প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছেন জুলিয়ান রস উড। সিলেট সানরাইজার্সের ব্যাটিং কোচ হয়ে আসলেও তার নামের পাশে বসে আছে ‘পাওয়ার হিটিং’ কোচের তকমা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব নিতে এসে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির খুব বেশি সুযোগ পাননি। বিসিবি থেকে প্রস্তাব পেলে ভিন্ন কৌশলে কাজ করতে চান টাইগার ব্যাটসম্যানদের পাওয়ার হিটিং স্কিল উন্নয়নে। পাওয়ার হিটিংয়ে কোথায় পিছিয়ে বাংলাদেশ, কীভাবে আসতে পারে সাফল্য, ঢাকা পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেসব কথা।

প্রশ্ন: প্রথমবার বাংলাদেশে এসে সময়টা কেমন উপভোগ করছেন?

উড: অবশ্যই আমার ভালো লাগছে। যেমনটি বললেন যে এখানে আমি প্রথম। আমি বলব বাংলাদেশে প্রতিভার অভাব নেই, কিন্তু তাদের গড়ে তুলতে হবে, কঠিন চাপের মুহূর্তে সামনে আসতে হবে। এই বিপিএল এখানকার ক্রিকেটারদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা যত বেশি এমন টুর্নামেন্টে খেলবে তাদের জন্য ভালো। এটা ওদের জন্য একটা শর্ট উইন্ডো, বিশ্বে এখন সব জায়গাতেই টি-টোয়েন্টি লিগ হচ্ছে। ওদের জন্য এই বিপিএল, লিগগুলো সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। 

প্রশ্ন: শুধুমাত্র পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য যে আলাদা কোচ থাকতে পারে, এই ভাবনাটা আপনার মাথায় আসলো কিভাবে?

উড: গত ১০ বছর ধরেই এই টার্মটা ব্যাবহার হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি যে ক্রিকেট কোথায় যাচ্ছে সেটা আমি অন্য যে কারো আগে বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ, দেখলাম যে ২০ ওভারের ফরম্যাটে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এই পাওয়ার হিটিংয়ে। আমি অনেকটা সময় টেক্সাস রেঞ্জার্স দলের সঙ্গে কাটিয়েছি। ওটা মেজর বেসবল দল। ওরা যেভাবে ব্যাট করে, আপনারা জানেন যে বেসবলে খুব জোরে বল মারতে হয়। সে বিষয়টা আর বল মারার যে টেকনিক ওরা কাজে লাগাায় সেই সঙ্গে মাইন্ডসেট, দাঁড়ানোর স্টাইল এ জিনিসগুলো আমি ক্রিকেটে নিয়ে এসেছি। কিন্তু একটা বিষয় হলো আপনি চাইলেই ছয়ের পর ছয় মারতে পারবেন না, কিন্তু প্রতিটা বল কাজে লাগাতে পারবেন। আমি এভাবে কাজ করছি।

প্রশ্ন: পাওয়ার হিটিং ব্যাপারটি পেশিবহুল নাকি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার?

উড: প্রথমত মাইন্ডসেট। আর গেইল, পোলার্ড, রাসেলদের মতো মাসলম্যানরা তাদের শক্তি কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু এখানে আসার পর আমি যা দেখছি যে স্থানীয় ক্রিকেটাররা সবাই পাওয়ার হিটার হতে চায়। এখানে তাদের দোষ নেই, এটা তাদের বোঝার ভুল। আমি ওদের বুঝিয়েছি যে তোমরা ৬ ফুট উচ্চতার বা ১০০ কেজির নও, তোমরা বড়জোড় ৫ ফুট ৮ এবং ৭৫ কেজির। তোমাদের পাওয়ারহিটিংটা করতে হবে ভিন্নভাবে। শরীর বুঝতে হবে আগে, সেই অনুযায়ী তোমাকে টাইমিং আর রিদমকে কাজে লাগাতে হবে।

প্রশ্ন: শুধু কী অনুশীলন করেই পাওয়ার হিটিংয়ে সফলতা পাওয়া সম্ভব?

উড: ব্যাপারটা হল যত বেশি অনুশীলন করবেন, ততই ভালো করবেন। একদিনে এটা সম্ভব নয়। এখানে আমাকে পাওয়ার হিটিং নিয়ে কাজ করার বাইরে সিলেট সানরাইজার্স ক্রিকেটারদের অনুশীলন পদ্ধতিও শেখাতে হচ্ছে যেন আমি চলে গেলেও তারা পদ্ধতিগুলো কাজে লাগাতে পারে ও উন্নতি করতে পারে।

প্রশ্ন: শুনেছি আপনি বেশ বৈচিত্র্যময় অনুশীলন করান?

