‘অভিশপ্ত’ জার্সি নম্বর তত্ত্ব নতুন নয়। ফুটবল বিশ্বে এমন অনেক ক্লাবই আছে, যাদের হয়ত একটা বা দুটো জার্সির তথা জার্সি নম্বরের এই বদনাম আছে। বিশ্বখ্যাত ফুটবলাররাও সেই জার্সিগুলো গায়ে চড়ালে মুহূর্তেই নিজেদের ছায়া হয়ে যান। ফর্ম হাতড়ে বেড়ান, হন সমালোচনার বানে বিদ্ধ।

চেলসির ক্ষেত্রে সেই ‘অভিশপ্ত’ জার্সি নম্বরটি কোনো যেনতেন নম্বর নয়, একেবারে নয় নম্বর জার্সি। ফুটবলে সাধারণত দলের মূল স্ট্রাইকাররাই নয় নম্বর জার্সি পরিধান করেন। বিশ্বের বাঘা বাঘা বেশিরভাগ স্ট্রাইকারই এই নম্বরের জার্সি পরে খেলেন। চেলসিতেও এই জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন বিশ্বসেরা সব স্ট্রাইকাররা। তবে ব্লুজদের হয়ে জ্বলে ওঠা তো দূরে থাক, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় কাটিয়েছেন তারা।

নয় নম্বর ‘অভিশাপের’ সর্বশেষ শিকার হলেন বেলজিয়ামের তারকা স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। ইন্টার মিলানের হয়ে দুর্দান্ত দুই মৌসুম কাটিয়ে চেলসিতে এসেছিলেন, অথচ এক মৌসুম পরেই এখন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ছাড়তে মরিয়া তিনি। ১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা দিয়ে দলে আনা এই স্ট্রাইকারকে ছাড়তে চেলসিরও আপত্তি নেই। ইন্টার মিলানের হয়ে যেখানে আগের মৌসুমে ৪০-এর বেশি গোল করেছিলেন, সেই লুকাকু গত মৌসুমে পশ্চিম লন্ডনের ক্লাবটির হয়ে করেছেন মোটে ৮ গোল।

দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে ধারে চেলসি থেকে ইন্টার মিলানে ফিরে গেছেন লুকাকু। চেলসিতে নয় নম্বরের অভিশাপে এর আগে যাদের কপাল পুড়েছিল তাদের ব্যাপারে জেনে নেওয়ার বোধকরি এটাই মোক্ষম সময়।

ক্রিস সাটন (১৯৯৯-২০০০)

১৯৯৯ সালে ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স থেকে ১০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে সাটনকে দলে টেনেছিল চেলসি। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে আসার আগে নরউইচ সিটির হয়ে দারুণ পারফর্ম করেছিলেন, ব্ল্যাকবার্নের হয়ে তো লিগও জিতেছিলেন। 

অথচ চেলসিতে নয় নম্বর জার্সি গায়ে খেলা সাটন ৩৯ ম্যাচ খেলে করেছিলেন মোটে ৩ গোল। বাজে ফর্মের কারণে এক মৌসুম পরেই তাকে স্কটিশ ক্লাব সেল্টিকের কাছে মাত্র ৬ মিলিয়ন পাউন্ডে ছেড়ে দেয় তারা। সেখানে গিয়ে ফের ছন্দ খুঁজে পান এই ইংলিশ স্ট্রাইকার।

মাতেয়া কেজম্যান (২০০৪-২০০৫)

২০০৪-০৫ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ জিতেছিল চেলসি, তবে তাতে দলটির সার্বিয়ান স্ট্রাইকার মাতেয়া কেজম্যানের কোনো অবদান ছিল না। ডাচ কিংবদন্তি স্ট্রাইকার জিমি ফ্লয়েড হেসেলবেইঙ্ক সেই বছরই চেলসি ছাড়ায় মাতেয়া পেয়ে যান নয় নম্বর জার্সি। তবে পূর্বসূরির নাম বা নয় নম্বর জার্সি–কোনটার প্রতিই সুবিচার করতে পারেননি তিনি। ব্লুজদের ২৫ ম্যাচ খেলে করেছিলেন মাত্র ৪ গোল।

খালিদ বুলাহরুজ (২০০৬-২০০৭)

নয় নম্বর জার্সির ‘অভিশাপ’ ভাঙতেই কিনা কে জানে, চেলসি ২০০৬-০৭ মৌসুমে অদ্ভুত এক কাজ করে বসল। স্ট্রাইকারের বদলে এই জার্সি তুলে দিয়েছিল ডাচ ডিফেন্ডার বুলাহরুজের গায়ে। তবে ‘দ্যা ক্যানিবাল’ নামে পরিচিত সেই ডিফেন্ডার বিশেষ কিছুই করতে পারেননি। চেলসি রক্ষণের মানিকজোড় জন টেরি এবং রিকার্ডো কারভালহোদের দাপটে দলে সুযোগ পাওয়াটাই কঠিন ছিল তার জন্য। এছাড়া চোট সমস্যাও চেলসিতে থাকাকালীন সময়ে তাকে ভুগিয়েছে। সবমিলিয়ে চেলসির হয়ে মাত্র ২০ ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।

