তিনিই কোহলি : পুরোনো সাক্ষাৎকার তাকে চেনাবে নতুন করে
এই সাক্ষাৎকার যখন অনুবাদ শুরু করি, কোহলি তার কিছুক্ষণ আগেই শূন্য রানে সাজঘরে ফিরেছেন। এমন একটা সময়ে, যখন তার লাখো ভক্ত অপেক্ষায় ৭১তম সেঞ্চুরির। কোহলি আরও একবার মাথা নিচু করে সাজঘরের পথ ধরছেন। কবে তিনি ৭১তম সেঞ্চুরি পাবেন? এটা বোধ হয় এখন ক্রিকেটের সবচেয়ে অজানা চর্চিত প্রশ্ন।
অনুবাদ করতে করতে মনে হয়েছে, এটাই বোধ হয় সেরা সময় ছিল। প্রায় সাত বছর আগের সাক্ষাৎকার এখনও একটুও প্রসঙ্গ হারায়নি। কীভাবে কোহলি ভাবেন, সেটা আপনাকে ভাবাবে নিশ্চিত করেই। শচীনের একটা কথা কীভাবে তাকে বদলে দিয়েছে, ধোনিকে তিনি কীভাবে দেখেন, প্রিয়তমা আনুস্কা তখনও কেবল প্রেমিকা; তাদের নিয়ে নিজের ভাবনা জানিয়েছেন কোহলি।
বিজ্ঞাপন
কোহলি কি সত্যিই অহংকারী? তিনি জবাব দিয়েছেন তারও। মিচল জনসনের প্রথম বলে হেলমেটে আঘাত পাওয়ার পর পুরো সিরিজ কীভাবে সাহসের সঙ্গে খেললেন? ব্যথা পেলেও নাকি বলতেন না, এমন কথা বলার সঙ্গে কোহলি জানিয়েছেন আরও নানা কিছু। এক স্টাম্প এগিয়ে আসা তাকে কত সাহায্য করেছে, সেসবও। একটা সাক্ষাৎকার কি মানুষকে চেনাতে পারে? পুরোপুরি না পারলেও কোহলিকে চেনানো এমন কিছু পাওয়া বোধ হয় ভীষণ কঠিন...
ক্রিকেট মান্থলির জন্য নাগরাজ গোল্লাপুদির নেওয়া সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল হাসান বাপ্পি...
রামজি শ্রীনিবাসনের সঙ্গে আপনার একটা গল্প আছে। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে উনি গাড়িতে ছিলেন, ওই গাড়ি চালাচ্ছিলেন আপনি। শ্রীনিবাসনের কার রেসার নারিনের সঙ্গে গাড়িতে চড়ার অভ্যাসও আছে। কিন্তু উনি বলেছেন তার নাকি সেদিন বয়স বেড়ে গিয়েছিল আপনার সঙ্গে গাড়িতে উঠে। যদিও আপনার নিয়ন্ত্রণে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন...
কোহলি : আমি গাড়ি চালাতে ভালোবাসি, গতি তোলাও। গাড়ি আমার পছন্দের। আমার একটা ঘটনার কথা মনে আছে। একবার মাইকেল জেকসনকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি দেখতে যাচ্ছিলাম। ধোনি ও রায়না তখন অন্য একটা গাড়িতে। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, আমরা দিল্লিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলছিলাম তখন।
তো আমরা প্রতিযোগিতা লাগালাম কে আগে সিনেমা হলে যেতে পারে। ওইটা ছিল পাগলাটে একটা অভিজ্ঞতা। এমন কিছু যেটা আমি তখনও করতে চেয়েছি, এখনও চাই। কিন্তু দিনের বেলায় জ্যামের কারণে সুযোগ হয় না গতি তোলার, এজন্য আমি রাতে গাড়ি চালাতে পছন্দ করি।
এত জোরে গাড়ি চালান, সিট বেল্ট কী বাধেন?
কোহলি : অবশ্যই। আমি সবসময় সিল্ট বেল্ট বেধে রাখি। এয়ার ব্যাগ ছাড়া কখনও গাড়ি চালাই না। গাড়ি চালানোর আগে কিছু বিষয় দেখে নেই- আমি কন্টাক্ট লেন্স পরি, দেখে নেই এটা ঠিক আছে নাকি। এসব ছোট ছোট বিষয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত আমাদের মতো দেশে যেখানে কেউ হঠাৎ কোত্থেকে এসে একটা বাজে অবস্থার তৈরি করতে পারে। এজন্য আমি এমন সময় ড্রাইভ পছন্দ করি, যখন রাস্তা একদম ফাঁকা থাকে ও আরামে গাড়ি চালানো যায়।
আপনি নিজের অ্যাপ্রোচ ও খেলার প্রতি একটা আলাদা নিশ্চয়তা রাখেন এখন। এটার উন্নতি কীভাবে করলেন?
কোহলি : আমি সত্যিই জানি না কখন কীভাবে এটার শুরু হলো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক বছর কাটানোর পরই নিজের সামর্থ্যের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে শুরু করি। বলা যায় ২০০৯ সালের দিকে। এর আগে নিজের খেলার ওপর এত বেশি বিশ্বাস ছিল না। বিশেষত ইনিংসের শেষদিকে পুষিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে।
কিন্তু এখন আমি অনুভব করি খেলার শেষদিকে আমার রিকোয়েড রেট অনুযায়ী খেলার সামর্থ্য আছে। এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ দেয় ক্রিজে গিয়ে একই কাজ বারবার করতে- কারণ আমি নিজের খেলার ওপর নির্ভর করতে পারি। ফরম্যাট বা পরিস্থিতি বদলালেও এটা থেকে খুব বেশি সরে আসি না। আমি এমনভাবে ক্রিকেটটা খেলি যেটা সব ফরম্যাট ও পরিস্থিতির সঙ্গেই যায়। নিজের খেলার ওপর আমার আত্মবিশ্বাস ও ভরসা আছে।
কখন এই বিশ্বাসটা আসা শুরু করল যে আপনি একদম সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটটা খেলতে পারবেন?
কোহলি : এই বিশ্বাসটা সত্যিকারার্থে এসেছে ২০০৯ সালের মার্চে কলকাতায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরিটা করার পর। আমার ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা সঠিক পথে চলে আসল আর আমি যে পথে চালাতে চাইতাম সেভাবেই চলা শুরু করল। এটা খুব দারুণ ও ন্যাচারাল প্রসেস ছিল। টেস্টে সুযোগ পাওয়ার আগে তিন বছর ওয়ানডে খেলেছি। ওই সময় আমি খুশি ছিলাম কারণ টেস্টের আলাদা চাপটা নিতে হয়নি।
তার চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল ওয়ানডে ক্যারিয়ারে পুরো নজরটা দিতে পারছিলাম আর এটাতে সম্ভাব্য সেরাটা করার চেষ্টা করছিলাম- ভালো করেছি নাকি খারাপ সেটা সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করি তখনই। এরপর টেস্ট ক্রিকেটে এলাম। শুরু হলো সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। ব্যর্থতা মানে ব্যর্থতাই- হোক সেটা টেস্ট, ওয়ানডে অথবা টি-টোয়েন্টি।
এর আগে আমাকে শুধু ওয়ানডের খারাপ সময় থেকে বের হয়ে আসতে হতো। কিন্তু এখন সব ফরম্যাটেই ভারসম্য ধরে রাখার লড়াই করতে হয়। এটাও নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ আসলো যেন নিজেকে তিন ফরম্যাটেই ধারাবাহিক রাখতে পারি। একজন ক্রিকেটার হিসেবে যাদের আদর্শ মানি-তাদের টেস্ট ও ওয়ানডেতে ভালো করতে দেখেছি। নিজে ক্রিকেটার হয়েও সেটাই করতে চাই।
আমি তিন ফরম্যাটেই ভারতের হয়ে নিয়মিত খেলতে চেয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই তাই টেস্টেও সফল হতে চাই। এটা কিছুটা সময় নিয়েছে। বাড়তি অনেক কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সবকিছু শুরু হয়েছিল, এরপর স্থিতিশীল হলো, তারপর এমন কিছু একটা এলো আবার সব অস্থিতিশীল হয়ে গেল এটা দারুণ অভিজ্ঞতা । অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে কোন কাজটা আমার জন্য সেরা এই ব্যাপারে।
যখন ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেন-আপনাকে অনেক প্রাণবন্ত লাগে। শুরুর দিকে কোন জিনিসটা আপনাকে সিরিয়াস ক্রিকেটে নিয়ে আসলো?
