দুবাইয়ের পাকিস্তানি দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই চোখে পড়ছে কেমন যেন একটা উৎসব আমেজ। মনে হচ্ছে যেনো ঈদের  চাঁদ উঠেছে! আবার ট্যাক্সিতে উঠে পাকিস্তানি কোন চালক পেলে তো রক্ষা নেই, একটানা উর্দুতে ওরা বলে যাবে বাবর আজমদের কীর্তি গাথা। ক্রিকেটকে ঘিরে তাদের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারানোর পর থেকে সেই যে মুখে হাসি, তা যেন আর মিলিয়ে যাচ্ছেই না। আজ বৃহস্পতিবার আরেকটি মঞ্চ তৈরি। জিতলে দল উঠে যাবে ফাইনালে। আর সমর্থকরাও প্রস্তুত। ফের সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিয়ম পরোয়া না করে মিছিলে গলা মেলাতে চায় তারা।

অবশ্য বিশ্বকাপ নিয়ে মরুর দেশে যে কোন উন্মাদনা নেই, সেটা তো প্রায় সবারই জানা। যা একটু উত্তেজনা ছিল সেটিও শেষ হয়ে গত মাসেই। ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের ম্যাচটার পর রঙ হারাতে থাকে বিশ্বকাপ। এরপর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের টানা হারে চুপসে গেছে প্রবাসী বাংলাদেশি দর্শকরা। বিদায় নিয়েছে আফগানিস্তানও, নেই বিরাট কোহলির দল। এখন এশিয়ার দল হিসেবে সেমি-ফাইনালে সবেধন নীলমণি পাকিস্তান। 

আজ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা) সেই দলটি ফাইনালে উঠার লড়াইয়ে নামছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ম্যাচটি খেলার আগে আত্মবিশ্বাসে ফুটছেন বাবর আজমরা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে জয়ের পরই দলটির সমর্থকরা ধরে নিয়েছে এবার চ্যাম্পিয়ন হবে পাকিস্তানই। দেরা দুবাইয়ের চারপাশে এমনিতেই পাকিস্তানি প্রবাসীদের সংখ্যাটাই বেশি। 

করাচি-লাহোর কিংবা রাওয়ালপিন্ডির সেই শ্রমজীবি মানুষদের ম্যাচটা নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। টিকিটের একটা হাহাকার তো আছেই। আর অজিদের হারাতে পারলে নিশ্চিত করেই নিয়ম ভেঙে আনন্দ মিছিল শুরু করে দেবেন তারা! তেমন প্রস্তুতিও চলছে আশপাশে। 

তবে হঠাৎ করেই একটা দুটো দুঃসংবাদ ভর করেছে পাকিস্তান শিবিরে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগে জ্বরে আক্রান্ত পাকিস্তানের নিয়মিত ক্রিকেটার শোয়েব মালিক ও মোহাম্মদ রিজওয়ান। ম্যাচের আগের দিন বিশ্রামে থাকতে হয়েছে এই দুই ক্রিকেটারকে। অবশ্য করোনা নিয়ে শঙ্কা নেই। দু’জনই কোভিড নেগেটিভ। অজিদের বিপক্ষে লড়াইয়ের ঠিক আগে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ফের পরীক্ষা হবে। তারপরই এই দু’জনকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে টিম ম্যানেজমেন্ট।

শোয়েব মালিক খেলতে না পারলে সেটা হবে পাকিস্তানের জন্য বড় ধাক্কা। আগের ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তার ব্যাট থেকে এসেছে ১৮ বলে ৫৪ রানের ঝড়ো ইনিংস। রিজওয়ান ১৯ বলে ১৫। এই দুই ক্রিকেটারের জন্য শেষ মুহূর্ত অব্দি অপেক্ষা করবে পাকিস্তান টিম ম্যানেজমেন্ট।

তবে অজিদের বিপক্ষে বোলিংয়েই বাজিমাতের অপেক্ষায় পাকিস্তান। ফাইনালে উঠার লড়াইয়েও শাহীন শাহ আফ্রিদি প্রতিপক্ষের জন্য আতঙ্কের এক নাম। অজি অধিনায়ক অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘দেখুন, শাহীন আফ্রিদিকে আটকাতে হবে আমাদের। মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে লড়াইটা বেশ জমবে।’

