হকি, টেনিস, গলফ পাওয়ার হিটিংয়ে সাহায্য করেছে
২৫ বলেই হাঁকিয়েছিলেন সেঞ্চুরি। ওই ইনিংসে ছয় বলে ছিল ছয় ছক্কা। ম্যাচটি অবশ্য ছিল অনানুষ্ঠানিক একটি টি-টেন। তবুও ওই ইনিংস তাকে নিয়ে এসেছিল আলোচনায়। এবারের বিপিএলে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। হাঁকিয়েছেন টানা দুই ফিফটি। সঙ্গে নিজের পাওয়ার হিটিং সক্ষমতাও বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আগামী দিনে ইংল্যান্ড জাতীয় দল কিংবা টি-টোয়েন্টির ‘হট কেক’ হওয়ার সব সম্ভাবনাই আছে উইল জ্যাকসের। পরিবার ছিল ক্রীড়াবান্ধব, তাদের সঙ্গে খেলে খেলেই শুরু। এরপর স্কুল ক্রিকেট থেকে সারেতে এসে ভর্তি হন; ছুটে চলার আরম্ভটা এখানেই।
বিজ্ঞাপন
কীভাবে টেনিস, হকি, গলফের মতো খেলা তাকে পাওয়ার হিটার হতে সাহায্য করল? কাউন্টি ক্রিকেটে একজন তরুণের মানিয়ে নেওয়া কতটা কঠিন? ২৫ বলে হাঁকানো ওই সেঞ্চুরির গল্প, নিজের বোলিং- এমন নানা বিষয়ে মাহমুদুল হাসান বাপ্পির সঙ্গে কথা বলেছেন চলতি বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের অন্যতম বড় তারকা উইল জ্যাকস।
প্রথমবার বাংলাদেশে আসলেন, কেমন লাগছে?
জ্যাকস : বাংলাদেশে খুব ভালো সময় কাটছে, সময়টা উপভোগ করছি। আপনি যেমন বললেন, প্রথমবার এখানে এসেছি। অনেক কিছু শিখছি। আলাদা শহর, নতুন একটা সংস্কৃতি। ক্রিকেটের কথা বললে.. ভিন্ন ধরনের পিচ, ভিন্ন কোচিং স্টাফ; এই ধরনের পিচে খেলার অভিজ্ঞতা আমার খুব বেশি নেই। এটা আমার জন্য ভালোই হয়েছে। আমি অনেক কিছু শিখছি এবং উপভোগ করছি।
আপনার ক্রিকেটের শুরুর গল্পটা দিয়েই শুরু করি...
জ্যাকস : আমার মনে হয় পাঁচ বছর বয়সে প্রথম ক্রিকেট খেলেছিলাম। ঘরের ভেতর বাবা-মায়ের সঙ্গে খেলে শুরু। আমার পরিবার খুব ক্রীড়াবান্ধব ছিল, তাই একদম ছোটবেলাতেই হাতেখড়ি। আমরা নিজেরাই মিলেমিশে খেলতাম। আমি ক্রিকেট ভালো খেলতাম, অনেক উপভোগ করতাম। এরপর স্কুল ক্রিকেটে কয়েকটা ভালো ইনিংস খেললাম। তারপর গেলাম সারে একাডেমিতে। সেখান থেকেই আসলে বেড়ে ওঠা।
আপনার প্রথম আলোচনায় আসা ইনিংসটার কথা মনে আছে? একটা অনানুষ্ঠানিক ম্যাচে ২৫ বলেই সেঞ্চুরি করে ফেলেছিলেন! ছয় বলে ছয় ছক্কাও মেরেছিলেন...
জ্যাকস : হ্যাঁ, ওটা একটা প্রি-সিজন ম্যাচ ছিল। সেটাও ১০ ওভারের। আমি এর আগে কখনো এই ধরনের ম্যাচ খেলিনি। আমাকে বলা হলো ম্যাচটা মাত্র ১০ ওভারের। তো, আমি গিয়ে নিজের মতো খেলা শুরু করলাম। বল জোরে মারতে চাইলাম, যেমনটা আমি সবসময় করি।
এরপর যা কিছু চেষ্টা করেছি, সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। আধা ঘণ্টার মতো ক্রিজে ছিলাম। খুব বেশি কিছু চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। আমি শুধু পরিষ্কার থাকতে চেয়েছি নিজের কাছে, আর ক্রিকেট শট খেলেছি। সৌভাগ্যবশত, যা করতে চেয়েছি সবকিছু হয়েছে। এটাই আসলে সবচেয়ে বড় বিষয়।
আপনাদের ওখানে ১০০ বলের ক্রিকেটও হয়। এসব কি ক্রিকেটকে আরও ছড়িয়ে দিতে সহায়ক হবে?