কোহলি : হয়তো আমার বাড়িতে অনেকগুলো খেলনা ছিল কিন্তু আমি ক্রিকেট ব্যাটটাই বেছে নিতাম ছোটবেলায়। আমার পরিবার আমাকে বলেছে যখন আমার তিন বছর বয়স তখন আমি ব্যাট হাতে নিতাম আর বাবাকে বাধ্য করতাম আমাকে বল করতে। সবকিছু মনে নেই, কারণ ওই সব স্মৃতি অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। আমার মনে হয় সহজাত প্রবৃত্তিই ছিল ক্রিকেট। আমি ব্যাট পছন্দ করতাম আর খেলতে চাইতাম এটা দিয়ে।
নিজেকে তো খেলাটার একজন ছাত্র হিসেবেই দেখেন?
কোহলি : হ্যাঁ, আমি খেলাটার একজন ছাত্র। এটা বলব না পৃথিবীর সব খেলা দেখি বা স্কোর; কিন্তু আপনি যদি আমার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে চান- টানা বলে যেতে পারব। পুরো একদিন ক্রিকেট নিয়ে কথা বললেও ফুরাবে না। শুধু মানসিকতা, খেলাটা বুঝতে পারা, অ্যাঙ্গেলগুলো বুঝতে পারা, আলাদা পরিস্থিতিতে খেলা- আমি এসব নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি।
শুধু স্কোর বা পারফরম্যান্সের ব্যাপার না, সাধারণভাবে ক্রিকেট নিয়েই কথা। এটা আমাকে রোমাঞ্চিত করে। অনেকের সঙ্গে আলোচনা করতে ও শিখতে পছন্দ করি- কারণ দিনশেষে এটা আপনাকে নতুন কিছু দেখতে শেখাবে। আমি এমন বিষয় নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি যেটা দুজনকেই সাহায্য করবে।
এটা এমনকি এমন বন্ধুর সঙ্গেও, যে খেলাটা বুঝতে চায় কেবল। মানুষজন জানতে চায় আমি কী ভাবি ৫০ হাজার দর্শকের সামনে যখন খেলতে নামি, আমার মাথায় কী চলে- এটা তাদের জন্য খুব কৌতূহলের বিষয়। কারণ তারা টিভিতে অথবা গ্যালারিতে বসে হয়তো আমার খেলা দেখতে পারে কিন্তু কখনোই পুরো বুঝতে পারবে না আমার মাথায় কী চলে।
চিৎকারগুলো কেমন লাগে যখন খেলতে নামেন?
কোহলি : যদি আপনি কোন ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলেন, আমার মনে হয় না কেউ বলবে তারা দর্শকদের চিৎকার শুনতে পায়। এটা বিস্ময়কর একটা বিষয় কীভাবে ৫০-৬০ হাজার দর্শকের সামনে খেলতে নেমেও আমি বিরক্ত হই না। আমি সবাইকে দেখতে পাই, একদম উন্মুক্ত সেখানে, কিন্তু তবুও আমি দৌড়ে পালিয়ে আসছি না।
এটা আপনার ভাবনায় আনে যে হ্যাঁ, আপনি খেলাটার মধ্যেই আছেন। আপনি এটা করতে পারবেন, আপনাকে দিয়ে সম্ভব। ওই সামর্থ্য বা স্কিল আছে দেখেই ওই রকম অবস্থাতেও পারফর্ম করতে পারছেন কারণ আপনাকে আরও বেশি ফোকাস থাকতে হবে বলের দিকে চারদিকের এতকিছুকে উপেক্ষা করে।
কোচরা বলেন, আপনার কাজ করার প্রক্রিয়াটা নাকি অসাধারণ। এটা গত কয়েক বছর কাজ করে করলেন?
কোহলি : আমি কাজ করি আসলে। এটা বলব না যে পাগলের মতো করি। জীবনের একটা সময় আসে- যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয় মিডিওকর হয়ে থাকবেন নাকি সবসময় শুধু পারফর্ম করবেন অথবা একজন গড়পড়তা ক্রিকেটার হিসেবেই ক্যারিয়ার শেষ করবেন। কিংবা পৃথিবীর সেরা ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টা করবেন, ধারাবাহিকভাবে রান পেতে চাইবেন। যদি ক্যারিয়ারকে আলাদা উচ্চতায় নিতে চান, তাহলে অবশ্যই এমন কিছু করতে হবে যেটা অন্য সবাই করে না। ২০১১ সালের পর থেকে আমি পরেরটা করার সিদ্ধান্ত নেই।
২০১১ সাল পর্যন্ত, আমার কঠিন কোনো কর্মপদ্ধতি ছিল না। হয়তো অনুশীলনে কঠোর পরিশ্রম করতাম, ফিল্ডিং ড্রিল করতাম, ব্যাটিং করতাম। কিন্তু মানসিক অনুশীলন, খাওয়া-দাওয়া, ব্যক্তিগত জীবনে নিয়মানুবর্তীতা, এসব ছিল না তখন। জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে আমার খামখেয়ালিপনা ছিল। এখন রুম সুন্দর করে গুছিয়ে রাখাও নিয়মিত রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। আমার নিজেকে খুঁজে বের করতে হতো কোনটা আমাকে পরের লেভেলে নিয়ে যাবে। কোনটা আমাকে মানসিকভাবে বেশি স্থিতিশীল রাখবে, যেন আমার মতামত, পরামর্শ এসব বিষয়ে মন দিতে না হয়।
এটাই আমাকে ২০১২ আইপিএলের পর তাড়িত করেছে। আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে ছিলাম অস্ট্রেলিয়া সিরিজ ও এশিয়া কাপের সাফল্যে। তখন বল খুব ভালো মারছিলাম, আইপিএল নিয়ে তাই প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। আক্রমণাত্মকভাবে ব্যাটিং করতে চাইছিলাম কিন্তু এটা হচ্ছিল না। এটা মানসিকভাবে আমাকে পীড়া দিলো।
খাওয়ার ও অনুশীলনের অভ্যাসের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি আইপিএলের পর আয়নায় নিজেকে দেখলাম- সত্যিকারার্থেই নিজেকে বললাম- ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হলে তোমাকে এমন দেখালে চলবে না। আলাদা কিছু করতেই হবে।’
এটা বিশ্বাসের ঘাটতি না অন্য কোনো ছোট ভুল...
বিশ্বাস সবসময় ছিল। আমি ভাগ্যবান নিজের সম্পর্কে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ মানুষজন হয়তো বলবে তুমি স্লো হয়ে গেছ, মোটা হয়েছো কিছুটা। কিন্তু তাদের কথায় আপনি কিছুই করবেন যতক্ষণ না নিজে চাইছেন। এছাড়াও ওই সময় আমার ভাবনা ছিল : কেন অন্য দলগুলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত ভালো করেছে, আমরা কেন পারছি না?
কারণও খুঁজে পেলাম। তারা আমাদের চেয়ে বেশি ফিট ছিল। আমাদের চেয়ে ভালো অনুশীলন করতো, ভালো খেত ও লম্বা সময়ের জন্য পরিকল্পনা করতো। তারা একটা রুটিন মেনে চলত যেটা তাদের খেলায় সাহায্য করতো ও মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাস দিতো। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম ঠিক জিনিসটা খাবো, ঠিকভাবে অনুশীলন করবো, আইপিএলের ওই মৌসুমের পরে ৮ মাসের মধ্যে ১১ কেজি ওজন কমিয়েছিলাম।
তখন ওজন কত ছিল?
