ডেজার্ট সাফারি : আজীবন মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি
এটা অনেকটা ভালোবাসার মতো, যা অনুভব করতে পারছি কিন্তু বলে ঠিকঠাক বোঝানো মুশকিল। মরুর বুকে অন্যরকম, রোমাঞ্চ ছড়ানো এক অভিজ্ঞতা। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে দুবাই ডেজার্ট সাফারিতে না গেলে সফরটাই থাকতো অপূর্ণ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে দেশ ছাড়ার আগে সহকর্মী আদনান রহমান বলে রেখেছিলেন, ‘ডেজার্ট সাফারি যেন মিস না হয়!’ সোমবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা সেই আজীবন মনে রাখার মতো স্মৃতি সঙ্গী হলো।
এমনিতে দুবাইয়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই দারুণ স্থাপত্যের সব অট্টালিকা। একেকটা যেন আকাশ ছুঁতে চায়, ডিজাইনে-নান্দনিকতায় ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াইটাও স্পষ্ট। কিন্তু শহর ছাড়তেই দেখা মিলল ভিন্ন দৃশ্য। রাস্তার দু'পাশে দিগন্ত জোড়া বালুকাবেলা। কিছুটা আঁকা-বাকা রাস্তা। যেমনটা এখানকার রাজপথে দেখা যায় না। শহর ছাড়িয়ে এসে রাস্তার পাশে কিছু উটের দেখাও মিলল, দেখতে পেলাম কিছু পাথুরে পাহাড়ও।
অবশ্য রোববারই দুবাই মরুভূমিতে যাবো বলে ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম। কিন্তু কিছুটা পথ যেতেই 'কারিম ট্যাক্সি'র ক্যাপ্টেন জানিয়ে দিলেন, এভাবে ডেজার্ট সাফারি হয় না। আগে থেকেই বুকিং করে যেতে হয়। আর সেটি করলে হোটেল থেকেই এসে নিয়ে যাবে। মাঝ পথেই মন খারাপ করে নেমে ফিরতে হয়েছে সেদিন। কিন্তু একদিন পর ঠিকঠাক মতো বুকিং দিয়েই আমরা রওনা দিলাম, সেই রোমাঞ্চের পসরা নিয়ে সাজানো ডেজার্ড সাফারিতে। তার আগে অবশ্য ১১০ দিরহাম (প্রায় তিন হাজার টাকা) দিয়ে বুকিং দিতে হয়েছে। হোটেলের সামনেও ঠিক সময়ে হাজির গাড়ি!
বিজ্ঞাপন
এমনিতে মরুভূমির কথা মনে আসতেই ছোটবেলা থেকে একটা ছবিই ভেসেছে, অ্যরাবিয়ান নাইটসের সেই আলিফ লায়লার কথা। ভোগ-বিলাসের সেই জীবনের কথা। আমিরাত এসে এবারই প্রথম সেই মরুভূমির মরিচিকার পথে। আমরা যাচ্ছি ওমান সীমান্তের কাছে একটা জায়গায়। যেটি দুবাই শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে।
শহর ছাড়তেই মুগ্ধতার শুরু। এমনিতে দুবাইয়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই দারুণ স্থাপত্যের সব অট্টালিকা। একেকটা যেন আকাশ ছুঁতে চায়, ডিজাইনে-নান্দনিকতায় ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াইটাও স্পষ্ট। কিন্তু শহর ছাড়তেই দেখা মিলল ভিন্ন দৃশ্য। রাস্তার দু'পাশে দিগন্ত জোড়া বালুকাবেলা। কিছুটা আঁকা-বাকা রাস্তা। যেমনটা এখানকার রাজপথে দেখা যায় না। শহর ছাড়িয়ে এসে রাস্তার পাশে কিছু উটের দেখাও মিলল, দেখতে পেলাম কিছু পাথুরে পাহাড়ও। বুঝে গেলাম চলে এসেছি সত্যিকারের আরবে।
মাঝে একটা বিরতি হলো। নেমে দেখলাম চারপাশে সব বাংলাদেশিদের পরিচালিত দোকান। ৩০ মিনিটের সেই বিরতিতে নিজেকে আরব সাজিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টাও হলো। অ্যারাবিয়ানদের মতো সেজে নিলাম অনেকেই। সেখানে কথা হচ্ছিল ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আবু ইউসুফের সঙ্গে। বলছিলেন, ‘এখানে আমরা যারা দোকানি আছি সবাই বাংলাদেশি। মাঝে একটা বছর অনেক কষ্ট করেছি। বেতনও ছিল না। করোনার কারণে টুরিস্ট না থাকায় খুব কষ্ট হয়েছে। তবে এখন আপনাদের মতো অনেকেই আসছেন, বেশ ভালো লাগছে।’
এর মাঝেই প্রায় দেড় ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা চলে এলাম সাফারিতে। এরপর যা ঘটল তা লিখে বোঝানো মুশকিল। আমরা উঠে বসলাম-ল্যান্ড ক্রুজারে। মোট পাঁচজন। একেবারে ড্রাইভারের পাশে মিশরের নাগরিক আহমেদ বাসির, মজার মানুষ! মাঝে এক নাইজেরিয়ান দম্পতি। আর পেছনে আমার সঙ্গে আমাদের সময়ের ক্রীড়া সম্পাদক মাইদুল আলম বাবু। কে জানতো এখান থেকেই শুরু হবে এমন রোমাঞ্চ। গাড়িতে উঠতেই সিলবেল্ট বেধে নিতে বললেন চালক। ব্যস, শুরু হলো রোলার-কোস্টার জার্নি!