জ্যাকস : ক্রিকেট একটা খেলা হিসেবে টি-টোয়েন্টি আসার পর অনেক বেশি ছড়িয়েছে। আমার মনে হয় প্রথম মৌসুমে ১০০ বলের ক্রিকেটও সফল। যদি দেখেন, দর্শকদের অনেক অনেক আগ্রহ। মাঠে তো অবশ্যই, টিভিতেও তারা নিজেদের আগ্রহ দেখিয়েছে। অবশ্যই টেস্ট ক্রিকেট সবার উপরে। এটাই আমাদের কাছে আসল ফরম্যাট, দর্শকরাও দেখে। কিন্তু আমরা যদি খেলাটাকে ছড়িয়ে দিতে চাই, তাহলে ১০০ বলের ক্রিকেট বা টি-টেন হতে পারে আদর্শ। ইংল্যান্ডে এটা আসলে দারুণ কিছু।
টেস্ট ক্রিকেটকে সবার উপরে রাখলেন। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তো আপনার পরিসংখ্যান ভালো নয়। ৩০ ইনিংসে কেবল একটা সেঞ্চুরি...
জ্যাকস : আমি জানি, পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখলে লাল বলের ক্রিকেটে আমার অনেক উন্নতি দরকার। আমার ইচ্ছে আছে, বাংলাদেশ থেকে গিয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করার। সামারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আশা করি ভালো একটা মৌসুম কাটবে এবার।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খারাপটা দেখালাম। ভালোটাও বলে নিই। ভারতের বিপক্ষে যুব দলের একটা টেস্টে আপনি অধিনায়ক ছিলেন। সেঞ্চুরিও হাঁকিয়েছিলেন, মনে আছে?
জ্যাকস : হ্যাঁ, মনে আছে। তবে যখন আপনি ব্যাট করবেন, তখন আসলে এত কিছু মাথায় নেওয়ার সুযোগ নেই। লাল বল হোক আর সাদা, আপনার রান করার মানসিকতাই থাকতে হবে। অধিনায়ক হিসেবে হোক অথবা অন্যভাবে, ওই ক্ষেত্রেও মানসিকতাটা একই।
পাওয়ার হিটার হতে চেয়েছিলেন নাকি এমনিতেই হয়ে গেলেন?
জ্যাকস : এমনিতে আসলে কিছুই হয় না। বেড়ে ওঠার সময় আমি প্রায় সব ধরনের খেলাই খেলেছি। আমার মনে হয় টেনিস, হকি ও গলফ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সেগুলো ক্রিকেটে নিয়ে এসেছি। কীভাবে ব্যাট সুইং করব, বডি মুভমেন্ট, নিজের ভিত্তিটা শক্তভাবে দাঁড় করানো... এসব শিখেছি।
ওই খেলাগুলো আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। বল কীভাবে জোরে মারতে হবে, বাউন্ডারির বাইরে নিতে কতটুকু শক্তি দরকার। এসব বুঝতে আমার মনে হয় টেনিস, গলফ বা এমন খেলাগুলো অনেক সাহায্য করেছে।
আধুনিক যুগে তো অনেক উদ্ভাবনী কিছুই ব্যাটারদের করতে দেখা যায়। আপনি অল্প দিনেই পাওয়ার হিটারের তকমাও পেয়ে গেছেন। আধুনিক যুগে পাওয়ার হিটার হতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী ?
জ্যাকস : আমার মনে হয় আপনাকে মানিয়ে নিতে জানতে হবে। অবশ্যই অনেক স্কিল দরকার। কিন্তু আলাদা পিচ, আলাদা মাঠ ও আলাদা বোলারের বিপক্ষে খেলতে জানতে হবে। দল আপনার কাছে কী চায়, ম্যাচের পরিস্থিতি কী চায়; সেটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেকে বদলাতে হবে।
আলাদা মাঠ, বোলার ও পিচের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আপনার প্রস্তুতিটা কেমন?
