ব্রাজিলিয়ানদের আবেগ জুড়ে শুধুই পেলে
এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো পেলের জীবন বা অর্জন নিয়ে লিখতে হলে চাইলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ শেষ করা সম্ভব। যুগ যুগ ধরে তার ফুটবলীয় যত কীর্তি তা আসলে রুপকথার মতো শোনায়। এখনকার সোশ্যাল মিডিয়া যুগের মাত্র কৈশর পেরোনো কোনো ছেলের কাছে একজন খেলোয়াড়ের যুদ্ধি বিরতি কিংবা শ্রমিক আন্দোলন অথবা একজন খেলোয়াড়কে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ঘোষণা করার মতো বিষয়গুলো গল্পের মতোই শোনাবে আসলে। তবে অনেকের মতেই, ফুটবলের রাজা পেলের জন্য এই গ্রহটায় ফুটবল খেলার জনপ্রিয়তা এতো ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীকে ফুটবলের অনেক কিছুই নতুন করে দেখানো এই কিংবদন্তিকে সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ সর্বকালের সেরা ফুটবলার মনে করে। আবার অনেকে তো সর্বকালের সেরা অ্যাথলেটই মনে করেন তাকে।
সর্বকালের সেরার তর্কে বর্তমানের ফুটবল ভক্তরা অনেকে হয়তো হালের মেসি-রোনালদোকে নিয়ে নামতে আগ্রহী। কিন্তু পেলের খেলার সময়কাল, পৃথিবীব্যাপী তার প্রভাব আর অর্জন বিবেচনায় পেলের উপরে কাউকে রাখা আসলেই কষ্টকর। অবশ্য ব্রাজিলিয়ানদের কাছে এমন তর্ক হাস্যকরই বলা যায়। কিছু ব্রাজিলিয়ান হয়তো গারিঞ্চা, রোনালদোকে সেরা মনে করে তবে সে সংখ্যা হাতে গুনে বলে দেয়া যাবে। প্রায় সবার মতেই পেলে অবিসংবাদিত সেরা, যাকে তারা ব্রাজিলের ফুটবলের সমার্থক ভাবে এবং ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় সম্পদ মনে করে।
বিজ্ঞাপন
আজকের ব্রাজিলে ফুটবলের এই সর্বত্র জনপ্রিয়তা এবং সবাইকে ছাড়িয়ে ব্রাজিলকে যে পৃথিবীর সেরা দল ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা এনে দিয়েছিলেন ফুটবলের এই কালো মানিক। শুধু ফুটবলের দিকটা বললে পেলের প্রভাবের কিছুই আসলে ধারণা পাওয়া যাবে না। ১৮৮৮ পর্যন্ত দাসপ্রথা থাকা দেশটিতে কালোদের মতে, পেলেই ব্রাজিলে কালোদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় নিয়ে এসেছিলেন। দাস থেকে দেশের সম্পদ হওয়ার মতো স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন।
জাতির এই মহানায়কের প্রস্থানে ব্রাজিলে তিন দিনের শোক চলছে। তার ভালোবাসার ক্লাব সান্তোসে চলছে শেষকৃত্যের প্রস্তুতি। রাস্তার বিলবোর্ড বা ছোট ছোট কমার্সিয়াল ডিজিটাল বোর্ডেও একটু পর পর সেই শান্ত স্থির ছোখ গুলো দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তার তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের অনন্যসাধারণ কীর্তির কিছু ঝলক। ফুটবলপ্রেমী একটা ছোট্ট ছেলেও যখন পেলেকে আইডল বলে তখন বুঝতে হবে, পেলে তার জীবদ্দশাতেই অনেকগুলো প্রজন্মের আইডল হয়ে গেছেন। পেলেকে নিয়ে করা র্যালিতে ছলছল চোখে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়দের হাঁটতে আসলে বিশেষ কিছুই।
সোমবার সকালে ব্রাজিলের সবার প্রিয় ‘ওহেই’কে তার ভালবাসার সান্তোস স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হবে শেষ সম্মান জানানোর জন্য। ফুটবলের রাজার বিদায় তো মাঠ থেকেই হওয়ার কথা। এরপর তার মৃতদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরচেনা সান্তোসের রাস্তা ধরে নিয়ে যাওয়া হবে মায়ের বাড়ির কাছে। সেখানে পেলের শতবর্ষী মা হয়তো ছেলেকে শেষ বিদায় জানাবে। এরপর জানুয়ারীর তিন তারিখ, মঙ্গলবার পেলেকে তার বন্ধু আর আত্মীয়দের সাথে ‘নেক্রোপোলি একুমেনিকা’ যা কিনা পৃথিবীর সর্বোচ্চ ‘ভার্টিকেল সিমেট্রি’, সেখানে সমাহিত করা হবে।
সাও পাওলো রিজিওনে পেলে যেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে বছরের এই সময়টা এমনিতেই সারাক্ষণ বৃষ্টি হয়। আর শেষ এক সপ্তাহ তো বৃষ্টি এক কথায় থামেই নি। আমাজনের দেশের অনেক মানুষই এখানে প্রকৃতি নিয়ে অদ্ভুত সব বিশ্বাস নিজের মধ্যে লালন করে থাকেন। তাদের আড্ডায় আর কথার মাঝেই বোঝা যায়, পেলের অসীমের পথে যাত্রার সময়ে এই বিরামহীন বৃষ্টিটাকে প্রকৃতির ভালোবাসা হিসেবেই তারা বিশ্বাস করছে। প্রতিটা রেস্তোরায় চলছে পেলের খেলার অথবা তার জীবনের বিভিন্ন মুহুর্তে ভিডিও। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে দর্শকদের মুগ্ধতার গল্প।
এটা বলা খুবই কষ্টকর যে, ভবিষ্যৎ পৃথিবী কোন ফুটবলারকে আসলে সর্বকালের সেরা মানবে? কারন সর্বকালের সেরা কথাটার মাঝেই একটি তর্ক রয়েছে। তবে ইতোমধ্যেই যে মানুষটাকে পৃথিবীর বেশিরভাগ লোক ফুটবলের গ্রেটেস্ট বলে মেনে আসছে, সাদা কালো যুগের তার রঙিন খেলা গুলো খুঁজে বের করে দেখছে, নতুন প্রজন্মও মুগ্ধ হয়ে আবিস্কার করছে এখনকার সকল কিংবদন্তিদের সবকিছুই এক সময় এই শান্ত, সুস্থির মানুষটা করে দেখিয়ে গেছেন। তখন খানিকটা ঝুঁকি রেখে বলে দেয়াই যায়; হয়তো এই মানুষটাকেই সর্বকালের সেরা হিসেবে বেশিরভাগ মানুষ মনে রাখবে এবং মনে করে।
আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ ।। নগর পরিকল্পনাবিদ, ড্যাড স্কলারশিপে ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অফ এবিসি-তে অধ্যয়নরত।