তবে হারিস রউফও প্রস্তুত। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঝড় তুলে তিনি নিয়েছেন ৪ উইকেট। স্পিনেও দুর্দান্ত পাকিস্তান ইমাদ ওয়াসিম, শাদাব খান ছন্দে আছেন।

ব্যাটিংয়ে বাবর আজম মনে হচ্ছে চেনা উইকেটে সেরা ফর্মেই আছেন। এই বিশ্বকাপে পাঁচ ম্যাচে চারটি অর্ধশতক। করেছেন ২৬৪ রান। মোহাম্মদ রিজওয়ান ২১৪। সুপার টুয়েলভে ভারতের বিপক্ষে জয়ের পর পুরো পাকিস্তান দলটা যেন এক সুতোয় গাঁথা। একাট্টা দলটা যে করেই হোক বিশ্বকাপ জিতে ফিরতে চাইছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও প্রতিনিয়ত খোঁজ রাখছেন বাবর আজমদের। এই দলটা সাফল্য না পেয়ে পারে?

আরও একটা দিক থেকে অজিদের চেয়ে মনস্তাত্বিক দিকে এগিয়ে পাকিস্তান। দলটির ব্যাটিং পরামর্শক ম্যাথু হেইডেন। যিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান। ফিঞ্চদের দুর্বলতাটা ভাল করেই জানা আছে এক সময়ের এই তারকা ব্যাটসম্যানের। প্রতিপক্ষের কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারও তার দীর্ঘদিনের সতীর্থ। কিন্তু এবার দু’জন মুখোমুখি। অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড়িয়ে হেইডেন বলছিলেন, ‘অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার। দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে লড়েছি। এবার ওদেরই বিপক্ষে জিততে পরিকল্পনা করতে হচ্ছে!’

অনেক দিন ধরেই আইসিসির এই টুর্নামেন্টে শিরোপা নেই পাকিস্তানের। এক যুগের প্রতীক্ষা শেষের পথে আছে দলটি। বৃহস্পতিবার অজিদের হারাতে পারলে শিরোপার আরও কাছে চলে যাবে তারা। যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় নিউজিল্যান্ড। যারা আগের দিন রাতে আবুধাবিতে ইংল্যান্ডের স্বপ্ন মাড়িয়ে পেয়েছে ৫ উইকেটের জয়।

ব্যাটিংয়ে দারুণ দাপট ডেভিড ওয়ার্নারের। চলতি বিশ্বকাপে তার ব্যাট থেকে এসেছে ১৮৭ রান। ক্যাপ্টেন অ্যারন ফিঞ্চ ১৩০। আর বল হাতে স্পিনার অ্যাডাম জ্যাম্পা তুলেছেন ১১ উইকেট। পেসার জশ হেইজেলউড নিয়েছেন ৮ উইকেট। তাদের সামাল দেওয়াটা সহজ হবে না পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের।

অজিরা পাঁচবার ওয়ানডে ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হলেও টি-টোয়েন্টিতে ট্রফি অধরা। এবার সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫ উইকেটে হারিয়ে মিশন শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। এরপর শ্রীলঙ্কাকে হারায় ৭ উইকেটে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে  এসে ৮ উইকেটে হেরে চাপে পড়ে যায় ফিঞ্চের দল। কিন্তু এরপরই বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ফেরে লড়াইয়ে। শেষ অব্দি অবশ্য ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের পর নেট রান রেটে সেমির টিকিট পেয়ে অস্ট্রেলিয়া।

২০ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট ২৩ মুখোমুখি হয়েছে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান। যেখানে এগিয়ে পাকিস্তান। তারা জিতেছে ১৩ ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়া জয়ী ৯টিতে। পরিত্যক্ত একটি ম্যাচ। নিশ্চিত করেই এই অতীত প্রেরণা দেবে বাবর আজমদের। আর বিশ্বকাপে হেড টু হেডে লড়াই সমানে সমান। ছয়বারের দেখায় তিনবার করে জিতেছে পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া। 

কিন্তু ২০ ওভারের ক্রিকেটে কী এতোশত পরিসংখ্যান হিসাব-নিকাশ কাজে আসে? ১২০ বলের ধামাকা ক্রিকেট। সুযোগগুলো যারা কাজে লাগাবে শেষ হাসি তাদেরই। দুবাইয়ে পাকিস্তানি সমর্থকরা তো প্রস্তুত হয়ে আছে, বাবর আজমরা অজিদের বিদায় করে শেষ হাসি হাসতে পারবে তো?

এটি/এনইউ