নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ দল। প্রথমবারের মতো জিতেছে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। যুদ্ধজয়ের পর সেই দলের সদস্যরা এখন ফিরে যাচ্ছেন আপন নীড়ে। নিজ নিজ জেলা উষ্ণ সংবর্ধনায় আপন করে নিচ্ছে সাফজয়ী ফুটবলারদের। তার আগে থেকেই অবশ্য নিজ জেলা থেকে শুভেচ্ছার বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন ফুটবলাররা।

তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে সেই দলের সদস্য কুষ্টিয়ার মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন নিলার সঙ্গে। নিজ ডেরায় ফেরেননি এখনো। তবে তার আগে তাকে কেউই ফোন করে শুভেচ্ছা জানাননি। তাতে তার কণ্ঠে আক্ষেপও ঝরে পড়েছে খানিকটা।

সেই জেলারই একজন দেশকে এনে দিয়েছেন এত বড় এক সাফল্য। সেই কুষ্টিয়ার ডিসি, এসপি, এমপি এমনকি ক্রীড়া সংস্থারও কেউ কোনোভাবেই অভিনন্দন জানাননি নিলাকে। তাই আক্ষেপ করে নিলা বললেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হবার পর এবং দেশের ফেরার পর দেখেছি রাঙামাটি, খাগড়াছড়িসহ সাফজয়ী খেলোয়াড়দের বাড়িতে জেলা প্রশাসন, ইউএনও ও ক্রীড়া সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা গিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা ও খোঁজখবর নিয়েছেন। অথচ আমার বাড়িতে কেউ যায়নি। এমনকি আমাকে ফোন করে অভিনন্দন কিংবা শুভেচ্ছা জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। অথচ আমার পাশেই সাফজয়ী (রুমমেটরা) ফোন রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।’ 

এমনটা অবশ্য এবারই প্রথম নয়, জানালেন জাতীয় দলের এই ফুটবলার। তার ভাষ্য, ‘শুধু এবারই নয়, এর আগেও সাফ অনূর্ধ্ব-১৮, ১৯সহ নানা ইভেন্টে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ঢাকাতে বড়বড় লীগ খেলেছি তখনও কোনবারই আমাকে অভিনন্দন জানানো হয়নি। কোনও সংবর্ধনা তো দূরের কথা একটি ফুলের তোড়াও দেয়নি কেউ। আমি সংবর্ধনার জন্য লালায়িত নই, আমাকে তো একটিবার হলেও ফোন দিয়েও অভিনন্দন জানাতে পারত! আমাকে যে ফুলের তোড়াই দেয়া লাগবে, আমাকে যে সংবর্ধনা দেয়া লাগবে, আমাকে যে চেকই দেয়া লাগবে আমিতো সেটাও প্রকাশ করিনি। একটা কল বা ম্যাসেজ দিয়েও তো অভিনন্দন জানানো যেত।’ 

জাতীয় দলের এই ডিফেন্ডার আরও যোগ করেন, ‘এর আগেও অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়ন হবার সময় এই আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলাম, জানি না সেটি কেউ শুনেছিলেন কি না। আমার লক্ষ্য একটাই দেশের লাল সবুজের পতাকাকে বিশ্ব দরবারে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরা।’ 

কুষ্টিয়া পৌরসভার বর্ধিত জুগিয়া সবজি ফার্মপাড়ায় নিলার বাড়ি। আধাপাকা টিনশেড ঘরে তার মা বাছিরন আক্তার আর ছোট বোন সুরভী আক্তারকে নিয়ে তার সংসার। মাঝেমধ্যে তার নানিও থাকে মা-বোনের সাথে। দুই মেয়েই মা বাছিরনের সম্বল। বাছিরনের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। অল্প দিনেই রিকশাচালক স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান।

কুষ্টিয়া শহরের চাঁদ সুলতানা স্কুল থেকে এসএসসির পর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নিলুফার বয়স যখন আড়াই বছর তখন বিচ্ছেদ হয় মা-বাবার। তার ছোট বোনের বয়স তখন মাত্র দেড় মাস। সে সময় যেন অথৈ সাগরে পড়ে যান তাদের মা বাছিরন আক্তার। কিন্তু দমে যাননি তিনি। কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকায় কুঠিপাড়ার চরে মায়ের বাড়িতে ওঠেন। তিনি স্থানীয় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি নেন। সামান্য বেতনে চলতে থাকে সংসার। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দুই মেয়েকে বড় করেছেন বাছিরন। এখন সংসার চলে নিলার অর্থে। 

নিলার মা বাছিরন বলেন, ‘আমার মেয়ে জাতীয় দলের ফুটবলার এটা এলাকার অনেকেই জানতেন না। এমনকি শহরেরও অনেকে জানত না। কিন্তু সাফ নারী ফুটবলে শিরোপা জেতার পর থেকে আমার বাড়িতে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, আমাদের পৌর কাউন্সিলরসহ অনেকেই আসছেন। কিন্তু ডিসি, এসপি, এমপি, ক্রীড়া সংস্থারও কেউ আমাদের অভিনন্দন জানাতে আসেনি। যাই হোক আগে যারা নিলুফাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেতেন, তাদের অনেকে ক্ষমাও চেয়েছেন।’

কুষ্টিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী জানান, ‘নিলার সাফল্যে আমরা কুষ্টিয়াবাসী গর্বিত। সাফজয়ী এই ফুটবলারের পাশে জেলা ক্রীড়া সংস্থা সব সময় থাকবে।’

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানালেন, শিগগিরই নিলাকে সংবর্ধনা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাদের। তিনি বলেন, ‘কুষ্টিয়ার নারী ফুটবলার নিলুফার সাফল্যে আমরা গর্বিত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সম্মামনা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।’ 

রাজু আহমেদ/এনইউ