ঈদ মানেই আনন্দ-উৎসব। কিন্তু দেশের কিংবদন্তি ফুটবলার জহিরুল হকের পরিবারের জন্য এবারের ঈদটা ব্যতিক্রম। ডিফেন্ডার জহির ক্যারিয়ারে বহু আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। প্রতিপক্ষকে রুখে দিয়ে পরক্ষণেই করেছেন নিজ দলের আক্রমণের সূচনা। জীবনের সায়াহ্নে এসে রোগ-ব্যধির সঙ্গে তার শরীর আর সেভাবে রক্ষণ ও প্রতি আক্রমণ করতে পারছে না।

ঈদের মাত্র দিন তিনেক আগেই জহির হাসপাতালে ভর্তি হন। যার কারণে পরিবারের সবাইকে পালাক্রমে যাতায়াত করতে হয়েছে হাসপাতালে। তবে স্বস্তির খবর, ঈদের আগেরদিন (২১ এপ্রিল) তিনি বাসায় ফিরেছেন। 

এর আগের কয়েক মাস ধরে খুবই নাজুক অবস্থায় জহিরের শরীর। অন্য অনেক ব্যধির সঙ্গে ফুসফুসে পানি জমায় ঈদের তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হন ৮৮ বছর বয়সী এই ফুটবলার। জীবিত ফুটবলারদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি বয়স্ক বলে ফুটবলাঙ্গনে স্বীকৃত। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক জহির। ছেলে-মেয়ে সবাই প্রতিষ্ঠিত।

১৯৬৪ সালে মোহামেডানের হয়ে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন জহির

মিরপুর আনসার ক্যাম্পে নিজ বাসায় তিনি স্ত্রীর সঙ্গেই থাকেন। ছোট ছেলে সপ্তাহে কয়েকদিন এসে বাবার সঙ্গে থাকেন। ঈদের সময় ভাই-বোনের পরিবার জহিরের সঙ্গে কাটানোর চেষ্টা করে। সেটি উল্লেখ করে সাবেক এই ফুটবলারের স্ত্রী সুরাইয়া হক বলেন, ‘এক মেয়ে কাতার থাকে। অনেক সময় সে ঈদে আসতে পারে না। দুই ছেলে ও মেয়ে তাদের সন্তান, স্ত্রী ও স্বামীকে নিয়ে এসে বাবার সঙ্গে সময় কাটায়।’

জহিরের ছেলে-মেয়েরা পেশা ও নিজ সংসার নিয়েই বেশি ব্যস্ত। ঈদের সময় তারা আসলেও বছরের বাকি সময় জহিরের একাকীত্বের সঙ্গী কেবল স্ত্রী সুরাইয়া হক। এক সময় খেলার মাঠ ও ব্যক্তি জীবনে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জহির যেন এখন তার ছায়ামাত্র। দুঃখ ভারাক্রান্ত কন্ঠে জহিরের স্ত্রী বলেন, ‘তিনি (জহির) অনেক দিন থেকেই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। তবে গত বছর নভেম্বরে হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন। রিং পরানোর পরও তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ভাটা পড়েছে। কথা বলতেও মাঝে মধ্যে কষ্ট হয়।’

দুঃখ ভারাক্রান্ত কন্ঠে জহিরের স্ত্রী বলেন, ‘তিনি (জহির) অনেক দিন থেকেই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। তবে গত বছর নভেম্বরে হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন। রিং পরানোর পরও তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ভাটা পড়েছে। কথা বলতেও মাঝে মধ্যে কষ্ট হয়।’

ডিমেনশিয়া রোগে ভোগায় পুরনো স্মৃতি খুব বেশি মনে নেই এক সময়ের এই তারকা ফুটবলারের। এরপরও হঠাৎ ফিরে যান সোনালী দিনগুলোতে, ‘মা, আমরা ভাই-বোন ছাড়া খুব বেশি দূরের কাউকে বাবা সহজে চিনতে পারেন না। এরপরও হঠাৎ কখনও বাবা মোহামেডান ক্লাবের গল্প বলেন’, বলছেন জহিরের ছোট ছেলে ফাহিম।

ফুটবলারদের অনেকেই অবসরের পর কোচ, সংগঠক হিসেবে ক্লাব, ফেডারেশন কিংবা জেলা ক্রীড়া সংস্থায় নানাভাবে জড়িত থাকলেও জহির পরিবার নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এক যুগেরও বেশি সময় তিনি খেলেছেন মোহামেডানে। ১৯৭৬ সালে খেলা ছাড়ার পর মোহামেডান কিংবা ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে সেভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি জহিরুল। এরপরও অনুজদের অনেকেই তার খোঁজ রাখেন বলে জানিয়েছেন ফাহিম, ‘বাংলাদেশে বাবার প্রজন্মের কোনো ফুটবলার বেঁচে নেই (সিলেটে রণজিৎ দাস রয়েছেন। তিনি অবশ্য জহিরের প্রায় সমসাময়িক বা ২-১ বছর বড়ও হতে পারেন)। বাবার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে পিন্টু চাচা ও প্রতাপ চাচাই মাঝে মধ্যে ফোন করে খবর নেন। বশির চাচা নিজেও অসুস্থ। আমার মা’ও বশির চাচার খোঁজ খবর রাখেন।’

১৯৬২ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রতিষ্ঠার বছরেই জহিরুল হককে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কার দেওয়া হয়