কোহলি : ৮৪ কেজির মতো, সেটাকে ৭৩ কেজিতে নামিয়ে আনি। আমি তখন বাড়তি আত্মবিশ্বাস পেতে শুরু করলাম- মনে হতো লাগল দ্বিতীয়বার নিজেকে খুঁজে পেয়েছি অথবা আগের চেয়ে এখন দ্বিগুণ দ্রুত কাজ করতে পারি। বলের প্রতি রিয়্যাক্টটা দ্রুত করতে পারতাম এরপর থেকে। নিজের খেলা একেবারেই বদলে ফেললাম। আমার বিশ্বাস ছিল। মেশিনটা তৈরি ছিল কিন্তু এমন ছোটখাটো বিষয় মিসিং ছিল। নিজের রুটিন মেনে চলাটা ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা।
আপনার সতীর্থরা আলাদা করে যে বিষয়টা বলে, নিজের প্রতি বিশ্বাস। একজন বলেছিল, ২০১৪তে ইংল্যান্ড সফরে খারাপ করার পর আপনি নাকি মুখ গোমড়া করে বসেছিলেন। পরে সেটাই আপনাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ভালো করতে শিখিয়েছে...
কোহলি : এটা সত্যি। খুব বেশি মানুষ জানে না অল্প বয়সে আমি কীসের মধ্যে দিয়ে গেছি। হয়তো এজন্যই নিজের প্রতি এত বিশ্বাস। আমার মনে হয় যদি নিজের প্রতি বিশ্বাস না থাকতো, তাহলে এত বছর ক্যারিয়ারটা লম্বা হতো না। এক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে একজন ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ পায়। হয়তো অনেকে আমার চেয়ে বেশি প্রতিভাবান ও স্কিল সম্পূর্ণ আছে। হয়তো আমি ভাগ্যবান। হয়তো একটু বাড়তি ভাগ্য ছিল।
কিন্তু এরপরও আপনার আলাদা করে কিছু জায়গায় উন্নতি করতে হবে। বিশেষত যদি যেটা চান সেটা সত্যিই করতে চান এবং ভারতের হয়ে খেলতে চান। যখন ভারতীয় দলে নিজের নাম লেখালাম, তখন নিজের প্রতি বিশ্বাসটা আরেকটু বাড়াতে শুরু করলাম। খারাপ সময় এসেছে, কিন্তু সেটা সামনে থাকা ভালো সময়ের দিকে তাকাতে শিখিয়েছে। নিজের জীবনের ও ক্যারিয়ারের ভালো সময়ের মূল্যটাও বুঝিয়েছে। খারাপ সময় আসলে সেটাকে সম্মান দেখান, ভেঙে পড়লে চলবে না।
একবার বলেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার একটা জিনিস মেনে চলতেন : নিজের মতো করে চলাটাই মূল...
কোহলি : উনি আমার কাছে মেন্টর। তার সঙ্গে খেলাটা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি। তার মানসিকতা সম্পর্কে জানতে পারাটা অমূল্য। উনি কখনো ‘হবে না’ বলতেন না কারণ যেটা উনার ক্ষেত্রে কাজ করেছে সেটা হয়তো আমার বেলায় করবে না। কারণ আমরা দুজন আলাদা ব্যক্তিত্ব। উনি কখনো বলতেন না করো অথবা করো না।
যখন প্রশ্ন করবেন, মতামত জানতে চাইবেন, তখন উনি কেবল বলবেন নিজে কী করেন। কখনো বলবেন না : এটা তোমার জন্য সঠিক, এটা ভুল। উনার সঙ্গে কথা বলার সৌন্দর্য এই ব্যাপারটা। কারণ উনি জানেন সবাই জানতে চায় তিনি কী করেন। শচীন অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। যদি জীবন কীভাবে বদলায় ও চাপের মুহূর্ত সম্পর্কে জানতে চান, উনার চেয়ে ভালো আর কেউ নেই।
শচীনের সঙ্গে আপনার প্রিয় কথোকথন কোনটা?
কোহলি : মুখের ওপর প্রশংসা করা মানুষদের আমার পছন্দ না। কিন্তু কেউ কেউ আছেন যারা পেছনে দুনিয়ার সব প্রশংসা আপনাকে নিয়ে করবে, আমার তাদের পছন্দ। শচীনের এটা ছিল খুব ভালো লাগার মতো একটা বিষয়। তিনি হয়তো শুধু বলবেন ‘ভালো খেলেছো’। কারণ উনি চান না কেউ অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে যাক। তারা যেন কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যায়, সেটা শচীন চান।
গত বছর ইংল্যান্ড সফর থেকে ফিরে মুম্বাইয়ে আমি ব্যাটিং অনুশীলন করছিলাম, তাকে অনুরোধ জানালাম আসতে কারণ উনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম ব্যাটিং নিয়ে। আর কঠিন সময়ে উনি কী করতেন সেটাও জানার ইচ্ছে হলো। এটাই আসলে গুরুত্বপূর্ণ বেশি ছিল টেকনিক্যাল দিকগুলোর চেয়ে। কীভাবে উনি সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। যখন জীবন বদলে যায়, লোকজন আপনাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করে, বেশি দেখা করতে চায়, উনি এসব কীভাবে সামলাতেন?
একটা ব্যাপার উনি আমাকে বললেন, ‘তোমাকে সবসময় এমন কিছু করতে হবে যেটা তোমার কাজে লাগবে’। যদি ম্যাচের আগে মনে হয় ব্যাটিং করব না নেটে, করো না। অন্যরা আধঘণ্টা ব্যাটিং করে দেখে তোমারও করতে হবে, এমন কারণে কখনো নেটে যাবে না। উনি আমাকে বলেছেন, সবসময় এমন কিছু করতেন যেটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
পুরো ২০০৩ বিশ্বকাপে একবারের জন্যও নেটে ব্যাট করেননি। বল যখন উনার ব্যাটের মাঝখানে লাগতো, ভালো অনুভব করতেন। ওই বিশ্বকাপে যেভাবে খেলেছেন, সবাই জানে কতটা দুর্দান্ত ছিল। এই একটা ব্যাপার উনার কাছে শিখেছি : সবসময় মনের কথাকে অনুসরণ করো। এটা আসলে খেলাটাকে বোঝার ব্যাপার, নিজেকেও।
সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়ের কাছেও এসব ছোট বিষয় গুরুত্বপূর্ণ..
কোহলি : ক্রিকেট বা অন্য যেকোনো খেলাতেই এমন অনেক ছোটখাটো বিষয় ঘটে যেগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে ধরেন, আমি যদি ম্যাচের আগে গিয়ে বলি ‘পাঞ্জাবের একটা গান আমাকে মানসিক স্থিরতা দিয়েছে’, অনেকে হয়তো আমাকে পাগল বলবে। কিন্তু এটা সত্যি। হয়তো অনেক ছোট বিষয় কিন্তু এটা আপনার পুরো অনুভূতিকে বদলে দিতে পারে, হুট করে হয়তো আপনার খুশি খুশি লাগতে শুরু করবে, আর বলতে শুরু করবেন ‘আজকে আমার দিন’।
এসব ছোট বিষয় অনেকে বুঝবে না। কিন্তু এগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে এসব দরকার। বড় ক্যানভাসে না দেখে। পৃথিবীর বাইরে না তাকিয়ে, কোনো নির্দিষ্ট ফলের পেছনে না ছুটেও এসব ছোট বিষয় আপনাকে সেরা অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়া সফরের সাফল্যটা আপনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
কোহলি : ইংল্যান্ড সফরের পর থেকে অনেক হতাশ ছিলাম। নিজের ওপর বেশি চাপ দিচ্ছিলাম। যতটুকু গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল খারাপ করাটা, তার চেয়ে বেশি দিচ্ছিলাম। শুধু ব্যর্থতাকে না, পুরো সিরিজকেই। মনে হচ্ছিল আমার সামনে বিশাল একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে আর ওটাকে মাপতে না পেরে আমি হতাশ। আমার ক্রিকেটটা উপভোগ করতে হতো। যখন ফলটা আমার পক্ষে আসলো না, জিনিসটা বাড়তে শুরু করল। ঠিক মানসিকতার ভেতরেও ছিলাম না। এটা ভালো কোনো অনুভূতি না।
কিন্তু আমি ওই খারাপ সময়টাকে এপ্রিশিয়েট করি। আমার ওই ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। এটাকে এপ্রিশিয়েট করি কারণ আমাকে আরও ভালো মানুষ হতে সাহায্য করেছে। মানসিকভাবে শক্তিশালী করেছে। সম্ভাব্য সব জায়গাতেই এই খারাপ সময় আমাকে সাহায্য করেছে।
এতকিছুর পর অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়াটা আমার জন্য খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মনে আছে ওই সফরে যাওয়ার দুই মাস আগে থেকেই এমন মানসিকতা তৈরির চেষ্টা করছিলাম যেটা অস্ট্রেলিয়াতে দরকার : এটা হচ্ছে পুরোপুরি আক্রমণাত্মক হওয়া। আমি জানতাম উইকেটে গিয়ে এই বোলারদের ওপর চড়াও হবো কারণ এটার কোনো মানে নেই যদি আমি রানের জন্য ভুগতে থাকি। নিজে যেটা চাচ্ছিলাম, সেটার প্রতি সুবিচার করতে চেয়েছি।
শেষ অবধি আমি খুব ইতিবাচকভাবে এটাকে দেখাতে পেরেছি। খুব শক্তভাবে, যখন আমি ক্রিজে গিয়ে আমার শরীর কেবল সেটাই করেছে যেটা আমার মাথা দুই মাস আগেই ঠিক করে রেখেছে। ওটা দল হিসেবেও দারুণ সময় ছিল। কারণ ইংল্যান্ডে যেটা হয়েছে, দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় যেমন খেলেছি, তেমনটাই খেলতে হতো। এটার কোনো মানে নেই আপনি যদি অনেক রান করেন কিন্তু যদি আপনার দল আনন্দের সঙ্গে লড়াই না করতে পারে। পুরো দল অস্ট্রেলিয়াতে যেভাবে খেলেছে, মুগ্ধ হয়েছি।
ভিজ্যাুয়ালাইজেশনের ব্যাপারটা কী একটু ব্যাখ্যা করতে পারবেন?
