আর্জেন্টিনার ডাকনাম ‘লা আলবিসেলেস্তে’। কিন্তু শেষ দেড় বছরে সে নামটা অনানুষ্ঠানিকভাবে বদলে গেছে ‘লা স্ক্যালোনেতা’য়। গেল বছর ব্রাজিলের মাটিতে কোপা আমেরিকা যখন চলছিল তখন থেকেই। ২৮ বছরের কোপা আমেরিকা খরা যখন কাটাল আর্জেন্টিনা, তখন তো আরও জোরেশোরেই নামটা পেয়ে বসেছিল মেসি অ্যান্ড কোংকে! 

অন্তর্জাল থেকে শুরু করে আর্জেন্টাইন সংবাদ মাধ্যম পর্যন্ত লিওনেল স্ক্যালোনির দলকে ডাকা শুরু করেছিল এই ডাকনামে। এই নামটা যাকে ঘিরে, সেই লিওনেল স্ক্যালোনির কাছেই এই নামটা বেশ বিদঘুটে, অস্বস্তিকর ঠেকেছে। তবে ভক্ত-সমর্থকটা যখন ডাকছে, কী আর করা!

কেন এমন নাম এলো, তা নিশ্চয়ই আজকের ফাইনালের আগে বুঝে ফেলার কথা আপনার। ২০১৮ সালে তথৈবচ এক বিশ্বকাপ কাটানোর পর পর আনাড়ি তার কাছে ছুটে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা, অর্থাভাবে জর্জরিত আকাশি-সাদাদের যে তার চেয়ে বেশি বেতন দিয়ে কাউকে নেওয়া সম্ভবই ছিল না! দায়িত্ব পেয়ে তিনি শুরু আট মাসে মেসিকে পেলেন না, তবে দলটা গোছাতে শুরু করলেন ঠিকই। পথটা মসৃণ ছিল না। ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারের শুরুতে ব্রাজিল, এরপর ভেনেজুয়েলার কাছে হারে প্রশ্ন উঠেছিল তার ক্ষমতা নিয়ে।

আরও পড়ুন >>> মেসির জাদু না ফরাসি বিপ্লব 

তবে স্ক্যালোনি বিচলিত হননি, আর্জেন্টিনাও নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে টলেনি। ২০১৯ কোপা আমেরিকার আগে মেসি ফিরলেন দলে, তবে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই কলম্বিয়ার কাছে হার। শেষমেশ সেবারও টুর্নামেন্টটা জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের কাছে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বিদায়ঘণ্টা বেজেছিল সেবার। তবে স্ক্যালোনির ওপর ভরসাটা না হারিয়ে বরং বাড়িয়েই দিয়েছিল আকাশি-সাদারা। অন্তর্বর্তীকালীন থেকে পাকাপাকিভাবে আকাশি-সাদাদের কোচের দায়িত্বটা পেয়ে যান তিনি।

 ২০১৮ সালে তথৈবচ এক বিশ্বকাপ কাটানোর পর পর আনাড়ি তার কাছে ছুটে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা, অর্থাভাবে জর্জরিত আকাশি-সাদাদের যে তার চেয়ে বেশি বেতন দিয়ে কাউকে নেওয়া সম্ভবই ছিল না! 

এরপর আর পেছন ফিরে দেখা নয়। করোনাকাল কাটিয়ে মাঠে ফিরে রীতিমতো অজেয় এক আর্জেন্টিনাকে গড়েছেন, একে একে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিল তার দল। ২৮ বছর পর কোপা আমেরিকা জিতেছিল আকাশি-সাদারা, ক্যারিয়ারের প্রায় শেষে মেসি পেয়েছিলেন একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার দেখা। এরপর এ বছর ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিসিমাও জিতল ‘লা স্ক্যালোনেতা’, দক্ষিণ আমেরিকান বাছাই পর্ব থেকে দ্বিতীয় সেরা দল হয়ে এলো বিশ্বকাপে।

তবে কাতার বিশ্বকাপ তাকে স্বাগত জানাল এক চমক দিয়ে। এই লুসাইল স্টেডিয়ামেই সৌদি আরবের কাছে চমকে দেওয়া, আত্মবিশ্বাস টলিয়ে দেওয়ার মতো এক হার সঙ্গী হয়েছিল আকাশি-সাদাদের। তবে সে হার আর যাদেরই হোক, লিওনেল স্ক্যালোনি ও তার দলকে টলিয়ে দিতে পারেনি। 

আরও পড়ুন >>> ফুটবল তারকারা যেভাবে উঠে এসেছেন 

বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনা দলের ঐক্য, দলগত রসায়ন নিয়ে কথা হচ্ছিল বেশ, তবে তার আড়ালে স্ক্যালোনির আর তার কৌশলের ভূমিকাটা যেন ঢাকাই পড়ে যাচ্ছিল। এই বিশ্বকাপে মুন্সিয়ানার চূড়ান্তটাই দেখালেন যেন। প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষ বিচারে ছক বদলে মাঠে নামিয়েছেন দলকে, প্রয়োজনে অর্ধেক একাদশ ছেঁটে ফেলতেও পিছপা হননি, ম্যাচের মাঝের ম্যানেজমেন্টেও ছিলেন দুর্দান্ত। আর্জেন্টিনা যে আজ চলে এসেছে বিশ্বকাপের ফাইনালে, তাতে তার অবদানটা অনেক বড়।

তবে এবার তার জন্য অপেক্ষা করছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা। ফাইনালের মঞ্চটা তো বটেই, ফাইনালের প্রতিপক্ষটাও তার বড় কারণ। শেষ চার বছরের সবচেয়ে ধারাবাহিক ও শক্তিশালী দলটাই যে পড়েছে তার সামনে!