উড: হ্যাঁ, আমি অনেক অনুশীলন পদ্ধতি ব্যাবহার করি। ভারি বল-ব্যাটের পাশাপাশি আমি বাঞ্জিও ব্যাবহার করি। আমি টেকনিকের ব্যাবহারটা বেশি কাজে লাগাই। যে কারো হ্যান্ড স্পিড আমি ১০ মিনিটেই বাড়িয়ে দিতে পারব, টেকনিক যোগ বা পরিবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু আগে আপনাকে টেকনিকটা বুঝতে হবে। যখন আপনি ব্যাট করবেন আপনাকে মাথা কাজে লাগাতে হবে, আর যখন হিট করবেন আপনাকে কোমর কাজে লাগাতে হবে, এরকম জিনিসগুলো বুঝতে হবে। এমন বিভিন্ন দিক আছে। এরপরে আমি আরো টেকনিকের ব্যাবহার বাড়াতে পারব। যেমন চিকন ব্যাট দিয়ে হালকা-ভারি বল ব্যবহার করা। ভারি বলটা বেশি কাজে দেয়। এই ভিন্ন ভিন্ন দিকগুলো ক্রিকেটারদেরও ভালো লাগে। কারণ এগুলো তাদের জন্য নতুন।

প্রশ্ন: পাওয়ার হিটিং ডেভেলপমেন্টের জন্য আপনি ঠিক কেমন কৌশল ব্যবহার করেন?

উড: বেসবল তো আছেই, এর পাশাপাশি আইরিশ একটা খেলা আছে হারলিং, ওটা কাজে লাগাই। হারলিং স্টিক খুব চিকন হয়। এটা দিয়ে অনুশীলন করলে আপনার কবজির শক্তি কাজে লাগানোর অভ্যাস হয়। যেমনটা ব্যাট হাতে ব্যাকফুট পাঞ্চ করেন কবজির জোরে, ওইরকম। আপনারা জানেন জস বাটলার কবজির জোরে বল মারার জন্য স্বীকৃত। এই ক্ষেত্রে কবজিতে অনেক জোর রাখতে হয়। হারলিং স্টিকে সেই কাজটা আমি ক্রিকেটারদের শেখাই। এছাড়া আরো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু প্রথমত আপনাকে মাইন্ডসেট ঠিক করতে হবে এবং পাওয়ার হিটিংয়ের বিষয়টা বুঝতে হবে। আপনার মাইন্ডসেট যদি রক্ষণাত্মক হয়ে যায় তবে আপনার পক্ষে পাওয়ার হিটিং সম্ভব নয়।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শারীরিক গঠন তো খুব শক্তপোক্ত নয়। এই জাতীয় ক্রিকেটাররা পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য কতটা কার্যকরী বা তাদের পুরোদস্তর পাওয়ার হিটার বানানো সম্ভব?

উড: এর জন্য আপনাকে স্মার্ট হতে হবে। এটাই আমি দুই সপ্তাহ আগে যখন শুরু করি ওদের বোঝাতে চেয়েছি, বলেছি। ওরা তো সবাই গেইল-রাসেল হতে চায়। আমি ওদের বলেছি যে যদি তোমরা ৭০ বল ফেস করো তাহলে কয়টা ৬ মারতে পারবে? তারা বলল ২-৩ টা। আমি বললাম মাত্র ২-৩টা, তাহলে তোমাদের হাতে আরো ৫০ বল থাকবে। এই বলগুলো তোমাকে খেলতে হবে। লোকাল ক্রিকেটাররা শুধু লেগ সাইডেই খেলছে। কিন্তু ওরা যাদের মতো হতে চায় তারা তো পরীক্ষিত ক্রিকেটার। ওদের মতো হতে চাইলে উইকেটের দুই পাশে মারতে হবে। তখন স্কিল, টাচ, পাওয়ারের মিশ্রণ করতে হবে। এটার জন্য অনেকদিনের অনুশীলন প্রয়োজন। 

প্রশ্ন: আলোচনা চলছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও পাওয়ার হিটিং কোচের সন্ধান করছে। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিসিবি?