কোহলি : আগে আমার সহজতা প্রবৃত্তি ছিল। আমি ক্রিজে গেলাম, খেলা শুরু করলাম। হয়তো নিজেকে বলা শুরু করলাম, ‘ঠিক আছে, আজকে বল ভালো ব্যাটে আসছে। তো শট খেলা যায়।’ কিন্তু আমি পরে বের করলাম, পেসারদের বিপক্ষে সব শট খেলতে পারছি না। কিন্তু অন্য ভালো ব্যাটসম্যারা সেটা পারছে। ধরেন, পুল শট। সবাই জানে কীভাবে পুল করতে হয় কিন্তু সবাই কিন্তু এটা করতে পারে না।
মনে আছে একবার শচীন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন উনি আমাকে ২০১১ সালের কেপ টাউন সেঞ্চুরির ব্যাপারে বলছিলেন। বিশেষত মরনি মর্কেলকে খেলা একটা শটের কথা বললেন। তিনি বললেন, দুদিন আগেই মাথায় গেঁথে নিয়েছিলেন ওই শটটা। যখন শটটা খেলার সময় আসলো, তিনি খুব ইতিবাচকভাবে ভাবতে শুরু করলেন, আর শরীর অটোমেটিকভাবেই ওই মাথায় গেঁথে যাওয়া ব্যাপারটা অনুসরণ করল। এসব বিষয় অন্যরা বুঝবে না।
নিজের ব্যাপারেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি সবসময় সেরা বোলারদের মারতে চাইতাম, কারণ ব্যাটসম্যান হিসেবে জানতাম এই বোলাররা আমার ওপর চড়াও হবে। কাউন্টার অ্যাটাক করার চেয়ে ভালো কোনো ডিফেন্স নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় স্টেইন ও অস্ট্রেলিয়ায় জনসনের ব্যাপারে ইতিবাচক থাকার সিদ্ধান্ত নেই, যা কিছুই হোক না কেন। যদি তাদের মারতে পারি, তাহলে আমি লড়াইটা জিতব আর উপরে থাকব।
জোহানেসবার্গে ডেল আমাকে কয়েকটা বাউন্সার মেরেছিল যখন ৩০ রানে ব্যাট করছি। সে চাচ্ছিল আমি যেন পুল করি। এরপর আমি একটা বল ভিজ্যুয়ালাইজড করলাম যেটাতে প্রোপার পুল শট হবে। খেলে ফেললাম, আর চার ফিট জায়গা রেখে ডিপ স্কয়ার লেগকে বিট করলাম। এতটাই জোরে খেলেছিলাম, এতটা পরিষ্কারভাবে। আমি বুঝতে পারলাম : ঠিক এভাবেই শটটাকে কল্পনা করেছিলাম।
আপনি স্টেইন-মরকেলের বিপক্ষে সফল হলেন, জনসনদের বিপক্ষেও। কিন্তু এন্ডারসনের বিপক্ষে পারলেন না। তাদের মধ্যে পার্থক্যটা কী?
কোহলি : এটা অ্যান্ডারসনের চেয়েও বেশি আমার ব্যাপার ছিল। কোনো প্রতি আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল না তারা আমার জন্য যেভাবে পরিকল্পনা করেছে তার বিপরীতে। বড় ব্যাপার ছিল, আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম অ্যান্ডারসন এমন একজন যার বিপক্ষে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। অবশ্যই সে বিশ্ব মানের বোলার। দুদিকে সুইং করাতে পারে, অতীতে অনেক ব্যাটসম্যানকে ভুগিয়েছে। আমার মনে হয়েছে আলাদা পরিকল্পনা দরকার ছিল। আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেও আমাকে একইভাবে আউট করেছে।
এই কারণে আমি যখন অস্ট্রেলিয়ায় গেলাম- ক্রিজ থেকে বেরিয়ে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেই। মিডল স্টাম্পে দাঁড়িয়ে শাফল করে অফ স্ট্যাম্পে চলে আসতাম- কারণ বোলার যদি গুড লেন্থে বলটা ফেলতো তাহলে আমি একটা বাড়তি সুবিধা পেতাম। ড্রাইভটাও করতে পারতাম, কারণ ইতোমধ্যেই আমি ভালো একটা অবস্থানে ছিলাম। ভাবনায় ছিল, এমন কিছু করব না যেটা করে ইংল্যান্ডে আউট হয়েছি।
এমন কোনো সম্ভাবনা কি আছে যে কোনো খেলোয়াড় একগুঁয়ে হয়ে যেতে পারে এমন পরিস্থিতিতে?
কোহলি : আন্তর্জাতিক খেলায় অনেক সম্ভাবনা আছে মানসিকভাবে আপনি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার। আমার চেয়েও বেশি একগুঁয়ে হয়ে যাওয়ার ঘটনা আছে। এটা এমন একটা অবস্থা যখন আপনি প্ল্যান বি নিয়ে ভাবতে পারবেন না। এমনকি যদি কেউ আপনাকে পরামর্শ দেয়, ওই অনুযায়ীও কাজ করতে পারবেন না। এটা মানসিকভাবে আপনাকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দেয়।
আমি অনেক সিনিয়র খেলোয়াড়ের কাছ থেকেও এটা শিখেছি : অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করতে নেই। এটাকে গ্রহণ করতে হবে। দ্বিধায় পড়ার অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করতে যেও না। পরিকল্পনা কাজ না করলে সেটার সঙ্গেও, কারণ এটা আরও বেশি ভোগাতে পারে ভবিষ্যতে।
আপনার সম্পর্কে পড়ে ও মাঠে দেখে মনে হয়েছে অস্ট্রেলিয়াতে একটা বক্সিং ম্যাচ খেলতে গিয়েছেন...
কোহলি : আমি জানতাম এটা কঠিন হবে। জানতাম, অনেক মানসিক লড়াই হবে, বাক্য বিনিময় হবে, অনেক অনেক কথা হবে। উপমহাদেশের খেলোয়াড় ও ভারতীয় হিসেবে, সাধারণ ভাবনা হচ্ছে আমরা ওভাবে কথা বলতে পারবো না। আমি ওই রকম ভাবি না কারণ যদি প্রতিপক্ষ এমন করেও পারফর্ম করতে পারে তাহলে অবশ্যই খেলার সঙ্গে এটার একটা সম্পর্ক আছে।
এটা এমন কিছু না যে সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে কিছু একটা বললাম। এরপর ব্যাট করতে নামার সময় ভাবলাম ‘আমি তো কিছু একটা বলে এসেছি। এখন যদি রান না পাই, তাহলে কী হবে?’ আমার হাতে একটা ব্যাট আছে, আরেকজনের হাতে বল। সে আমার মুখে বল মারতে দৌড়াচ্ছে না। তো, যদি কোনো দল আপনার সঙ্গে মানসিক লড়াইয়ে নামতে চায়, আপনাকেও তাহলে জবাব দিতে হবে। দিনশেষে মাঠে নামলে এটা স্কিলেরই লড়াই যদিও। আমি দুটো মিলিয়ে ফেলি না। মাঠের বাইরে কথার জবাবে কথা বলেছি। প্রতিপক্ষের খেলা মানসিক লড়াইয়ে কেন আমরা ছেড়ে কথা বলব?
অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে আপনি বললেন ভারত আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলবে। এই বার্তাটা দেওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
কোহলি : আমরা আক্রমণাত্মক খেলবো এটা বলাতে কোনো ভুল ছিল না। আমি কখনো বলিনি এই খেলোয়াড়টা আমাদের লক্ষ্য অথবা তারা আমাদের শত্রু। এই বার্তাটা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ খেলোয়াড়দের ও ম্যানেজম্যান্টকে বুঝানো যে যা করতে চাইছি, সেটা করতেই যাচ্ছি। আর অধিনায়ক যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের সমর্থন দেবে।
এটা বুঝানো গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে আমরা সেখানে সিরিজ জিততে যাচ্ছি। আমি মিডিয়ার সামনে এটা বলতে চাইনি যে আমরা গিয়ে খেলবো এরপর যা হবে দেখা যাক। যদি আপনি যথেষ্ট ভালো হন ও ওই স্কিল থাকে, তাহলে আপনি জিততে বা হারতে যাচ্ছেন কোনো প্রতিযোগিতায়। ড্র হচ্ছে একেবারে শেষ বিকল্প। কোনো ম্যাচ জিততে গিয়ে হেরে গেলে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি আক্রমণাত্মক ক্রিকেট দেখতে চেয়েছি দল থেকে।
দলের উদ্দেশ্যে কখন প্রথম অধিনায়ক হিসেবে গেলেন?
কোহলি : টিম হোটেলে ম্যানেজারের রুমে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগে। আমি সবাইকে বলেছি, ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য যাচ্ছি না। এটাও বলেছি, যদি কেউ ভেবে থাকো অস্ট্রেলিয়ায় দুটা সেঞ্চুরি করতে অথবা তিনটা পাঁচ উইকেট নিতে যাচ্ছো, তাহলে এখনই বলো; তার মানসিকতায় বদল দরকার। আমরা অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছি সিরিজ জিততে।
এমনকি যদি ছোট্ট কোনো অবদানও দলকে টেস্ট জেতায়, ওই খেলোয়াড়টাই আমার কাছে ম্যান অব দ্য ম্যাচ। এই ধরনের বার্তা আমাদের দলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হতো। এখানে দলকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হতো। আমরা মাঠেও এমনভাবেই খেলেছি। পুরো সিরিজ যেভাবে খেলেছি খুব স্পষ্ট ছিল সবকিছু। আমরা একসঙ্গে আক্রমণাত্মক ছিলাম।
ব্যক্তিগতভাবে এটা ছিল সবচেয়ে বেশি আনন্দের। কারণ ওখান থেকে চ্যালেঞ্জ জিতে আসতে পারিনি আগে। শেষ অবধি খেলাটা উপভোগ করেছি। সবাই এই ক্রিকেটটাকে পছন্দ করেছে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রাও উপভোগ করেছে। যেটা হয়েছে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বেড়েছে। পুরো বিশ্বের ক্রিকেট কমিউনিটি থেকে সম্মান পেয়েছেন। একবার তারা আরও অভিজ্ঞ হয়ে গেলে, তারা আরও শক্তিশালী হবে।
আনুস্কার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা হয়?
কোহলি : (হাসি)...সে বুঝতে চায়। শিখতে পছন্দ করে। আমার মানসিকতা সম্পর্কে জানতে চায়, ওই মুহূর্তে কী ভাবি সেটাও। যদি খেলার কোনো একটা মুহূর্ত তার ভালো লাগে সে আমাকে জিজ্ঞেস করবে ওই সময় কী ভাবছিলাম। সে বলবে আমাদের কাছে এমন লেগেছে, তোমার কাছে কেমন? আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে ক্রিকেট খুব একটা দেখতো না। কিন্তু এখন খেলাটা বুঝতে অনেক আগ্রহী। কিন্তু সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে কখনো আমাকে জোর করে না ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে। যেটা আমার জন্য ভালো।
ভালো ব্যাপার হচ্ছে আমি নিজের মধ্যে থাকতে পারি ওর সঙ্গে কথা বললে। আবারও বলি, এসব বিষয় লোকজন বুঝে না, ভালো মতো তাকায় না। খেলার বাইরে আপনি কী করছেন সেটা মাঠে করা জিনিসের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলায় আপনাকে পুরোপুরি মনোযোগী থাকতে হাবে। একটা বল কীভাবে খেলবেন, শট খেলবেন, একটা জুটি গড়বেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলবেন; এসব বিষয়ে।
কিন্তু মাঠের বাইরে খেলাটা নিয়ে খুব বেশি ভাবা, একটা নির্দিষ্ট বোলারকে নিয়ে ভাবা, একটা নির্দিষ্ট জয় বা হারকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করতে হবে। এসব থেকে দূরে থাকতে হবে। এটা করার সেরা উপায় হচ্ছে- যার সঙ্গে আপনার একটা আবেগের সম্পর্ক আছে।
বলিউডের সিনেমা নিয়ে কথা হয়?
কোহলি : আমি বুঝতে শুরু করেছি এবং আনুস্কার সঙ্গে বলিউড ও তার কাজ নিয়ে কথা হয়। একটা সিনেমা শেষ করা কতটা কঠিন। দুই-আড়াই ঘণ্টা সিনেমা দেখতে অনেক আনন্দ লাগে, কিন্তু এটা বানাতে কয়েক বছর লেগে যায়। আনুস্কার কাজ থেকে এই একটা জিনিস টের পেলাম- বছরের পর বছর ধরে যে কাজটা করে, সেটা দর্শক দেখে দুই-আড়াই ঘণ্টা। এই কারণে তারা কাজের ব্যাপারে খুবই প্যাশনেট থাকে।
এটা অনেকটা উসাইন বোল্টের ৯ সেকেন্ডের অলিম্পিক দৌড়ের জন্য চার বছর অনুশীলন করার মতো ব্যাপার। আপনি কি ভাবতে পারেন ৯.৫ সেকেন্ডে দৌড়টা শেষ করে তার কতটা আনন্দ লেগেছে চার বছর পরিশ্রম করার পর? বাইরে থেকে আমি কখনোই বুঝতে পারবো না এটার জন্য কত কষ্ট করতে হয়েছে।
কী ধরনের পেশাদারিত্ব অ্যাক্টর, অ্যাথলেটদের দেখাতে হয় ভাবনার বাইরে। এটা দারুণ ব্যাপার কারো মাথায় কী চলছে সেটা বুঝতে পারা। এটা অনেকটা এরকম কাউকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনে তার সম্পর্কে মত দিয়ে দিলেন। পরে সেটা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল যখন তাকে ভালো করে চিনলেন।
এটা নিশ্চয়ই কঠিন আপনাদের দুজনের প্রাইভেসি কম থাকা। আইপিএলের আগে বিশ্বকাপ চলাকালীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ব্যাপারে আপনি কথাও বলেছেন...
কোহলি : আমি কাউকে বাধ্য করছি না আমাদের জীবনকে সম্মান জানাতে অথবা একটা পথ মেনে চলতে। এটা আমাদের হাতে নেই। যদি আপনি ক্রীড়া সংস্কৃতির কথা বলেন, সমর্থকদের ধারাবাহিকভাবে পাশে থাকতে হবে। আপনি যদি খেলোয়াড়দের ধারাবাহিক চান, সমর্থনও ধারাবাহিক হতে হবে। এই ধরনের ঘটনা অনেক মানুষের বিশ্বাস তুলে নেয়। এটাও হয়তো ভালো কারণ কারা আপনার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের তালিকা ছোট করা যায়। আপনি মানসিকভাবে শক্তিশালী হবেন। এমনকি নিজের প্রতিও বিশ্বাস বাড়বে, সম্পর্কের ব্যাপারেও।
কিন্তু ওই ধরনের স্ট্যাটমেন্ট কেন দিলেন?
