দুবাইয়ের ‘সদরঘাটে’ একদিন
প্রথম দেখায় কিছুটা চমকে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, পুরান ঢাকার সদরঘাটে চলে এলাম নাকি! না, একটু পা বাড়াতেই ভুল ভাঙল, এমন ছিমছাম খেয়া ঘাট ঢাকার বুকে কল্পনা করা যায় না। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে এমন টলমলে ছোট্ট একটা নীল জলের নদী দেখব সেটিও অবশ্য কল্পনা করিনি। মরুর দেশের কোনো অঞ্চল চিন্তা করলেই তো চোখের সামনে ভাসে ধু ধু বালুচর, বালিয়াড়ি আর উঁচু সব ইমারত। কিন্তু শহরের বুকে এমন শান্ত-সুন্দর নদী? নাহ, চিন্তাও করিনি।
দেরা দুবাই আর বার দুবাই দুই অঞ্চলের মাঝ খান দিয়ে বয়ে গেছে ক্রিক নদী। অবশ্য স্থানীয়রা বলেন ‘দেরা ক্রিক’। আর এই ছোট্ট নদীর বুক দিয়েই বয়ে চলে ছোট ছোট নৌকা। আরবিতে যাকে বলা হয় ‘আবরা’ মানে খেয়া পারাপারের নৌকা। দেরা দুবাই থেকে বার দুবাইয়ে যেতে আপনাকে খরচ করতে হবে ১ দিরহাম। মানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৫ টাকার মতো। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দিনে-রাতে শত-সহস্র মানুষ এই ‘আবরা’য় উঠে বসেন।
বিজ্ঞাপন
আব্দুর শুক্কুর জানাচ্ছিলেন, তাদের যাত্রীর মধ্যে বেশিরভাগই পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, ভারত আর নেপালের। আছে আফ্রিকানও। স্থানীয়রা এখানে তেমন আসে না, ‘এখানে এটাই ভাল লাগে, আইন সবার জন্য সমান। আমি একটা মাঝি হতে পারি, কিন্তু আমিও সবার মতো সমান সুযোগ ভোগ করি। এখানে বড়-ছোট বলে কিছু নেই।’ খেয়া ঘাটে এসে সত্যতাও মিলল এই কথার। সবাই লাইন ধরে উঠছেন। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।
কাঠের তৈরি নৌকাগুলো ছোট হলেও বেশ মজবুত। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার আগে কথা হচ্ছিল এক নৌকা চালকের সঙ্গে। তার কাছে অবাক করা তথ্যই পেলাম। এখানে নৌকার মাঝি বেশিরভাগই বাংলাদেশি! আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, কক্সবাজারের উখিয়া অঞ্চলের। নৌকার মাঝি আবদুর শুক্কুর ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন, ‘২০০২ সাল থেকে আমি আছি দুবাইয়ে। যখন এই শহরে এসেছি, তখন থেকে এই নৌকার মধ্যেই আছি। এখানকার পরিবেশ খুব ভাল লাগে। এখানকার কাজের প্রেমে পড়ে গেছি বলতে পারেন।’
আব্দুর শুক্কুর জানাচ্ছিলেন, তাদের যাত্রীর মধ্যে বেশিরভাগই পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, ভারত আর নেপালের। আছে আফ্রিকানও। স্থানীয়রা এখানে তেমন আসে না, ‘এখানে এটাই ভালো লাগে, আইন সবার জন্য সমান। আমি একটা মাঝি হতে পারি, কিন্তু আমিও সবার মতো সমান সুযোগ ভোগ করি। এখানে বড়-ছোট বলে কিছু নেই।’ খেয়া ঘাটে এসে সত্যতাও মিলল এই কথার। সবাই লাইন ধরে উঠছেন। কোন বিশৃঙ্খলা নেই।