স্টিভ সিডওয়েল (২০০৭-২০০৮)

তৎকালীন চেলসি কোচ জোসে মরিনিও’র এক ‘অদ্ভুত’ সাইনিং ছিল সিডওয়েল। কারণ দলটির মধ্যমাঠ তখন ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, মাইকে এসিয়েনদের দখলে, তবুও ফ্রি’তে পেয়ে রিডিং থেকে সিডওয়েলকে দলে টেনেছিলেন মরিনিও। শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হয়েছে, সুযোগের অভাবে খুব বেশিদিন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে থাকা হয়নি তার। আর হ্যাঁ, ‘অভিশপ্ত’ নয় নম্বর জার্সিটিও তার ভাগ্যে জুটেছিল।

ফ্রাঙ্কো ডি সান্তো (২০০৮-২০০৯)

সিডওয়েলের বিদায়ের পর আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার ডি সান্তো গায়ে চড়িয়েছিলেন নয় নম্বর জার্সি। ক্লাবের হয়ে এক মৌসুমে মোটে ১৬ ম্যাচ খেলেছেন, যার বেশিরভাগই বদলি হিসেবে। গোলের অনেক চেষ্টা করলেও সাফল্য ধরা দেয়নি।

ফার্নান্দো তোরেস (২০১১-২০১৫)

চেলসির জার্সিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোল করেছেন স্প্যানিশ মহাতারকা ফার্নান্দো তোরেস। ২০১২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সেলোনার বিপক্ষে তার গোলের মাধ্যমেই ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল দলটি। এরপর ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে জিতে নিয়েছিল নিজেদের ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা।

তবে সার্বিকভাবে চেলসিতে ‘জার্সি নাম্বার নাইন’ গায়ে জড়িয়ে খেলা তোরেস খুব একটা জ্বলে উঠতে পারেননি। লিভারপুলের হয়ে যেখানে মাত্র ১৪২ ম্যাচে ৮১ গোল পেয়েছিলেন তোরেস, সেখানে চেলসির জার্সিতে তার গোল ১৭২ ম্যাচে ৪৫।

রাদামেল ফ্যালকাও (২০১৫-২০১৬)

কলম্বিয়ান স্ট্রাইকার ফ্যালকাও অবশ্য বাজে ফর্ম সঙ্গী করেই চেলসিতে এসেছিলেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তার সময় একেবারে ভালো কাটেনি। চেলসিতেও ব্যর্থতার গল্পই লিখেছেন, মাত্র ১২ ম্যাচে ব্লুজদের হয়ে মাঠে নেমেছেন, গোল করেছেন মাত্র ১ টি।

আলভারো মোরাতা (২০১৭-২০১৮)

২০১৭ সালে ৭০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচায় রিয়াল মাদ্রিদ থেকে তারকা স্ট্রাইকার আলভারো মোরাতাকে দলে ভিড়িয়েছিল চেলসি। তবে ফল ওই একই, নয় নম্বর জার্সির ‘অভিশাপেই’ হোক বা অন্য কোনো কারণে, তার জন্য চেলসির শোধ করা চড়া মূল্যের মান রাখতে ব্যর্থ হন তিনি।

প্রথম মৌসুমে মাত্র ১৫ বার বল প্রতিপক্ষের জালে ঠেলতে পেরেছিলেন মোরাতা। এরপর ৯ ছেড়ে ২৯ নম্বর জার্সি গায়ে জড়ান তিনি। তবে তাতে ভাগ্য ফেরা তো দূরের কথা দুর্ভাগ্য আরও জেঁকে বসে। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে করেন মোটে ৫ গোল।

গঞ্জালো হিগুয়েন (২০১৯)

নাপোলর আক্রমণভাগে নিজের সেরা অস্ত্র হিগুয়েনকে চেলসিতে আনার জন্য এক প্রকার আবদারই করে বসেছিলেন দলটির তৎকালীন কোচ মাউরিজিও সারি। নেপলসে তিন বছরে ১৪৬ ম্যাচে ৯১ গোল করেছিলেন এই আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার। তবে চেলসিতে ৯ নম্বর জার্সি গায়ে ব্যর্থ হন তিনিও। ১৯ ম্যাচে  গোল করে ক্লাবে যোগ দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই চেলসিকে বিদায় জানিয়ে জুভেন্টাসে ফেরেন তিনি।

হিগুয়েনের পর চেলসি একাডেমির স্ট্রাইকার ট্যামি আব্রাহামও কিছু সময়ের জন্য পেয়েছিলেন নয় নম্বর জার্সি। তবে ব্লুজদের হয়ে খুব একটা আলো ছড়াতে পারেননি। তবে গত বছর চেলসি ছেড়ে ইতালিয়ান ক্লাব রোমায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই নিয়মিত গোল করছেন, দলের উয়েফা কনফারেন্স লিগ শিরোপা জয়েও অবদান রেখেছেন তিনি।

এইচএমএ