কোহলি : আমি ওটা দিয়েছিলাম কারণ সবার বোঝা উচিত আমাদের কেমন অনুভূতি হয়। আপনি একজন ক্রিকেটারের মানসিক অবস্থা নিয়ে কথা বলবেন, যখন সে মাঠে খেলে। কেউ জানে না কী ঘটছে। এটা জীবনের প্রতি স্তরে ঘটতে পারে না। যখন কেউ আমার খেলার মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, আনন্দের সঙ্গে উত্তর দেবো। কিন্তু ওইটা প্রশ্ন হতে হবে, অভিযোগ না। কেউ আমাকে অভিযুক্ত করতে পারে না।
যদি আপনাকে মানুষজন এমন ব্যবহার করে যেটা আপনাকে কষ্ট দেয়, তাহলে তাদের বোঝা উচিত আমাদেরও পরিবার আছে, তাদের খারাপ লাগে। আমাদের এমন মানুষ আছে যাদের সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক। আমরা দুনিয়ায় একা থাকি না। আমরা মানুষ, আমাদেরও আবেগ ও অনুভূতি আছে। আমি তাদের বোঝাতে চেয়েছি কতটা খারাপ লেগেছে।
কথা বলবেন নাকি চুপ থাকবেন সেটা আপনার পছন্দ...
কোহলি : এটাই। আমি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ অনেকের ব্যাপারটা বোঝা উচিত। এটা শুধু আমাদের বেলাতেই না, যেখানে আনুস্কা সবকিছুতে অভিযুক্ত হয়েছে। এটা আসলে দেখে দুঃখ লেগেছে মানুষ কীভাবে আচরণ করেছে। এটা জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই। আমাদের দেশের কিছু মানুষ এভাবেই ভাবে, সবকিছুতেই মেয়েদের দোষ দেয়।
আমাদের দেশে এটাই নির্মম বাস্তবতা। অনেক মানুষ চায় না তাদের মেয়ে হোক। কিছু রাজ্যে পুরুষ ও নারীর মধ্যে অনেক বৈষম্য। এজন্যই নারী অধিকারের বিষয়গুলো আসছে। মানুষের এটা বোঝা উচিত যে সঠিকভাবে আচরণ করছে না তারা। কিন্তু যখন এসব হয়, ভেতর থেকে কষ্ট হয়।
রান তাড়া করতে নেমে আপনার ইতোমধ্যেই ১৩ সেঞ্চুরি হয়ে গেছে (৫৬ ইনিংসে), ভারত জিতেছে এমন ওয়ানডে ম্যাচে। টেন্ডুলকারের চেয়ে মাত্র একটা কম, উনার অবশ্য ১২৪ ইনিংস লেগেছে। এটা অসাধারণ কিছু। এই বিষয়ে আপনার ভাবনাটা কী বলবেন?
কোহলি : এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। কখনো আমি গিয়ে প্রথম বল থেকে ইতিবাচক থাকি এবং কখনো কিছুটা সময় নেই। সবকিছু নির্ভর করে নিজেকে কখন প্রস্তুত মনে করছি। কল্পনা করা, যেটা আগেও বলেছি, গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, আমি কোথায় থাকতে চাই ম্যাচশেষে। এটা সবসময় ভালো যদি জানেন আপনাকে কোন জিনিসটা অর্জন করতে হবে।
এমন না যে প্রথম ইনিংসে খেলা পছন্দ করি না। কিন্তু এটা আমাকে আলাদা একটা চ্যালেঞ্জ দেয়। যখন একটা লক্ষ্য থাকবে, মনোযোগটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের থাকে। অনুশীলনেও ব্যাপারটা মাথায় থাকে। যদি জিজ্ঞেস করেন অনুশীলনে রানিং ল্যাপ পছন্দ করি নাকি, আমি বলব করি না। কিন্তু যদি আপনি আমার সামনে একটা ফুটবল দেন, দেখা গেল টানা এক ঘণ্টা দৌড়াচ্ছি। কারণ আমার সামনে লক্ষ্য আছে- গোল করতে হবে।
রান তাড়া করতে গেলে এই ধরনের মানসিকতা থাকে। কারণ আমার সামনে লক্ষ্যটা দেওয়া আছে- হোক সেটা ছোট অথবা বড়। রান তাড়া করার পুরো পরিবেশটাই আমার পছন্দ। নিজেকে পরীক্ষা করতে পছন্দ করি, কীভাবে স্ট্রাইক রোটেট করতে হবে, কখন বাউন্ডারি মারতে হবে। আসলে এই ধরনের অবস্থার জন্যই আপনি ক্রিকেট খেলেন।
মানে লক্ষ্যটাকে ছুঁতে চাওয়াই মূল বিষয়?
কোহলি : অবশ্যই। কোন বোলারকে আক্রমণ করবেন, সেটা নির্ধারণ করতে হবে। ধরেন, যদি কোনো পার্ট টাইমার আসে, খুব গুরুত্বপূর্ণ তাকে সেট হতে না দেওয়া। এই মুহূর্তগুলো খেলায় গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই আপনার সচেতনতার প্রমাণ দিতে হবে। রান তাড়া করতে গেলে অনেক ধরনের চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যেটা ক্রিকেটের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শেখায়।
কোনো একটা ম্যাচের উদাহরণ টেনে কি পরিস্থিতিটা বোঝাতে পারবেন?
কোহলি : ২০১২ সালে হোবার্টের ম্যাচটার কথাই ধরেন। আমরা এটাকে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হিসেবে নিয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি ওয়ানডে অথবা টি-টোয়েন্টি, আপনাকে সেট হয়ে সেরা সুযোগটা দিতে হবে পরে হিট করতে। ওই ইনিংসেও এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৩২১ রান চেজ করতে হবে বলে প্রতি ওভারে ১০-১২ নিতে হবে এমন ভাবিনি। এমনকি আস্কিং রেট নয়ের উপর উঠেনি। আমি যখন ক্রিজে গেলাম ৮৭ রানে ১ (৮৬-২) উইকেট আমাদের শচীন পাজি ও ভিরু ভাইয়ের দারুণ শুরু আনার পর। গম্ভীর ভালো খেলছিল যখন আমি মাঠে নামি। একবার সেট হয়ে যাওয়ার পর হিসাব করে রিস্ক নিয়েছি। প্রোপার ক্রিকেটিং শট খেলেছি।
ধোনি বলেছিলেন, আপনি নাকি যেকোনো জায়গায় মানিয়ে নিতে পারেন কারণ সব জায়গায় একই রকম খেলেন। এটা কি নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থার কারণেই?
কোহলি : আমি তিন ফরম্যাটেই ধারাবাহিক হতে চাই। সবসময় নিজেকে প্রোপার ক্রিকেটিং শট খেলাতে চেয়েছি এবং টি-টোয়েন্টিতে ১৩০-১৪০ স্ট্রাইক রেট রেখে, যেটা করা সম্ভব। কখনো আপনার শেপ ধরে রেখে প্রোপার ক্রিকেটিং শট খেলা স্লগিংয়ে ব্যাট ছুটে যাওয়ার চেয়ে ভালো। এমনকি ছক্কা হলেও, আপনি জানেন বলটা ঠিকভাবে মারতে পারেননি।
স্লগিংয়ের চেয়ে কাভারের ওপর দিয়ে একটা ছক্কা অথবা কাভার ড্রাইভ আমাকে বেশি আনন্দ দেয়। এরপর আপনি জানেন, শেষ সাত-আট বলে আপনি স্লগ করতে পারবেন। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত আমি স্লগ করে নিজেকে নিয়ে হতাশ হতে চাই না। আমি এটা তখন করব যখন রান বের করতে পারবো না অথবা বল ঠিকভাবে ব্যাটে লাগাতে পারবো না। কিন্তু যদি স্ট্রাইক রোটেট করে সহজে রান আসে তাহলে নিজের খেলাকে বদলাবো না।
তিন ফরম্যাটেই আমার ব্যাটিংয়ের মূল বিষয়টা একই থাকে। আপনাকে নিজের ধৈর্যের মাত্রাটাই কেবল বদলাতে হবে : টেস্টে কিছুটা বেশি, শট সিলেকশনে আরেকটু বেশি সতর্ক থাকা। ওয়ানডেতেও কিছুটা ধৈর্য দরকার। টি-টোয়েন্টিতে অবশ্যই আপনাকে বেশি ঝুঁকি নিতে হবে। কিন্তু সেটা আমি সোজা ব্যাটে নিতে পছন্দ করি বোলারকে স্লগ করে অপ্রয়োজনীয় শট খেলার চেয়ে। আমি শেষ পর্যন্ত থাকতে চাই ইনিংসের যেন দলকে সাফল্য এনে দেওয়ার সম্ভাবনার ভেতর থাকতে পারি। আমি দায়িত্ব নেওয়া পছন্দ করি।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের কোনো প্রভাব কি আপনার খেলায় আছে?
