আর একটাই কাজ বাকি, মেসি!
১৪ জুলাই ২০১৪, এস্তাদিও দে মারাকানা। ম্যাচের বয়স তখন ৪৭ কি ৪৮ মিনিট। জার্মানদের জমাট রক্ষণ ভেঙে আচমকাই লুকাস বিলিয়ার রক্ষণচেরা পাস খুঁজে পেল লিওনেল মেসিকে। মেসি এগোতে থাকলেন, পেছন পেছনে আসতে থাকা জেরোম বোয়াটেং, ম্যাট হামেলসরা এক পর্যায়ে হাল ছেড়েই দিলেন। মেসির শটটা এরপর বেরিয়ে গেল ফারপোস্টের একটু বাইরে দিয়ে।
বিশ্বকাপটা ৮ বছর আগেই জেতা হয়ে যেতে পারত লিওনেল মেসির। সেটা হলে এই বিশ্বকাপে তাকে দেখা যেত কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সেই বিশ্বকাপের আগেই সম্ভাব্য সব অর্জন পায়ে এসে লুটিয়ে পড়েছে তার। মারাকানায় সেদিন যদি বিশ্বকাপটাও জিতে যেতেন, তাহলে সব আফসোস যে সেদিনই ঘুচে যেত তার! তবে সেদিন ঘোচেনি বলেই মেসি মনে মনে নিজেকে বকেছেন বহুবার।
বিজ্ঞাপন
২০১৪ বিশ্বকাপের সেই ফাইনাল হারের পেছনে আর্জেন্টিনার আফসোসের অভাব নেই। গনজালো হিগুয়াইন যদি প্রথমার্ধে টনি ক্রুসের কাছ থেকে পাওয়া উপহারটা ওভাবে পায়ে না ঠেলতেন, রদ্রিগো পালাসিও যদি মার্কোস রোহোর বাড়ানো সেই লং বলটা ওভাবে লক্ষ্যের বাইরে না মেরে দিতেন… সেসবের ভিড়ে মেসির সেই মিসটা নিয়ে আলোচনা কমই হয়।
কিন্তু সেই ফাইনাল থেকে আর্জেন্টাইন মহাতারকার মনে গেঁথে আছে কেবল সেই মিসটাই। আর কারো প্রতি কোনো খেদ নেই। ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে এক সাক্ষাৎকারে বেরিয়ে এসেছিল কথাটা। বলেছিলেন, ‘সেই শটটা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি। আমাকে যদি আরও একবার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো আরেকটু অপেক্ষা করতাম, আরেকটু সময় নিয়ে, পায়ের আরেকটু ভেতরের অংশ থেকে মারতে চাইতাম।’ সেই এক কথাতেই বুঝিয়ে দেন, আর্জেন্টিনা যে দীর্ঘ দিন বিশ্বকাপ জেতেনি, তার শেষ কয়েক বছরের দায়টা মেসি তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধেই। বিষয়টা এখনো বেশ পীড়া দেয় তাকে।
___
‘মেসি বার্সেলোনার হয়েই সেরা, আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি আর দশজনের মতোই একজন’ ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এমন কথা কম শুনতে হয়নি তাকে। সে অপবাদটা মেসি কাটিয়েছিলেন সে বছরই। আর্জেন্টিনাকে তুলেছিলেন ফাইনালে। নিজে করেছিলেন চার গোল, যার প্রথমটায় কাটিয়েছিলেন ৮ বছরের খরা।
সে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা যা গোল করেছিল, তার একটা বাদে বাকি সবক’টাতেই ছিল তার অবদান। তবে চার গোলের সবকটাই এসেছে গ্রুপ পর্বে, তাও আবার বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ইরান আর নাইজেরিয়ার মতো দলের বিপক্ষে। নকআউটে করিয়েছিলেন মোটে এক গোল। সেমিফাইনালে ছিলেন অনেকটা ম্লানই।