উড: অবশ্যই আমি নিতে চাইব, এমন অফার পেলে আমি অবশ্যই ভালোবাসব। আমি এই কাজের জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করেছি। বিসিবি এখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, কিন্তু পাকিস্তান আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি এখনও ওটার অপেক্ষায় আছি। তবে বাংলাদেশের অফার পেলে অবশ্যই আমি নিব। কারণ এই দেশের লোকরা দারুণ, প্রতিভাও আছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে কাজ করার সুযোগ পেলে কোন কৌশলে এগোতে চান?

উড: আমি প্রথমত ক্রিকেটারদের শেখাব। বুঝতে শেখাব যে তোমাদের পক্ষে উইকেটে গিয়েই পাওয়ার হিটিং সম্ভব নয়। তোমাদের একেকজনকে একেকভাবে কাজ করতে হবে। কেউ ৬ ফুট, কেউ ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। ‍ওদের ব্যাটিং ভিন্ন, সবাই ভিন্ন ভাবে ব্যাট সুইং করে। তাই ওদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে কাজ করার আছে।

প্রশ্ন: দুর্ভাগ্যবশত যদি আপনাকে বিসিবি থেকে চাকরির প্রস্তাব না দেওয়া হয় তাহলে আপনি ফ্র্যাঞ্চাইজির অনুরোধ গ্রহণ করে আবার বিপিএলে আসবেন?

উড: অবশ্যই আসব। ফিরে আসাটা হবে আমার জন্য আনন্দের। কারণ এবার আমাদের বিপিএলটা ভালো যাচ্ছে না। সামনের ম্যাচগুলো আশাকরি আমরা ফিরে আসবো। তাছাড়া আমরা দুই জন পেসারকে ইনজুরিতে হারালাম যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

প্রশ্ন: আপনি সিলেটের দলের দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে জাতীয় দলের তিন ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক, মিঠুন, বিজয়দের কেমন দেখলেন?

উড: দারুণ। ওরা সবাই শিখতে চায়, জানতে চায়। আমার কাছ থেকে যতটা সম্ভব জানতে চাচ্ছে। তারা ভারি ব্যাট-বলের টেকনিকটা শিখতে চায়। আমি অবশ্যই বলব মিঠুন ও বিজয় লোকাল ক্রিকেটারদের মধ্যে আলাদা। মোসাদ্দেক, বাবুও (আলাউদ্দিন বাবু) ভালো করছে। আমার পরামর্শগুলো কাজে লাগাচ্ছে। আশাকরি ওরা ভালো করবে।

প্রশ্ন: আপনি এখানে দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় অনেক ব্যাটসম্যানকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। কাউকে আলাদা করে মনে ধরেছে?

উড: আপনাদের অনেক পাওয়ার হিটার আছে। যেমন তামিম ইকবাল, সে আপনাদের প্রপার ব্যাটসম্যান। যেমন বাবর আজম। এখন আপনাদের ক্রিকেটার বাছাই করতে হবে, তিন-চারজন পাওয়ার হিটার তৈরি করতে হবে। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যাটারদের মিলিয়ে ভালো একটা দল তৈরি করতে হবে। এটা আসলে ১০-২০ দিনে হবে না। এটা প্রক্রিয়া, এটা শিক্ষার ব্যাপার। কোচদের শেখাতে হবে, ক্রিকেটারদের শেখাতে হবে। ওরা পারবে না যে এমন না, কিন্তু প্রক্রিয়াটা বুঝতে হবে ও বিশ্বাস করতে হবে।

প্রশ্ন: সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পাওয়ার হিটিং কৌশল উন্নয়নে কোন পথে হাঁটা উচিৎ?

উড: বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা সবাই ভালো, ওরা ব্যাট করতে পারে ভালো ভাবে, এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওদের পাওয়ার হিটিংয়ে কাজ করতে হবে। এছাড়া একটা বিষয় যা আমি বুঝলাম, এখানে দ্রুত পরিকল্পনা বদল করতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে-আলাদা পিচে। এখানে মাঝের ওভারগুলোতে কাজ করতে হবে। এখানকার ক্রিকেটাররা একটি ডট ও চারের মাঝেও বড় শট নিতে চায়। কিন্তু ওদের তো স্ট্রাইক বদল করতে হবে। মাইন্ডসেট হয়ে থাকছে বাউন্ডারি মারা, কিন্তু অন্যভাবেও ওভারে ৮-৯ রান নেয়া যায়। এইসব ম্যাচ পরিস্থিতি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।

টিআইএস/এটি/এনইউ