আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ী মহাতারকা লিওনেল মেসি কেবল মাঠেই নন, তার ইতিহাস রয়েছে মাঠের বাইরের আচরণেও। এইতো কিছুদিন আগে আর্জেন্টিনায় প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলেন মেসিরা। সেখানে তাকে ভক্তদের ভালোবাসার মতো মধুর বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। দেশের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে তিনি ভক্তদের উপচে পড়া ভীড়ের মুখে পড়েন। সেই ভীড় সামলে দেখা দেওয়া কিংবা মাঝরাস্তায় গাড়ির গ্লাস নামিয়ে হাত নাড়িয়ে মেসি তাদের আবদার মিটিয়েছেন। এবার তো ভক্তকে বাড়িতেই নিয়ে বসলেন তিনি। 

তবে সেই ভক্তও বেশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। মেসির দেখা পেতে প্যারিসে তার বাসার সামনে বসেছিলেন ১০ ঘণ্টা। জুয়ান পোলকান নামের সেই ভক্ত আর্জেন্টিনার একজন ফুটসাল খেলোয়াড়। পরবর্তীতে তার সেই অপেক্ষার পুরস্কারও পেয়েছেন। দরজা খুলে মেসি তাকে নিয়ে যান নিজের বাসায়।

আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টসের খবরে এই তথ্য বলা হয়েছে। মূলত যুক্তরাস্ট্রের অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ইনফোবে’র সঙ্গে ওই বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার দেন পোলকান। এর আগে তিনি নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ও টিকটকে মেসির সঙ্গে সাক্ষাতের ভিডিও প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন : বার্সেলোনায় ফেরা নিয়ে যে শর্ত দিলেন মেসি

তবে মেসির বাসা খুঁজে পেতে পোলকানের বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। মেসির সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো সেই সৌভাগ্যের ভাগিদার হতে রীতিমতো সংগ্রাম শুরু করেন এই ফুটসাল খেলোয়াড়, ‌‌‘সেখানে যাওয়ার আগে আমি সম্ভাব্য সবকিছু করেছি। (মেসির বাসার) ঠিকানাটা ইন্টারনেটে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। শেষ পর্যন্ত একজন হেয়ারড্রেসারের কাছে ঠিকানাটা পেয়েছি, যে প্যারিসেই থাকে এবং তার (মেসি) বাসায় গিয়েছিল। সে আমাকে ঠিকমতো জায়গাটা দেখায়নি। তবে বাসাটা কোথায় তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে অনেকেই তার বাসার ঠিকানা পেতে কল দিয়েছিল, কিন্তু মেসির প্রতি সম্মান রেখে কাউকে আমি ঠিকানা দিইনি। এরপর যখন তার বাসার সামনে পৌঁছাই তখন সকাল ৮টা। বাসাটা খুঁজে পেতে ৪৫ মিনিটের বেশি লাগেনি।’

এরপর মেসির বাসার সামনে অপেক্ষা করা নিয়েও কথা বলেন পোলকান, ‘অপেক্ষা করেছি ভালোবাসা থেকে। তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাটা মনের ভেতর পুষে রেখেছিলাম। যে হোস্টেলে ছিলাম সকালে সেখানে শুধু একটা কফি খেয়েছিলাম, এরপর রাতে ফেরার আগপর্যন্ত সারা দিনে কিছু খাইনি। (মেসির বাসার সামনে অপেক্ষার সময়) লোকজন আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জার্সি দেখে ভেবেছে, মেসির সঙ্গে হয়তো কোনো সংযোগ আছে! সকাল ৯টা পর্যন্ত বসে থাকার পর তাকে অনুশীলনে যেতে দেখি। শুরুতে সে একা ছিল, দুপুরের দিকে একটি ছেলে এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় এবং দুর্দান্ত একটি চিত্রকর্মও এনে দেয়।’

‘হঠাৎ অ্যান্তোনেলা কোত্থেকে যেন উদয় হয়ে দরজা দেখিয়ে আমাকে ভেতরে যাওয়ার ইশারা দিয়ে বলল “আসো আসো”। সেই দৃশ্যটা কখনো ভুলব না। সে আমার জন্য বাসার দরজা খুলেছে! অন্য কোথাও দেখা করতে পারত, কিন্তু তা না করে নিজের বাসায় ডেকেছে।’

তবে মেসি যখন অনুশীলন শেষে বাসায় ফিরছিলেন তখনও তার কাছে দৌড়ে যাননি অপেক্ষারত এই যুবক। তখন প্রায় ১০ ঘণ্টা হতে চলল, এরপরই মেসির স্ত্রী অ্যান্তোনেলা রোকুজ্জোকে বের হতে দেখেন পোলকান, ‌‘বিকালে বাসায় ফেরার সময় আমি ভেবেছিলাম মেসি আমাকে দেখবেন। সেজন্য আমি তার কাছে যাইনি। এরপর বিকাল সাড়ে ৩টায় হঠাৎ অ্যান্তোনেলা সন্তানদের আনার জন্য গাড়িতে উঠছিল। তখন জানালা খুলে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল মেসির সঙ্গেও হয়তো দেখা করা সম্ভব নয়। আবার ভেবেছি বাসার নিরাপত্তারক্ষী পুলিশকে কল দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দেয় কিনা!‌‌ কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই দেখা পেতে প্যারিসে দু’দিন কাটিয়েছি।’