নৌকায় উঠে বসতেই মুগ্ধতার পালা। এতো ছোট্ট একটা নদী, অথচ এখানকার পানি কতো পরিষ্কার, কত স্বচ্ছ। এই নীল জল আর পরিষ্কার পানির রহস্যটা জানালেন আরেক নৌকা চালক আব্দুর রহমান। তিনিও কক্সবাজার থেকে এখানে পাড়ি জমিয়েছেন। বলছিলেন, ‘আসলে এই পানি অনেকটা নোনা। সমুদ্র থেকে এখানে পানি আসে। আমাদের নদীর মতো এখানকার পানি নয়। এ কারণে নীল একটা ভাব থাকে। আর প্রতিদিন সকালে পানি পরিষ্কারের একটা ব্যবস্থা করা হয়। আমরা নিজেরাও পানিতে কিছু ফেলি না।’
কথা বলতে বলতেই আমরা চলে এসেছি দেরা থেকে বার দুবাইয়ে। যেটি অনেকটা পুরান ঢাকার মতো। অনেক ঐতিহ্য যেন লুকিয়ে। চটজলদি আশপাশ দেখে বুঝতে পারছিলাম, দুবাই শহরের প্রতিটা ইঞ্চি আসলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে, করছেও। কাঠের তৈরি নৌকা ভ্রমণটাও পর্যটকদের বেশ টানছে, তাও টের পাচ্ছিলাম। এখানকার নদী আর চারপাশে গড়ে ওঠা সভ্যতার সৌন্দর্য টানছে পর্যটকদের।
নদীর বাঁধানো পাড় ধরে হাঁটতে গিয়ে চারপাশেই বাংলা কথা শুনছিলাম। বেশিরভাগই চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণে। বুঝতে পারছিলাম, এই এলাকায় বাঙালির সংখ্যাটা অনেক। তেমনই একজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মোহাম্মদ ইরফানুল ইসলাম তার পরিচয় দিয়ে বলছিলেন, ‘এই নদীর পাড়ে আসলে জীবনের অনেক স্মৃতিতে ফিরে যাই আমি। গ্রামের ফেলে আসা স্মৃতিটা মনে পড়ে যায়। বাংলাদেশে আমার বাড়ির পেছনেই হালদা নদী। এখানে এই ক্রিকনদীতে পারাপারের সময় সেই অনুভূতিটা যেন ফিরে আসে। সেখানে লঞ্চে পার হয়েছি। এখানে নৌকায় হই।’
আমিরাত অর্থনৈতিকভাবে মহাশক্তিধর এক দেশ। এখানে চোখ মেললেই দেখা মিলবে দারুণ সব স্থাপনা। কিন্তু ছোট্ট এই নদীটির ওপর কোনো সেতু নেই। নৌকায় যাত্রী পারাপারের এই স্মৃতিটা ধরে রাখতেই যুগের পর যুগ চলছে এভাবেই।
আমিরাত অর্থনৈতিকভাবে মহাশক্তিধর এক দেশ। এখানে চোখ মেললেই দেখা মিলবে দারুণ সব স্থাপনা। কিন্তু ছোট্ট এই নদীটির ওপর কোনো সেতু নেই। নৌকায় যাত্রী পারাপারের এই স্মৃতিটা ধরে রাখতে যুগের পর যুগ চলছে এভাবেই।
এখানে নৌকায় যাত্রীর কমতিও নেই। ঘাটে ভিড়ছে একের পর এক নৌকা। সঙ্গে ছেড়েও যাচ্ছে প্রতি দুই মিনিট অন্তর অন্তর। এই নৌকা অবশ্য ঠিক বাংলাদেশের মতো নয়। ছোট্ট ডিঙির মতো দেখতে। দোচালা ছাউনি মাথার ওপর। পাটাতনে বেঞ্চের মতো করে রাখা হয়েছে বসার জায়গা। যার দুই পাশে পা ঝুলিয়ে বসছেন যাত্রীরা। আর কম শব্দের ইঞ্জিনে চলছে নৌকাগুলো।
সব মিলিয়ে এই নদীতে নৌকা চালনার সঙ্গে প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি জড়িত আছেন। বাঙালি মালিকানাধীনও রয়েছে কিছু নৌকা। এখানকার কর্মচারীরা কেউ মাসিক, কেউ আবার দৈনিক হিসেবে বেতন পান। আবার লাভের অংশ বণ্টন করেও চলে কিছু নৌকা।