জ্যাকস : আমি সবসময় পাওয়ার হিটিং নিয়ে কাজ করি। আপনি যে জিনিসটাতে ভালো, নেটে সেটাই বেশি করতে হবে। আমিও তেমনই করি। নিজের শক্তির জায়গাটাকে পরের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। নিজের দুর্বলতাকে নিয়েও কাজ করতে হবে। কোন বোলারের বিপক্ষে খেলবেন আর ওই বোলার আপনাকে কীভাবে আউট করতে চাইবে সেটা বুঝে নেটে অনুশীলন করা প্রয়োজন। বোলার আমাকে কীভাবে আটকাতে পারে তা মাথায় রেখে তার বিরুদ্ধে কীভাবে খেলতে হবে এটা নিয়ে আমি নেটে কাজ করি।।
কাউকে দেখে পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
জ্যাকস : অবশ্যই। এবিডি ভিলিয়ার্স আমার ছোটবেলার নায়ক ছিল। সে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। শুধু আমাকেই নয়, আমার মনে হয় পুরো একটা জেনারেশনকেই। বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি খেলে বেড়ানোতেও তার অনুপ্রেরণা আছে।
ইংল্যান্ডের কারো সঙ্গে কথা বললে কাউন্টির প্রসঙ্গ চলে আসে। এটা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করে একটু বলবেন?
জ্যাকস : আমার মনে হয়, আপনি যখন ছোটবেলায় বা ১৮-১৯ বছর বয়সে কাউন্টি ক্রিকেটে যাবেন- তখন এটা ভীষণ কঠিন। আপনাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। আপনার অভিজ্ঞতা নেই, অর্জন করতে চাইবেন। এখানে আন্তর্জাতিক ও দেশের ক্রিকেটারদের একটা ভালো সংমিশ্রণ থাকে।
অবশ্যই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট অনেক কঠিন। যদিও ইংল্যান্ড কয়েক বছর ধরে ভালো করছে সাদা বলের ক্রিকেটে। তো, কাউন্টিতে আপনাকে শিখতে হবে। শিখতে শিখতেই বেড়ে উঠতে হবে। বিশ্বের সেরা ক্রিকেটাররা আপনার সামনে আছে- তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে ভালো করতে হবে।
আপনি তো বলও করেন। কোনটা বেশি কঠিন- বোলিং নাকি পাওয়ার হিটিং?
জ্যাকস : আমি বলব পাওয়ার হিটিং।
আপনি কিন্তু সারের হয়ে একটা ম্যাচে প্রতিপক্ষের প্রথম চার উইকেট নিয়েছিলেন...
জ্যাকস : হ্যাঁ, কিছু কিছু দিন আপনার পক্ষে চলে যায়। দেখা গেল, আগের দিনও একই কাজ করলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। পরের দিন সফল হয়ে গেলেন। আপনি হয়তো গ্যাপ রাখলেন না, ব্যাটসম্যানকে আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যাটসম্যান ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে দিলো!
আপনি আসলে কোনো কিছুই আগে থেকে ঠিক করে রাখতে পারবেন না। কোনো দিন দেখা গেল, ভালো বল করলেন কিন্তু সাফল্য পেলেন না। আবার কিছুদিন আছে এমন, বাজে বল করলেন কিন্তু পাঁচ উইকেট পেয়ে গেলেন। কিছুদিন আসলে এসব হয়ে যায়।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছেন, ইংল্যান্ড লায়নের হয়েও। এখন কি জাতীয় দলের হয়ে খেলতে তৈরি?
জ্যাকস : সুযোগ পেলে তো দারুণ কিছু হবে। কিন্তু আপনি আগে থেকে জানেন না কী হবে। সুযোগের অপেক্ষায় আছি, দেখা যাক পাই কি না। আশা করি সুযোগ পেলে আমি যে তৈরি সেটা প্রমাণ করতে পারব।
শেষ একটা প্রশ্ন করি। চট্টগ্রামে আপনার সতীর্থ বেনি হাওয়েল, তিনিও আপনার দেশের। তিনিও আপনার মতো পাওয়ার হিটার। তার সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন?
জ্যাকস : আমি তার বিপক্ষে গত কয়েক বছর ধরে খেলেছি। তার বিপক্ষে লড়াইটা ভালো হতো আমার। একসঙ্গে প্রথম খেলেছি ডিসেম্বরে টি-টেনে। তার সঙ্গে একটা ভালো জুটিও হয়েছিল। আমাদের খুব দারুণ সম্পর্ক আছে। সেও খুব ভালো ব্যাটসম্যান এবং বৈচিত্র্যময় বোলার। তার কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
এমএইচ/জেএস