আইসিসি ইভেন্টের নকআউট, ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড মুখোমুখি। চর্চা হচ্ছিল সেই ফাইনালের, অবধারিতভাবেই। সেই ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালের। ক্রিকেট রূপকথায় ঢুকে যাওয়া ইয়ান স্মিথের সেই ‘বেয়ারেস্ট অফ অল মার্জিন’ কথামালা, জিমি নিশামের আক্ষেপভরা ‘ক্রিকেটে এসো না’ খ্যাত সেই টুইট, কিংবা বেন স্টোকস বীরত্বের সেই ফাইনালের। 

সেই ফাইনালের আলোচনা হলো, ম্যাচেও অল্পবিস্তর দেখা গেল সে ম্যাচের ছাপ। সে ম্যাচের মাপকাঠিতে না উঠলেও রোমাঞ্চের পারদ চড়ে গেল অনেকটাই। তবে সেবারের সঙ্গে এবারের অমিল, সেবার শেষ হাসি হেসেছিল ইংল্যান্ড, আর এবার নিউজিল্যান্ড। সেবার আফসোসে পোড়া নিশাম এবারের অন্যতম নায়ক। ১১ বলে ২৭ রানের ক্যামিওই যে নিউজিল্যান্ডকে ফিরিয়ে এনেছে কক্ষপথে। যার হাত ধরেই ইংলিশদের ৫ উইকেটে হারিয়ে নিউজিল্যান্ড চলে গেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে! নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো!

আবুধাবি শেখ জায়েদ স্টেডিয়াম থেকে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের দূরত্বটা ১১৬ কিলোমিটারের এদিক ওদিক। কিন্তু নিউজিল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের জন্য তখন সে দূরত্বটা ছিল ২৪ বলে ৫৭ রানের। শুরু থেকে দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ইংলিশদেরই মনে হচ্ছিল কিউইদের চেয়ে এগিয়ে। 

তখনই দৃশ্যপটে এলেন নিশাম। ১৭তম ওভারটা করতে আসা ক্রিস জর্ডানের প্রথম বলটাই নিয়ে আছড়ে ফেললেন সীমানাদড়ির ওপারে। সমীকরণটা নেমে এল ২৩ বলে ৫১ রানে। পরের বলে লেগ বাইয়ে দুটো রান এলো, এরপর ওয়াইডে আরও এক রান।

ওভারের তৃতীয় বলটাও লং অন দিয়ে আছড়ে ফেলতে চাইলেন সীমানার ওপারে, কিন্তু সেখানে ছিলেন জনি বেয়ারস্টো দারুণ দক্ষতায় ঝাঁপিয়ে বলটা ঠেকালেন, ব্যাক আপ দিতে আসা সতীর্থের কাছে যখন ছুঁড়ে দিলেন বলটা, মনে হচ্ছিল এই বুঝি শেষ নিশাম ঝলক। আম্পায়ার সফট সিগন্যাল দিলেন আউট, পাঠালেন থার্ড আম্পায়ারের কাছে।

বল ছাড়ার আগেই সীমানাদড়ি মাড়িয়ে ফেলেছিলেন বেয়ারস্টো/গেটি ইমেজ

সেখানে রিপ্লেতে যা দেখালো, তাতে চকিতেই ২০১৯ -এর সেই ফাইনালের ফ্ল্যাশব্যাক চলে আসার কথা। সেবার এই নিশামের বলেই স্টোকসের একটা ছক্কা ঠিক এইভাবেই সীমানাদড়ি পেরিয়ে গিয়েছিল ট্রেন্ট বোল্টের হাত দিয়ে। এবার হলো তার উল্টোটা, সেবার হতাশায় পোড়া জিমি এবার নিজেই পার পেয়ে গেলেন, বাঁচলেন হাঁফ ছেড়ে। এরপর হাঁকালেন আরও একটা ছক্কা, ২৩ রান তুলে প্রায় ফসকে যাওয়া ম্যাচটায় ফেরালেন নিউজিল্যান্ডকে।

পরের ওভারে আরও এক ছক্কা হাঁকালেন আদিল রশিদকে, সঙ্গী ড্যারিল মিচেল হাঁকালেন আরও একটা। এরপরই ঘটল অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স, রশিদকে কভারের ওপর দিয়ে সীমানাছাড়া করতে গিয়ে ধরা পড়লেন ইয়ন মরগানের হাতে। কিউই শিবিরে উৎকণ্ঠা, ২০১৯ ফিরে আসে যদি! যদি আরও একবার হতাশাই সঙ্গী হয় ব্ল্যাক ক্যাপ শিবিরে?

এবার সেটা হতে দেননি ড্যারিল মিচেল। শুরু থেকেই সতীর্থদের আসা যাওয়া দেখেছেন অপর প্রান্তে। ১৩ রানের মাথায় ওপেনিং সঙ্গী মার্টিন গাপটিল, আর অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকে হারিয়েছেন। এরপর ডেভন কনওয়েকে নিয়ে যখন ইনিংস মেরামত করে গিয়ার পরিবর্তন করি করি করছেন, তখনই জোড়া ধাক্কা, কনওয়ে গেলেন, এর কিছু পর গ্লেন ফিলিপসও। এতকিছু দেখেছেন, আটের ঘরের আস্কিং রেটটা তরতরিয়ে ১৪'র ঘরে চলে যেতে দেখেও হড়কাননি পা, হড়কালেন না এবারও। নিশামের এনে দেওয়া মোমেন্টামে ভর করে ১৯তম ওভারেই হাঁকালেন আরও দুটো ছক্কা, সঙ্গে আরও একটা চার। তাতেই গড়া হয়ে যায় ইতিহাস। টি-টোয়েন্টির বিশ্বআসরে প্রথমবারের মতো ফাইনালে চলে যায় নিউজিল্যান্ড। 

এর আগে এমন রোমাঞ্চের পথটা তৈরি করে দিয়েছিলেন কিউই বোলাররা। শুরু থেকে ইংলিশদের চেপে ধরেছিলেন। শুরুর দশ ওভারে দিলেন ৬৭। তবে শেষ দশ ওভারে মঈন আলি, আর লিয়াম লিভিংস্টোনের দারুণ এক জুটির সুবাদে ইংলিশরা শেষ দশ ওভারে স্কোরবোর্ডে যোগ করে ৯৯ রান।

তাতে মনে হচ্ছিল এই বুঝি কিউইদের হাত ফসকে ছুটে গেল ম্যাচের লাগামটা। নিজেদের ইনিংসে ১৩ রানে দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার মার্টিন গাপটিল আর কেন উইলিয়ামসন যখন ফিরলেন, তখন তো আরও বেশি মনে হচ্ছিল বিষয়টা। সে লাগামটা পরে টেনেছেন নিশাম, আর 'ম্যাচসেরা' মিচেল তা শক্তহাতে ধরে নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে গেছেন জয়ের বন্দরে। তাতে দুই বছর আগের দুঃখকে একপাশে রেখে আরও একটা আইসিসি ইভেন্টের ফাইনালে, প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টির বিশ্বসেরা হওয়া থেকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে চলে আসে কেন উইলিয়ামসনের দল। 

এনইউ