দু’বার বিশ্বজয় শেষে এবার তিন তারকার লড়াইয়ে মাঠে নামছে ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা। রোববারের এই ফাইনালের আগে চলছে নানা আলোচনা। দুই কোচের মগজেও চলছে ভাবনার ঝড়। বিশ্বকাপ জয় নিয়ে একটা মহা ভাবনা তো আছেই, কিন্তু যে লড়াইগুলো বিশ্বকাপের ভাগ্যটা গড়ে দেবে, আপাতত ভাবনা সেগুলো নিয়েই। সেখানে উতরে যেতে পারলেই যে নিশ্চয়তা মিলবে বিশ্বজয়ের!

>ফ্রান্সের ‘মেসি ঠেকাও’ মিশন

বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচটা খেলতে নামছেন লিওনেল মেসি। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে হাপিত্যেশ করে গেছেন এই এক বিশ্বকাপ নিয়েই। ২০১৫ সালে পঞ্চম ব্যালন ডি’অর জেতার পর বলেছিলেন, সব ব্যালন ডি’অর বিসর্জন দিয়ে হলেও একটা বিশ্বকাপ জিততে চাইতেন। সে সুযোগটা ২০১৪ সালে এসেছিল, সাড়ে আট বছর পর এসেছে আবার।

জিততে পারলে তো কথাই নেই, কোনো এক ‘ফিল গুড’ সিনেমার মতো শেষ হবে তার বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার। আর যদি না হয়, তাহলে সিনেম্যাটিকই হবে তার গল্পটা, শুধু জনরাটা বদলে ‘ফিল গুড’ থেকে ‘ট্র্যাজেডি’ হয়ে যাবে আরকি!

বিশ্বকাপে পোল্যান্ড ম্যাচ ছাড়া এই পর্যন্ত সব ম্যাচেই করেছেন গোল, করিয়েছেনও। তাকে আপাতদৃষ্টিতে থামাতে পারেনি কোনো দলই। তবে তাকে ‘থামানোর’ কাজটাই রীতিমতো একটা প্যারাডক্স হয়ে এসেছে প্রতিপক্ষ কোচদের কাছে। পুরো ম্যাচে যে তেমন কিছুই করেন না তিনি!

বয়স হয়েছে, এখন আর পুরো ম্যাচের ৮০ শতাংশ সময় তাকে দৌড়োতে দেখা যায় না, যে তিন থেকে চার, বড়জোর ৬-৭ মিনিট বল পায়ে থাকে, তাকে ম্যাচে দেখা যায় সে সময়টাতেই। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তাকে কড়া মার্কিংয়ের দায়িত্বটা নাইজেল ডি ইয়ংকে দিয়েছিলেন কোচ লুই ফন হাল। আজ ২০২২ বিশ্বকাপের ফাইনালেও কোচ দিদিয়ের দেশম তেমন কিছু করবেন, তার চেয়ে উগো লরিস বা এমিলিয়ানো মার্টিনেজদের কারো গোল করে নিজ দলকে বিশ্বকাপ জেতানোর সম্ভাবনাটা বেশি। 

প্রতিপক্ষ কোচের জন্য মেসি সবচেয়ে বড় সমস্যাটা সৃষ্টি করেন নিজের অননুমেয় অবস্থান দিয়ে। চলতি বিশ্বকাপে তিনি খেলাটা শুরু করেন দুই ফরোয়ার্ডের একজন হিসেবে, এরপর তাকে কখনো নিচে, কখনো ওপরে, কখনো বাঁয়ে বা কখনো দেখা যায় ডানে, তাই ঠিক কোন খেলোয়াড়টাকে দিয়ে মেসিকে রোখা যাবে, সে প্রশ্নের উত্তরই মেলাতে পারেননি অনেক কোচ। 

তবে গেল বিশ্বকাপে কোচ দেশম মেসিকে রুখেছিলেন ডান পাশে এনগোলো কন্তে আর লুকাস এরনান্দেজকে দিয়ে, পুরো ম্যাচে অবস্থান বদলালেও মেসি বেশিরভাগ সময় থাকেন সেই ডান পাশেই। তাই আজকের ফাইনালেও তাকে সেই ডান পাশের দুই কি তিন খেলোয়াড়, থিও এরনান্দেজ, অরলিয়েঁ চুয়ামেনি, আর আদ্রিয়েন রাবিওদের দিয়েই মার্ক করতে দেখা যাবে ফ্রান্সকে। 

>আর্জেন্টিনার দুশ্চিন্তা এমবাপে

মেসিকে রোখা যেমন আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষের প্রধান চাওয়া থাকে, কিলিয়ান এমবাপেও ফ্রান্সের প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন শেষ কিছু দিনে। মেসির মতো তারও বল পায়ে যে কোনো কিছু করার ক্ষমতা আছে। 