নৌকার বেশির ভাগ মাঝি বাংলাদেশের হলেও এখানে কাজ করতে হলে আমিরাতের স্থানীয়দের সঙ্গে চুক্তি করেই শুরু করতে হয়। আর প্রতি বছর লাইসেন্সের মতো করে নবায়ন করতে হয় নৌকা। সব মিলিয়ে এখানে দেড়শ’র কিছু বেশি নৌকা রয়েছে পারাপারের জন্য। যাত্রী অনেক থাকায় আয় রোজগারও মন্দ নয় মাঝিদের। প্রতি নৌকাতে থাকেন দু’জন মাঝি। বাংলাদেশের একাধিক মাঝির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজের খরচ চালিয়ে দেশে অনেকেই হাজার পঞ্চাশের কাছাকাছি টাকা পাঠাতে পারেন প্রতি মাসে।
সব মিলিয়ে এই নদীতে নৌকা চালনার সঙ্গে প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি জড়িত আছেন। বাঙালি মালিকানাধীনও রয়েছে কিছু নৌকা। এখানকার কর্মচারীরা কেউ মাসিক, কেউ আবার দৈনিক হিসেবে বেতন পান। আবার লাভের অংশ বণ্টন করেও চলে কিছু নৌকা।
দেরা ও বার দুবাই স্টেশন থেকে দুই মিনিট অন্তর অন্তর ছেড়ে যায় একেকটি নৌকা। যেখানে ১০ জন করে যাত্রী তোলা হয়। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা চলে এই যাতায়াত। মজার ব্যাপার হলো, গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে নৌকা পারাপারের ভাড়া কিন্তু একই, ১ দিরহাম। সেটি আর বাড়েনি।
সন্ধ্যা নামতেই দুবাইয়ের এই ক্রিক নদীর দুই পাড় হয়ে ওঠে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর। এখন এই নভেম্বরে চারপাশে ঠান্ডা বাতাস। মরুর বুকেও শীত আসছে। এ কারণে সন্ধ্যা নামলেই ভিড় বেড়ে যায়। আর সেই পর্যটকদের খাবারের জন্য আছে বেশ কিছু দোকান। সেখানেও বেশ পরিকল্পতিভাবে করা হয়েছে সবকিছু। এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও মিলনমেলা বসে যায় সন্ধ্যায়। বিশেষ করে ছুটির আগের রাতে।
ঢাকা পোস্টের সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিনিধি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছিলেন, ‘আমি এখানে দশ বছর ধরে আছি। এখানে সূর্য ডুবলে কক্সবাজারের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা বন্ধুরা মিলে এখানে আসি। সময় কাটাই। বৃহস্পতিবার রাতে এখানে তো প্রবাসীদের মিলন মেলা বসে। দুবাই প্রবাসী সবাই সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করি। এখানে এলে বাংলাদেশের স্মৃতি খুঁজে পাই। একটু স্বস্তি খুঁজে পেতেই আসি এখানে।’
প্রবাস জীবনে আসলে এটুকুই আনন্দ। পরিবার-স্বজন থাকে দেশে। আর নিজেরা এই দুবাইয়ে রাত-দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করে আয় করেন দিরহাম। আর যখনই একটু সময় মেলে, সবাই একসঙ্গে জড়ো হন- আবরার মতো কোনো এক জায়গায়। নদীর ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে, এক মুহূর্তের জন্য হলেও অন্যরকম ভালো লাগা ছুঁয়ে যায়। মনে হয় যেন দেশেই আছি, কিছুক্ষণ পরই হয়তো ভাটিয়ালি গান ভেসে আসবে কানে!
এটি/এনইউ/জেএস