পরবর্তীতে সেই ধৈর্যের ফল পান পোলকান। তার ধৈর্য দেখে শেষ পর্যন্ত লিওনেল মেসি–অ্যান্তোনেলা রোকুজ্জো দম্পত্তির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। যা নিয়ে পোলকান নিজেও হতবাক হয়েছেন, ‘হঠাৎ অ্যান্তোনেলা কোত্থেকে যেন উদয় হয়ে দরজা দেখিয়ে আমাকে ভেতরে যাওয়ার ইশারা দিয়ে বলল “আসো আসো”। সেই দৃশ্যটা কখনো ভুলব না। সে আমার জন্য বাসার দরজা খুলেছে! অন্য কোথাও দেখা করতে পারত, কিন্তু তা না করে নিজের বাসায় ডেকেছে।’

বাসায় ঢোকার পর অন্যরকম এক উচ্ছ্বাসে কাঁপা শুরু করেন পোলকান। সেই বর্ণনা তিনি এভাবে দেন, ‘আমি ভেতরে ঢুকেই দেখি মেসি শর্টস আর স্লিপার পায়ে দাঁড়ানো। এরপর আমাকে বললেন ‘হ্যালো’। এটি এক অবিশ্বাস্য মুহূর্ত। এরপর আমি তাকে কত ভালোবাসি তা বলতে লাগলাম। পরবর্তীতে আমরা ছবি তুললাম, মেসি আমার ফুটসাল জার্সি ও হাতে অটোগ্রাফ দেন এবং জড়িয়ে ধরেন। তখন আমি বেশ নার্ভাস হয়ে পড়ি এবং হাত কাঁপা শুরু করে। এরপর য্নে অটোগ্রাফ নষ্ট হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনিই আমাকে শান্ত করেন।’

মেসির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পোলকান বলছেন, ‘লিও, আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সেটি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য নয়। শৈশব থেকে যে স্বপ্ন দেখে আসছি তা পূরণ করে আমাকে সুখী করার জন্য ধন্যবাদ। তোমার প্রতিটি ম্যাচেই আমার মুখে হাসি ফোটে। আমি ভাইরাল হতে চাই না। আমি সবাইকে জানাতে চাই মেসি কেমন, কতটা সরল, কতটা আন্তরিক।’

‘লিও, আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সেটি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য নয়। শৈশব থেকে যে স্বপ্ন দেখে আসছি তা পূরণ করে আমাকে সুখী করার জন্য ধন্যবাদ। তোমার প্রতিটি ম্যাচেই আমার মুখে হাসি ফোটে। আমি ভাইরাল হতে চাই না। আমি সবাইকে জানাতে চাই মেসি কেমন, কতটা সরল, কতটা আন্তরিক।’

এর আগে অবশ্য এই আর্জেন্টাইন মেসিভক্ত ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি ছবিও পোস্ট করেন। ক্যাপশনে লেখেন, ‘স্বপ্ন সত্যি হলো। আজ আমার সারা জীবনের স্বপ্নপূরণ হলো। ইতিহাসের সেরা হয়েও যে আন্তরিকতা ও সরলতার সঙ্গে আপনি আমাকে বরণ করে নিয়েছেন, সেটা শুধু অসাধারণ মানুষের কথাই বলে। অ্যান্তোনেল্লাও আমাকে বাসায় নিয়ে এসে স্বপ্নপূরণের সুযোগ করে দিয়েছেন। এই কথাগুলো আমি লিখছি যখন চোখ ভিজে যাচ্ছে আবেগে। শরীর কাঁপছে। হে ছোট জাদুকর, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অবিস্মরণীয় মুহূর্তের জন্য ধন্যবাদ।’

তাতেই থামেননি পোলকান, মেসির অটোগ্রাফ করা হাত নিয়ে ছুটে যান ‘আর্ক দে ত্রিয়োম্ফ’-এ। মেসির অটোগ্রাফ শরীরে চিরকালীন ধরে রাখতে সেটি ট্যাটু করানোর সিদ্ধান্ত নেন পোলকান, ‘(মেসির বাসা থেকে বের হওয়ার পর) ট্যাটু করাতে আর্ক দে ত্রিয়েম্ফের পথে যাচ্ছিলাম। পথে একজন ট্যাটুশিল্পীকে পেয়েও যাই। তিনি রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাকে ট্যাটু করিয়ে দেন।’ 

এরপর নিজের ফুটসাল ক্লাব আইবিএস লে ক্রেত’কেও পোলকান ধন্যবাদ জানান। কেননা মেসির সঙ্গে দেখা করতে ক্লাবই তাকে দুই দিনের ছুটি দিয়েছিল। তবে একটি শর্তও ছিল। দেখা হলে ক্লাবের জার্সিতে মেসির অটোগ্রাফ চাই। সেটা তো জোগাড় হয়েছেই।

এএইচএস