কোহলি : হয়তো আছে। আপনি যদি রোহিতকে দেখেন, এটা পাগলাটে। সেট হয়ে যাওয়ার পর কাউকে তার মতো ভয়ঙ্কর হতে দেখি না। অনেক ভালো ফিনিশার আছে কিন্তু রোহিত সেট হলে তাকে থামানো অসম্ভব। ফিফটি করার পর সে যেভাবে মারে, দুর্দান্ত। যদি আপনি দেখেন যে ৪ ওভার হাতে রেখে রোহিত ৫০ করে ফেলেছে, বুঝতে হবে বিপদে আছেন। তখন নিজেকে বাঁচানোর কথা ভাবা শুরু করা উচিত আপনার। আমি মজা করছি না। ডট বল প্রায় অসম্ভব তখন।
ওয়ানডেতে তার দুইটা ডাবল সেঞ্চুরি আছে। আপনি কি টি-টোয়েন্টি থেকে অনুপ্রেরণা ছাড়া এই ধরনের ইনিংসের কথা ভাবতে পারেন? বুঝতে পারেন ২০ ওভারের সঙ্গে বাকি ৩০ ওভারও তারা একইভাবে খেলছে? এটার সবকিছুই আসলে টি-টোয়েন্টি থেকে পাওয়া মানসিকতার ফল।
যখন বাচ্চা বয়সে ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখবেন। আইপিএলে এসে ডেল স্টেইন, মরনি মর্কেল, জনসন, স্টার্কের মতো বোলারকে খেলবেন। এটা আপনাকে অনেক বিশ্বাস দেবে। আমিও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে একই রকম বিশ্বাস পেয়েছি। জয়পুরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫২ বলে সেঞ্চুরি করে ফেলা অনেক রান তাড়া করতে নেমে। আমি ইতিবাচক খেলার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলাম। দ্বিতীয় কোনো ভাবনা ছিল না। কোনো নেতিবাচকতা না, কোনো সন্দেহ না। প্রোপার ক্রিকেটিং শটের সঙ্গে দৃঢ় বিশ্বাস।
আপনার প্রিয় শট কোনটা?
কোহলি : কাভার ড্রাইভ। পেসারদের এই শট খেলার চেয়ে ভালো অনুভূতি আর কোনো কিছুতে নেই। মাথাটা সামনে এনে, উঁচিয়ে, কনুইটাকে তুলে কাভার ড্রাইভ মারা- ব্যাটসম্যানের জন্য এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই। অবশ্যই ফ্লিক শটও প্রকৃতিগতভাবেই ভালো খেলি কিন্তু কাভার ড্রাইভ ভালোবাসি।
কাউকে দেখে কাভার ড্রাইভ খেলা শুরু করেছিলেন নাকি?
কোহলি : এটা খুব মজার বিষয় কীভাবে সময়ের সঙ্গে খেলায় উন্নতি করেছি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতেও আমি ততটা আগাতাম না। কিন্তু এবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ১৫০ গতিতে বল করা বোলারদের বিপক্ষেও এগিয়ে গিয়ে কাভার ড্রাইভ খেলেছি। রিকি পন্টিং, শচীন, জ্যাক ক্যালিস, দ্রাবিড়দের দেখতে পছন্দ করতাম। আর ভাবতাম কীভাবে এত ভালো বোলারদের বিপক্ষে তারা এগিয়ে যায়। আমি এখন খুঁজে পেয়েছি এটা আত্মবিশ্বাসের ব্যাপার কেবল। ওই সময়টাতে কী অনুভব করছেন তার ব্যাপার। আমি কেবল নিজেকে ওই শটগুলোতে কল্পনা করি।
বটম হ্যান্ড গ্রিফটা কোথায় পেলেন?
কোহলি : এটার কারণ ছোটবেলায় ম্যাট উইকেটে প্রচুর খেলেছি। সেখানে খুব বাউন্সার থাকে। অনেক বল কাট অথবা পুল করতে হয়। ওখানে বটম হ্যান্ডটা দরকার। এটা এখন শট বল খেলতে আমাকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেয়। আমার কখনো মনে হয়নি এটা বদলানো দরকার, কারণ আমার খেলাটা শক্তি নির্ভর, ভালো গতিতে ব্যাট চালানো আর নিজের হাতকে বিশ্বাস করারও।
কখনো নিজের গ্রিফ বদলাইনি কারণ এটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সময়ের সঙ্গে শিখেছি কোন হাতটা সুইচ করতে হবে। এখন এক ধরনের হাতল ব্যবহার করি- ডিম্বাকৃতির হাতল যেটা আপনার বুড়ো আঙুল এবং তর্জনীর মধ্যে আটকে থাকে। এটাতে ভালো অনুভব করি আর ভালো গ্রিফও। এটা আমাকে আগেভাগেই সোজা খেলতে ও বাঁ হাতটা ব্যবহার করতে সাহায্য করে।
রাউন্ড হাতলে আমি অনেক বেশি অ্যাক্রোসে চলে যেতাম কিন্তু এখন ব্যাট ধরায় বাড়তি জায়গা পাই। শেষের ওভারগুলোতেও যদি বোলারদের ওপর চড়াও হতে হয়, বটম হ্যান্ডই ব্যবহার করি।
অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ক্রিজ থেকে কিছুটা বেরিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। এটা কি আপনার খেলার একেবারেই নতুন কিছু?
কোহলি : যেমনটা বলেছি, ইংল্যান্ডে আউট হওয়ার পর কিছুই করিনি। আমি জানতাম অস্ট্রেলিয়ার উইকেটগুলো বাউন্সি হবে, গতি থাকবে। জানতাম অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা আমাকে ওই জায়গাটায় টার্গেট করবে। তাই সেটা আমি ঢেকে দিয়েছি। গতিতে আমার সমস্যা নেই, বাউন্সেও। শর্ট বল পছন্দ করি। এটা নিয়ে খুব বেশি ভাবিনি। তো এটাই পরিকল্পনা ছিল, প্রতিপক্ষ বল করার আগেই আপনি ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেন বলের জন্য ছুটার চেয়ে এটা ভালো।
এটা খুব সুন্দরভাবে আমার জন্য কাজে লাগল। অন সাইডে কিছুটা কাজ করতে হতো। অন দ্য রাইজেও বাউন্ডারি মারতে পারছিলাম, কারণ আমি ইতোমধ্যেই ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আমি বের করেছি, ৮০ শতাংশ বোলার ফোর্থ স্টাম্পে গুড লেন্থে বল করে ৯০ শতাংশ সময়। তো নিজেকে বললাম, ‘কেন বলের পেছনে ছুটবো’। উল্টো তাদের ভাবনায় ফেলি প্যাডে বল করতে। ওটা আমার শক্তির জায়গা। আমার হয়েই কাজ করেছে।
ওই সিরিজের প্রথম বলেই জনসন আপনার হেলমেটে আঘাত করল। এরপরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফ্লুয়েন্টলি খেললেন, বিশেষত শর্ট বলে...