লুসাইল স্টেডিয়ামেই সৌদি আরবের কাছে চমকে দেওয়া, আত্মবিশ্বাস টলিয়ে দেওয়ার মতো এক হার সঙ্গী হয়েছিল আকাশি-সাদাদের। তবে সে হার আর যাদেরই হোক, লিওনেল স্ক্যালোনি ও তার দলকে টলিয়ে দিতে পারেনি...

ফ্রান্স আগের বারও জিতেছে বিশ্বকাপ। তবে শক্তিসামর্থ্যে এবার যেন আগের বারের চেয়েও বেশি পোক্ত মনে হচ্ছে ল্য ব্লুজদের। বিশ্বকাপের আগে কারিম বেনজেমা, ক্রিস্টোফার এনকুকু, তারও আগে গেলবারের বিশ্বজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্য পল পগবা আর এনগোলো কন্তেকে হারানোর পরেও! ফরাসিরা যে এমন পারফর্ম করছে, তার কৃতিত্বের একটা বড় অংশ যাবে কোচ দিদিয়ের দেশমের ভাগে। শেষ চার বছরে তিনি ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ ছাড়াও জিতিয়েছেন নেশন্স লিগের শিরোপাও। তবে তার পথটাও মসৃণ ছিল না। বরং স্ক্যালোনির চেয়ে বন্ধুরই ছিল। 

২০১২ সালের জুলাইয়ে দায়িত্বে এসেছিলেন ফ্রান্সের। ২০১৪ বিশ্বকাপে দলটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে, যদিও তিনি জানিয়েছিলেন, এই বিশ্বকাপ নয়, বরং এর পরের ২০১৮ বিশ্বকাপই তার মূল লক্ষ্য।

আরও পড়ুন >>> ফুটবল : বাঙালির প্রেম, বাঙালির জ্বর! 

সেই লক্ষ্যে বড় একটা ধাক্কা লাগে পরের বছর। জাতীয় দলের সবচেয়ে বড় তারকা কারিম বেনজেমা ঘটিয়ে বসেন বিরাট এক অনর্থ। সতীর্থ ম্যাথিউ ভ্যালবুয়েনার সঙ্গে সেই ‘সেক্সটেপ’ কাণ্ডে তাকে ছেঁটে দেওয়ার বড় সিদ্ধান্তটা নিতে হয় দেশমকে। তবে ২০১৬ ইউরোতে ঠিকই তার দলকে তিনি নিয়ে যান ফাইনালে, সেটাও আবার বেনজেমার মতো তারকাকে ছাড়াই! ২০১৮ বিশ্বকাপে ঠিকই চার বছর আগে দেওয়া কথাটা রাখলেন, ভিন্ন ভূমিকায় দলকে জেতালেন শিরোপা; ১৯৯৮ সালে অধিনায়ক হিসেবে জিতেছিলেন, এবার জিতলেন কোচ হিসেবে।

ফ্রান্স আগের বারও জিতেছে বিশ্বকাপ। তবে শক্তিসামর্থ্যে এবার যেন আগের বারের চেয়েও বেশি পোক্ত মনে হচ্ছে ল্য ব্লুজদের। বিশ্বকাপের আগে কারিম বেনজেমা, ক্রিস্টোফার এনকুকু, তারও আগে গেলবারের বিশ্বজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্য পল পগবা আর এনগোলো কন্তেকে হারানোর পরেও...

গেল বছর সেই অচ্ছ্যুৎ বেনজেমাকে ফেরালেন, যার হাত ধরে নেশন্স লিগের ফাইনালে স্পেনকে হারাল তার দল। তবে বিশ্বকাপের আগে সেই বেনজেমাকে হারালেন। সঙ্গে আরও একগাদা মূল খেলোয়াড়কে পেলেন না। সঙ্গে ছিল খেই হারিয়ে ফেলার ভয়ও। তবে সব শঙ্কা উতরে দলকে আগের মতোই পারফর্ম করিয়েছেন দলকে, ক্ষেত্রবিশেষে আগের চেয়েও ভালো। যারই ফল ফ্রান্সের বিশ্বকাপ ফাইনাল, টানা দ্বিতীয় বারের মতো। এবার তার প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা, আর লিওনেল স্ক্যালোনি।

চলতি বিশ্বকাপে দুই কোচই বেশ কিছু ‘ট্যাকটিকাল মাস্টারক্লাস’ উপহার দিয়েছেন। সেমিফাইনালে স্ক্যালোনি সুকৌশলে ক্রোয়েশিয়াকে দমিয়ে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে কিলিয়ান এমবাপের নিচে না নামার সুযোগ নিয়ে মরক্কো যখন মুহুর্মুহু আক্রমণ শানাচ্ছিল ডান পাশ দিয়ে, তখন মার্কাস থুরামকে এনে এমবাপেকে মাঝে নিয়ে এসে সে পথটাও সিলগালা করে দিয়েছিলেন দেশম। 

আজ লুসাইলে বিশ্বকাপের ফাইনাল, যাতে আছে মহার্ঘ্যের হাতছানি। স্ক্যালোনির সামনে ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনাকে শিরোপা জেতানোর সুযোগ, দেশমের সামনে চলতি শতাব্দিতে টানা দুই বিশ্বকাপ জেতা প্রথম কোচ হওয়ার আশা। এমন এক মহারণে যে নিজেদের মগজাস্ত্রের সেরা ব্যবহারটা করতে চাইবেন দু’জনে, তা বলাই বাহুল্য। তাই লুসাইলে আজকের ফাইনালের আগে মিলছে ধ্রুপদী এক লড়াইয়ের আভাস।

এটি