দেশীয় ক্রীড়াঙ্গনে অন্যতম কিংবদন্তি প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। তবে জহিরুল হককে গুরু মানেন তিনি, ‘খেলার মাঠে (ফুটবলে) তার কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা ও পরামর্শ পেয়েছি। জহির ভাইয়ের কাছে আমি আজীবনই কৃতজ্ঞ।’

জহিরের ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগণে তখন শুরু প্রতাপের। এরপরও ডিফেন্ডার জহিরকে তিনি মূল্যায়ন করলেন এভাবে, ‘ষাটের দশকে ঢাকার মাঠে কত ফুটবলার খেলেছে তার সঠিক হিসেব নেই। ধরে নেওয়া যায় কয়েকশ থেকে হাজার ফুটবলার ছিল। এত সংখ্যক ফুটবলারের মাঝে পাকিস্তান দলে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) থেকে সুযোগ পেয়েছিলেন ১৫ জনেরও কম। তার মধ্যে জহির ভাই একজন। ফলে জহির ভাই কোন মানের খেলোয়াড় ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’ 

পিন্টু-প্রতাপরা ক্লাব, ফেডারেশনসহ নানা সংস্থায় জড়িত থাকলেও জহির পুরোপুরিই এর বিপরীত। এ সম্পর্কে প্রতাপ বলেন, ‘মোহামেডানে আমাদের প্রজন্মের মধ্যে আমি ও পিন্টু ভাই ক্লাব ও ক্রীড়া রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছি। আমাদের দুই প্রজন্ম পর বাদলরা (প্রয়াত বাদল রায়) এসেছে। তবে আমাদের আগের প্রজন্ম গজনবী ভাইরাও এতে সম্পৃক্ত ছিলেন। জহির ভাই খেলা ছাড়ার পর কাজ ও ব্যবসার ফাঁকে সময় পেলে মোহামেডানের খেলা দেখতে আসতেন, কিন্তু কখনো কর্মকর্তা হননি। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষ। খেলার মাঠে তিনি যেমন পরিশ্রম করেছেন, ব্যক্তিগত জীবনেও। বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির পর আবার নিজের ওষুধের দোকানে সময় দিয়েছেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে একটি স্বচ্ছল আর্থিক পরিবারে রূপ দিয়েছেন জহির ভাই।’

পিন্টু-প্রতাপরা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে যেমন আলোচিত ও সমাদৃত, ততটাই নীরবে-নীভৃতে অবস্থান জহিরের। এজন্য প্রতাপেরও কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে, ‘জহির ভাই জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ২০০১ সালে। এটা অনেক আগেই পাওয়া উচিৎ ছিল। আমাদের অনেকের চেয়েই তিনি ভালো মানের খেলোয়াড় ছিলেন এবং মানুষ হিসেবেও অনন্য। আমরা প্রচার পেয়েছি ফুটবলারের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জন্যও। জহির ভাই স্বাধীন বাংলা দলে ছিলেন না, আবার বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশ দলেও খেলতে পারেননি। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর মোহামেডান থেকেও অবসর নেন। ফলে মিডিয়ায় তাকে নিয়ে সেভাবে লেখা হয়নি বলে আলোচনাও কম।’

সমকালীন মিডিয়ায় সেভাবে লেখালেখি না হলেও ষাটের দশকে ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকরাই জহিরকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বছর দু’য়ের মধ্যে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কার প্রবর্তন শুরু হয়। যেখানে ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রথম বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কারও পান জহিরুল হক।

আক্ষেপ নিয়ে প্রতাপ বলছেন, জহির ভাই জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ২০০১ সালে। এটা অনেক আগেই পাওয়া উচিৎ ছিল। আমাদের অনেকের চেয়েই তিনি ভালো মানের খেলোয়াড় ছিলেন এবং মানুষ হিসেবেও অনন্য। আমরা প্রচার পেয়েছি ফুটবলারের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জন্যও। জহির ভাই স্বাধীন বাংলা দলে ছিলেন না, আবার বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলাদেশ দলেও খেলতে পারেননি। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর মোহামেডান থেকেও অবসর নেন। ফলে মিডিয়ায় তাকে নিয়ে সেভাবে লেখা হয়নি বলে আলোচনাও কম।

১৯৩৫ সালের ৫ জানুয়ারি জহিরের জন্ম। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শাহবাজপুরে। ১৯৫৪ সালে তেজগাও ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগে তার খেলা শুরু। এরপর এই ক্লাবে তিনি দু’বছর খেলেন। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে খেলেন সেন্ট্রাল প্রিন্টিং এন্ড স্টেশনারী দলে। পুলিশ সার্জেন্ট পদে কর্মরত অবস্থায় ১৯৫৯ সালে খেলেন পুলিশ দলে। এরপরের অধ্যায়টা মোহামেডানের। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত জহির খেলেছেন সাদা-কালো জার্সিতে। ৫ বার তার হাতে ওঠে নেতৃত্বের আর্মব্যান্ড। জহিরের ক্যারিয়ারের বিশেষ কৃতিত্ব ৪ বার আগাখান গোল্ডকাপের ফাইনাল খেলা এবং দু’বার চ্যাম্পিয়ন তকমা। ১৯৬১ সাল থেকে পাকিস্তান দলে ডাক পাওয়া শুরু জহিরের। পাকিস্তান দলের হয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা, চীনসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য।

এজেড/এএইচএস