কোহলি : আমি নিজেকে নিয়ে কিছুটা হতাশ ছিলাম প্রথম বলই হেলমেটে লাগায়। এটা হয়েছে কারণ ড্রেসিং রুমের ছায়া পড়ছিল, খুব রোদ ছিল আর উইকেটও চকচকে ছিল। এক ওভার পরই বোধ হয় লাঞ্চে গেলাম। প্রথম বল যেটা করেছিল, আমি ভেবেছি শর্ট বল। কিন্তু এটা অর্ধেকের বেশি ভেতরে পড়েছিল। বলটা বাউন্স করেনি। এটা আমার দিকে আসছিল আর আমি মাথা নামাচ্ছিলাম। সৌভাগ্যবশত খুব বেশি লাগেনি। তবে হেলমেটে লাগার পর হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
সবাই এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল ঠিক আছি কি না। আমি যদি ঠিক নাও থাকতাম, মাঠে মিথ্যা বলতাম। কারণ কাউকে দেখাতে চাই না আমি কষ্টে আছি। এখানে আপনি একা ব্যাট করতে নেমেছেন। আঘাত আপনাকে একাই সহ্য করতে হবে। ভাগ্য ভালো প্রথম বল হিট করেছিল হেলমেটে। এটা আমার চোখ খুলে দেয় ও আরও মনোযোগী করে। আমি এরপর সিদ্ধান্ত নেই, সে শর্ট বল করলেই মারবো। বসে পড়ব না।
অহংকারের প্রভাব আপনার ভাবনায় কেমন?
কোহলি : এটা অহংকার না। এটা অনেকটা বিশ্বাস যে আপনি করতে পারেন। আমি জানতাম জনসনকে যদি দলের সবাই মিলে মারতে পারি, এটা বোস্ট হবে আমাদের জন্য। কারণ ইংল্যান্ডকে সে পর্যুদস্ত করেছিল। সে দৌড়ালে দর্শকরা তার পেছনে থাকে। এসব বিষয় ক্রিকেটারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে সঠিক পথে আসতে হবে এবং চ্যালেঞ্জ উতরাতে হবে। কারণ আমি প্রথম টেস্টে প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম, আমি এটা করার সিদ্ধান্ত নেই। এটা দলের বিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে, অন্য ব্যাটসম্যান গিয়েও বলতে পারবে ‘আমরা তাকে মারতে পারি। যখন এটা করতে পারলাম, সিরিজটা ভারসম্যপূর্ণ হলো। প্রতি ম্যাচেই ৪০০,৫০০ রান করতে শুরু করলাম। একটা দুটা ভালো সেশন ওই সিরিজগুলোতে অন্য গল্প লিখতে পারতো।
আমি খুঁজে বের করেছি অন্য দলগুলো নির্দিষ্ট সেশন ডমিনেট করে ম্যাচ জেতে। আমাদের শেখানো হয় অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দিতে এবং ঠিকভাবে খেলতে, এতে আমাদের রান তোলায় ধীরগতি আসে। অন্য দলগুলো এগিয়ে গেছে। তারা আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে। সেশন ডমিনেট করে। প্রতি সেশনে ১৫০ এর বেশি রান করে। তাই আমি ভেবেছি কেন আমরা আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলবো না।
রবি শাস্ত্রীর ভূমিকা আছে কোনো?
কোহলি : তিনিই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন অফ স্টাম্পের কাছাকাছি দাঁড়াতে। শুরুতে আমি দ্বিধায় ছিলাম। ভেবেছি এটা হয়তো স্টাম্পগুলো দেখিয়ে দেবে। উনি বলল, ‘আমাকে বিশ্বাস করো’। ইংল্যান্ডে এটা করিনি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে এটা নিয়ে ভাবলাম। আর বললাম কেন নয়, আমি এভাবে খেলব।
আমি বসে বসে অন্যদের আমাকে ডমিনেট করা দেখতে পারবো না। এটা খুব সুন্দরভাবে হয়ে গেল। তার প্রতি কৃতজ্ঞ আমাকে ক্রমাগত বলে যাওয়ায়। সে এমন একজন যে দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যায় না। সামনে তাকায়। তার ভাবনার দুটা দিক আছে। কোন কথা না শুধু যা হচ্ছে হোক। সে সেন্সেবল, আপনাকে অনেক আত্মবিশ্বাস দেবে ও নিশ্চয়তা। তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে আপনি এটাই চাইবেন। সে এমন একজন যে ১১ নম্বর হিসেবে শুরু করে ওপেনার হিসেবে ১০-১১ বছর ধরে ওপেনার হিসেবে সেঞ্চুরি করেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। আপনি জানেন এই ধরনের সাফল্যের জন্য কেমন মানসিকতা দরকার।
গেরি কারস্টেন ও ডুসান ফ্লেচারকে নিয়ে কিছু বলবেন?
কোহলি : আমাকে মানসিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য তৈরি করতে গ্যারির ভূমিকা অনেক। সে আমাকে সমর্থন দিয়ে গেছে। আমার মনে আছে বাঁ পা অনেক আড়াআড়ি হয়ে যাচ্ছিল ফ্লিক করতে গিয়ে, এটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি কোনো সমস্যা? উনি আমাকে বলল, ‘তোমার মাথা পা থেকে অনেক এগিয়ে থাকে আর তুমি কখনো বল মিস করো না। তো কেন চিন্তিত হচ্ছো?’
এমনকি যদি সে ভাবেও আপনার দুর্বলতা আছে। শক্তির জায়গাটা মনে করিয়ে দেবে। আর ডুসান, খেলাটার সম্পর্কে তার যে জ্ঞান, এমন খুব কম মানুষকে দেখেছি। খুব ছোট বিষয়ও ব্যাটিং, টেকনিকের বিষয়ে সে পয়েন্ট আউট করবে আর কাজ করবে।
আপনি বলেছেন, ধোনির সমর্থন পেয়েছেন। তার সমালোচকরা বলে, তিনি নাকি কোনো লেগেসি রেখে যেতে পারেননি টেস্টে...
কোহলি : আমি জানি না তারা কেন বলে। সে ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। এটাই একটা লেগেসি। দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড় তার সমর্থন পেয়েছে। সে তরুণদের ওপর বিশ্বাস রেখেছে। তাদের সুযোগ দিয়েছে। যদি তার প্যাটার্ন দেখেন, একই রকম একাদশ খেলাতে পছন্দ করতো কারণ তাদের বেড়ে উঠে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার সময় দিতে চাইতো।
যে খেলোয়াড়টা সুযোগ পায়নি, তাদের অন্য সিরিজে দিয়েছে। সঙ্গে রেখে ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য চেষ্টা করেছে। আমাদের ক্যারিয়ারের শুরুর উন্নতিতে সে অনেক ভূমিকা রেখেছে। সে ভারতীয় ক্রিকেটে যা করেছে, এর চেয়ে ভালো কিছু করা কঠিন। সে শুরুর দিকে সিনিয়রদের আর শেষে তরুণদের যেভাবে সামলেছে, অবিশ্বাস্য। কখনো তরুণদের ওপর ছড়ি ঘুরায়নি।
কেউ কেউ বলেন, আপনার সেট আপ নিয়ে ভাবনা আছে। এটার কি একটা ধারণা দিতে পারবেন?
কোহলি : আমি শক্ত বন্ধন তৈরি করতে চাই। দলের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি করতেও। বছরে ২৫০-২৮০ দিন আমরা একসঙ্গে থাকি, তো আমি এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে চাই যেটাতে ভেতরে ও বাইরে থেকে মনে হবে এরা ঐক্যবদ্ধ। তারা একে-অপরের জন্য খেলে। এটাই আমার লক্ষ্য। আমি চাই ভারতীয় দল অন্তত পাঁচ-ছয় বছর ডমিনেট করবে ক্রিকেট। আমাদের ওই সামর্থ্য আছে। এখন আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে।
আমি চাই সবার টেস্ট ক্যারিয়ার একসঙ্গে বেড়ে উঠুক। যদি আপনি বন্ধুত্ব, কম্বিনেশন, ইউনিটি, এনার্জির কথা বলেন; সফল অস্ট্রেলিয়া দলের দিকে দেখেন। বেশির ভাগই একসঙ্গে ক্যারিয়ার শুরু করেছে, আট থেকে নয়জন কিংবদন্তি হয়েছে। দল হিসেবে একে অপরের সাফল্য উদযাপন করতে হবে, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে খেলা উপভোগ করতে হবে, ব্যর্থতায় আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমি এসব দেখতে চাই দলে। আমি নিশ্চিত এসব হবে।
এমএইচ