তবে শেষ দুই ম্যাচে তিনি গোল পাননি। এই দুই ম্যাচে তাকে থামানোর দুটো ভিন্ন পন্থাও দেখিয়ে দিয়ে গেছে ইংল্যান্ড আর মরক্কো। ইংলিশরা খানিকটা রক্ষণাত্মক খেলেছে। একটু নিচে থেকে রক্ষণকাজটা সেরেছে। তাই এমবাপে তার শক্তির জায়গাটা, তার গতি ব্যবহার করতে পারেননি। 

ওদিকে মরক্কো তাকে কেবল থামায়ইনি, তাকে ফ্রান্সের ‘দুর্বলতা’ হিসেবেও দেখিয়ে দিয়েছিল রীতিমতো! বল হারালে এমবাপে নিচে নেমে আসেননা। ফলে আশরাফ হাকিমি যখন আক্রমণে উঠে আসছিলেন, তখন থিও এরনান্দেজ রীতিমতো একাই পড়ে যাচ্ছিলেন তাকে সামলাতে!

তবে আর্জেন্টিনা মরক্কোর মতো কোনো এক পদ্ধতি অবলম্বন করবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনুশীলন থেকে জানা গেছে, আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি ফ্রান্সের একগাদা ফরোয়ার্ডকে ঠেকাতে অনুশীলনে ৫ ডিফেন্ডারকে নিয়ে নিজের ৫-৩-২/৩-৫-২ ছকটা বাজিয়ে দেখেছেন, যে ছকে কোয়ার্টার ফাইনালে ঠেকিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসকে। সেটা আভাস দিচ্ছে, মরক্কো নয়, ইংল্যান্ডের রক্ষণাত্মক পথটাই অনুসরণ করতে চলেছে আর্জেন্টিনা। তা হলে আজকের ম্যাচে রাইট সেন্টারব্যাক ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো আর রাইটব্যাক নাহুয়েল মলিনাকে দেখা যাবে এমবাপেকে সামলাতে। 

>ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন ডি পলও!

আর্জেন্টিনা যদি রক্ষণাত্মক অ্যাপ্রোচই নেয়, তাহলে উইং দিয়ে ফ্রান্সকে রোখার সুযোগটা কমে আসবে তাদের। সেটা হলে আর্জেন্টিনার জন্য রদ্রিগো ডি পলের গুরুত্বটা বেড়ে যাবে আরও বেশি। মলিনার সঙ্গে এমবাপেকে পাহাড়ায় রাখা, ফুলব্যাক অবস্থান থেকে থিও এরনান্দেজকে আক্রমণে উঠে আসতে না দেওয়াতে ভূমিকা রাখবেন। এখানেই তার কাজ শেষ নয়, এরনান্দেজের পেছনে যে ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকবে, সেখান দিয়ে মেসিকে আক্রমণের সুযোগ গড়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও বর্তাবে তার কাঁধেই।

>গ্রিজমান-দেম্বেলেকে কী করে রুখবে আর্জেন্টিনা?

মেসিকে রুখে দেওয়া মানেই যেমন আর্জেন্টিনাকে রুখে, ফ্রান্সের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা তেমন নয় মোটেও। এমবাপেকে রুখে দিলেই ফ্রান্সকে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। সেই দলে আছেন একজন গ্রিজমান, যিনি চলতি বিশ্বকাপে প্রতি ম্যাচে গড়ে ৩.৫টি কি পাস দিয়েছেন, মেসির চেয়েও বেশি সুযোগ গড়ে দিয়েছেন, অ্যাসিস্টে আছেন মেসির সমানে, ৩টি করিয়েছেন গোল। এমবাপেকে রুখে দেওয়ার পরও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে জিতেছিল ফ্রান্স, সেটা তো তার অবদানেই! অলিভিয়ের জিরুর গোলটা এসেছিল তার দারুণ এক ক্রস থেকে। বাম পাশে থাকা এনজো ফের্নান্দেজ, অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার কিংবা লিয়ান্দ্রো পারেদেসদের দিয়ে গ্রিজমানকে রোখার একটা চেষ্টা করতে দেখা যাবে আর্জেন্টিনা কোচকে।

তাকে রুখে দিলেও ফ্রান্স দলে আছেন উসমান দেম্বেলে। এমবাপেদের নিয়ে আর্জেন্টিনা যদি বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে উল্টোপাশে দেম্বেলে তার গতি দিয়ে চুরমার করে দিতে পারেন আকাশি-সাদাদের স্বপ্ন। আর তাই আর্জেন্টিনার ভাবনায় তিনিও থাকবেন ভালোভাবেই।

এটি