তবু সে বিশ্বকাপটাই মেসির ক্যারিয়ারের সেরা বিশ্বকাপ হয়ে ছিল। আগে পরের বিশ্বকাপগুলোয় ভালোই খেলেছেন, দল যে হাসেনি সেভাবে! সেবারই আর্জেন্টিনা ফাইনালে খেলেছিল, মেসি নিজে জিতেছিলেন টুর্নামেন্টের সেরার পুরস্কার। তবে বিশ্বকাপ যখন নেই, তখন এই টুর্নামেন্ট সেরার দাম যে মেসির কাছে কতটুকু, সেটা পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চে তার চেহারাই বলে দিচ্ছিল।
___
সেই মেসি এবার বিশ্বকাপে এলেন চার বিশ্বকাপ মিলিয়ে মোটে ছয় গোল নিয়ে। ক্যারিয়ারজুড়ে যিনি অগুণতি গোল করেছেন, তার নামের পাশে বিশ্বকাপপ্রতি ১.৫ গোলের সংখ্যাটা বেমানান ছিল বৈকি! সেটা ঘোচানোর পণ নিয়েই যেন নামলেন তিনি।
সৌদি আরবের বিপক্ষে তার পেনাল্টির পরও অবশ্য হারল তার দল। তখন মনে হচ্ছিল, আরও একটা বিশ্বকাপ বুঝি হতাশাই উপহার দিতে চলেছে মেসিকে! পরের দুই গ্রুপ ম্যাচে মেক্সিকো, পোল্যান্ডের বিপক্ষে একটু পা হড়কালেই যে সোজা পড়ে যেতে হতো খাদে!
তবে যে দলে মেসি আছেন, খাদের কিনারে দাঁড়িয়েও সেই দলের ভয় কীসের? মেক্সিকো ম্যাচে বক্সের বাইরে থেকে দারুণ এক গোল করলেন, করালেন। পরের ম্যাচটা অবশ্য পেনাল্টি মিস করেছিলেন, তিনি খেলেছিলেন দুর্দান্ত, তবে তার দলই সেরে দিয়েছিল তার মূল কাজটা। গ্রুপ পর্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েই পেরোয় তার দল।
চার বিশ্বকাপ খেলে ফেললেও মেসির নকআউট গোল ছিল না একটিও। সেই বিদঘুটে তথ্যটাকে জাদুঘরে পাঠিয়ে আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করলেন অবিশ্বাস্য এক গোল। বক্সের জটলা থেকে শিল্পিত এক গোলে আর্জেন্টিনাকে পার করে দেন দ্বিতীয় রাউন্ডের বৈতরণী।
কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জাদুটা দেখালেন গোল করিয়ে। চার ডিফেন্ডারের ফাঁক গলিয়ে উল্টো এক পাসে নাহুয়েল মলিনাকে দিয়ে করালেন গোল। এরপর পেনাল্টি থেকে নিজেও করলেন আরও একটা। খেলাটা তবু গেল টাইব্রেকারে, সেখানেও মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রথম গোলটা তিনিই করলেন। দল চলে এল সেমিফাইনালে।
এবার বাঁধা ক্রোয়েশিয়া, চার বছর আগে যাদের কাছে ৩-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে বিদায়ের শঙ্কাই পেয়ে বসেছিল হোর্হে সাম্পাওলির তথৈবচ আর্জেন্টিনাকে। সেই ক্রোয়েশিয়া এবারও এলো দারুণ দাপট নিয়েই। তবে মেসির এক গোলে সে দাপট ভেঙে চুরমার। ইউলিয়ান অ্যালভারেজের আদায় করে দেওয়া পেনাল্টিটা সদম্ভে মারলেন ডান পাশে, ক্রোয়াটদের আগের দুই ম্যাচের ‘বীর’ ডমিনিক লিভাকোভিচ ঠিক দিকে লাফিয়েও যার টিকিটির নাগাল পেলেন না! পরের গোলে রাখলেন অবদান, তবে নামের পাশে অ্যাসিস্টটা যোগ হলো না।
