররা ভালো পারফর্ম করছে। তাদের জন্য জায়গা করে দিতে হবে। আমরা যদি সারাবছর ওই জায়গাগুলো ধরে রাখি তাহলে ওরা কীভাবে সুযোগ পাবে।’

প্রধান কোচ ছোটনের পদত্যাগ ও দলের অন্যতম স্ট্রাইকার সিরাত জাহান স্বপ্নার আকস্মিক অবসর নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো ক্রীড়াঙ্গনকে। এ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চলছে। ব্যাপারটা কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে স্বপ্না বলেন, ‘স্যার কেন অবসরে গেলেন তা আমি বলতে পারব না। ওনার হয়তো মনে হয়েছে অবসর নেওয়া দরকার, তাই অবসরে গিয়েছেন। স্যার যদি চলে যান তাহলে নারী ফুটবলের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ছোটন স্যারের জন্য নারী ফুটবল আজ এত উচ্চতায় এসে পৌঁছেছে। আমাদের সফলতার অন্যতম কারিগর ছোটন স্যার।’

জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসার পর নারী ফুটবলাররা কোনো ম্যাচ খেলতে পারেননি। দুই দফা প্রীতি ম্যাচের আয়োজনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় ফুটবল ফেডারেশন। মিয়ানমারের অলিম্পিক বাছাইয়েও খেলতে পাঠায়নি। আবার অনেকের দেশের বাইরে খেলার প্রস্তাব ছিল। নারী ফ্রাঞ্চাইজি লিগের জন্য সেই প্রস্তাবেও সাড়া দিতে পারেননি। নারী ফ্রাঞ্চাইজি লিগ কবে হবে এ নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। সব কিছু মিলিয়ে স্বপ্না হতাশ ছিল বলে বিশ্বস্ত সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

মেয়ের ফুটবল ছাড়ার বিষয়ে স্বপ্নার মা লিপি বেগম বলেন, ‘বেটি বাড়িত আইসার (আসার) পর খালি কইল (বলল) মা আমি আর খেলাধুলা করব না। উয়্যার (ওর) মনোত আগে থাকি ওই সিদ্ধান্ত আছিল নাকি সেটা হামরা জানিও না, কবারও পামো না। ছাওয়া আমার অসুস্থতার কতা শুনি বাড়িত আলচে ডাক্তার দ্যাকপার (দেখানো) জনতে। এ্যলা শুনোছি আর নাকি ঢাকাত যাবার নায়, ফুটবলও খেলাবার নায়।’

স্বপ্নার মা বলেন, ‘এখন বেটি (মেয়ে) আসিয়া হুট করি কওচে আমি আর খেলবো না, ভাল নাগেচে না। মেয়ে যদি হামার না খেলে, তা হামরা কি জোর করি কমো যা খেলাধুলাত। আমি তো এই কতা কবার পাবার নাই। আমার ছোট বেটি কষ্ট করি খেলাধুলা করি ট্যাকা (টাকা) আনে। আমি অনেক কান্দি কান্দি ওই টাকা খাই। আমাক খুব কষ্ট নাগে আমার ছোট বেটির কষ্ট দেখি।  ব্যাটা ছাওয়া হইলে আমাক ওতো আঘাত নাগিলো না হয়। ওই জন্যে আমি মেয়েক জোর কইরবারো নাই।’

এর আগে ক্যাম্প ত্যাগ করে বাড়ি ফেরার পর শুক্রবার বিকেলে পেশাদার ফুটবল ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে সিরাত জাহান স্বপ্না লিখেন, ‌‌‘আমি নিজ ইচ্ছায় পেশাদার ফুটবল থেকে বিদায় নিলাম। প্রায় আট বছর পেশাদার ফুটবল খেলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ফুটবল ক্যারিয়ারে আসার পর আমি অনেক কিছু পেয়েছি। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি। খেলার সুবাদে অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। তাই জেনে বা না জেনে যদি কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকি প্লিজ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’

প্রসঙ্গত, সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী সিরাত জাহান স্বপ্নারা তিন বোন। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। স্বপ্নার বাবা মোকছার আলী একসময় বর্গাচাষি ছিলেন। আর মা লিপি বেগম অভাব অনটনের সংসারে সন্তানদের মুখে একবেলা ভাত তুলে দিতে করেছেন ধান ভাঙার কাজ। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকোও ছিল না। সেই কষ্টের সংসারে স্বপ্না যেন ভাঙ্গাঘরে চাঁদের আলো।

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ের ২০১১ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে স্বপ্নার আত্মপ্রকাশ। এরপর তার ক্রীড়া নৈপুণ্যে নজর পড়ে বাফুফের। সিরাত জাহান স্বপ্না ২০১৩ সালে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পায়, সেই থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় দলে খেলছেন। সবশেষ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ৪ গোল করে দেশের জয়ে ভূমিকা রেখেছেন স্বপ্না। এই চার গোলের মধ্যে দুটিই ছিল ভারতের জালে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এফআই