হলো তৃতীয় গোলে এসে। গোল হলেও মেসির জাদু দেখানো যেন বকেয়াই রয়ে গিয়েছিল। সেই বকেয়া মেসি পরিশোধ করলেন দ্বিতীয়ার্ধে এসে। তরুণ ইয়োসকো গেভার্দিওলকে ছিটকে দিতে চেষ্টা করলেন, প্রথমে একটা পিরোয়েট, বারদুয়েক শোল্ডার ড্রপে, এরপরও পারলেন না, শেষতক তাকে নাটমেগ করে হারালেন তাকে, সেই পাস আরও দুই ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিলো। প্রথম গোলটা আদায় করে দিয়েছিলেন যিনি, সেই অ্যালভারেজ পেলেন বলটা, তৃতীয় গোলের সঙ্গে আর্জেন্টিনা পেয়ে গেল ফাইনালের টিকিটও।
এই ম্যাচের জাদু তো আছেই, আগের পাঁচ ম্যাচের পারফর্ম্যান্সসহ মেসির নামের পাশে যোগ হলো ৫ গোল, আর তিন অ্যাসিস্ট। বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুটের দৌড়ে চলে গেলেন কিলিয়ান এমবাপের পাশে, আর সবার চেয়ে এগিয়ে। অ্যাসিস্টের দিক থেকে ছাড়িয়ে গেলেন তাকেও।
গড়লেন অগুণতি রেকর্ডও। ম্যাচে নেমে ছুঁয়ে ফেলেছেন লোথার ম্যাথাউসের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে খেলার রেকর্ড। অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটা ভেঙেই দিয়েছেন। নকআউটে পেলের সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টের রেকর্ডেও বসিয়েছেন ভাগ।
___
এত জাদু দেখিয়ে, এত কিছু করে মেসি পেছনে ফেলেছেন বিশ্বকাপে নিজের সেরা পারফর্ম্যান্সকে, অন্তত সংখ্যাগত দিক থেকে তো বটেই। তবে এরপরও এটাই নিজের সেরা বিশ্বকাপ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ মেসির মনে। সংবাদ সম্মেলনে এসে বললেন, ‘এটাই আমার সেরা বিশ্বকাপ কি না, সেটা বলতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি এখন উপভোগ করছি।’
এত কিছুর পর হয়তো বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলটাও আরও একবার লেখা হয়ে গেছে মেসির নামে, যদি ওপাশে কিলিয়ান এমবাপে কিছু না করে বসেন আরকি! আউটফিল্ডের ব্যক্তিগত ছয় পদকের অন্তত দুটো যে তার নামের পাশে বসে যাচ্ছে, তা অনেকটা নিশ্চিতই।
তবে মেসির মন যে তাতে ভরবে না, তা একরকম বলেই দেওয়া যায়। ক্যারিয়ারজুড়ে তার ব্যক্তিগত শিরোপার অভাব নেই। যে পুরস্কারগুলো সবচেয়ে বেশি সম্মান বয়ে এনেছে তার, সেই ব্যালন ডি’অরের সবগুলো একটা বিশ্বকাপের জন্য বিসর্জন দিয়ে দিতে পারতেন, এমনটা মেসি বলেন প্রায়ই।
সেই বিশ্বকাপ থেকে এখন আর মাত্র এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে মেসি। যা আর্জেন্টিনাকে পাইয়ে দিতে পারলেই কেবল শান্ত হবে মেসির অতৃপ্ত মন। সেটা হয়ে গেলে কেটে যাবে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের বিশ্বকাপ খরাও।
আর একটাই কাজ বাকি, সবচেয়ে মোক্ষম কাজটা। মেসি, আপনি পারবেন তো?