কানে বাজছিল আরবের সঙ্গীত আর মঞ্চে বেলি ড্যান্স। এর মাঝে খাবারও চলে এসেছে সামনে। বুফে-যার যা ইচ্ছা যতো খুশি খাওয়ার সুযোগ। আমি আরবের খাবারটাই ট্রাই করলাম, মন্দ নয়! খাবার শেষ হতেই ছোট্ট বিরতি। তারপর ফের পরিবেশন। আরবেরই এক যুবক দেখালেন তার পোশাকে রাখা নানা জিনিস নিয়ে কতো যে ক্যারিশমা।
গাড়ি একবার বালির পাহাড়ে উঠে তো আবার নিচে। মনে হয় এই বুঝি উল্টে যাবে আমাদের গাড়ি। আনপ্রেডিক্টেবল রাস্তা। এতোদিন যা হলিউডের সিনেমায় দেখেছি তার অভিজ্ঞতাটাই যেন হলো বাস্তবে। শেষ বিকেলের আলোতে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। আমরা চিৎকারে কাঁপিয়ে তুলছি গাড়ির ভেতরটা। মিশরের তরুণ, ইয়া আল্লাহ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলল। তার আবার ব্যাক পেইনের সমস্যাও নাকি আছে। চিৎকার না দিয়ে উপায় আছে? মনে হচ্ছিল এই বুঝি বালির পাহাড় থেকে ছিটকে পড়বে আমাদের গাড়ি। না, তেমনটা হয়নি। হয়ও না খুব একটা।
মরুভূমির পেরিয়ে উঁচু থেকে নিচুতে ছুটতে থাকা গাড়িগুলো যেন বালির সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই যে গাড়ি গাড়ি কাত হয়ে যাওয়া কিংবা প্রায় উল্টে যাওয়া এটিই এই ডেসার্ট সাফারির সেরা বিনোদন। এখানে যারা গাড়ি চালান তাদের প্রত্যেকের রয়েছে ডেজার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স। মনে মনে ভয় ঢুকে যাবে তাদের ড্রাইভিংয়ে। কিন্তু নিরাপদ থাকবেন আপনি। তবে হ্যা, হার্টে সমস্যা থাকলে এই রাইডে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা বিধি-নিষেধও আছে!
ব্যস, ল্যান্ড ক্রুজারে সেই রোলার কোস্টার ভ্রমণ শেষে আমরা পা রাখলাম মূল ভেন্যুতে। শহর ছাড়িয়ে এক মরুভূমির বুকে বাগান বাড়িতে। রোদ তখন পড়ে এসেছে। সূর্য ডুবে যাব-যাচ্ছি করছে। চটজলদি আমরা কিছু ছবিও তুলে নিলাম, সুবিশাল সেই ধুধু মরুভূমিতে। রয়্যাল ঈগল ক্যাম্প নামের সেই রিসোর্টে পা রাখার আগেই দেখলাম দাঁড়িয়ে দুটো উট। সেখানকার গাইড জানালেন, ২০ দিরহাম খরচ করলেই উটের পিঠে চড়ে ঘুরে আসা যাবে কিছুক্ষণ। করা যাবে ভিডিও। ব্যস, আমি আর মাইদুল বাবু উঠে বসলাম উটের পিঠে। এবার যেন নিজেকে আরব বেদুঈন মনে হতে থাকল।
রিসোর্টে ঢুকতেই মনে হলো আজকের রাতটাতে তো আমরা আসলেই বেদুঈন। এখানে আরব ঐতিহ্যের অংশ হতেই তো এসেছি। আবু লাহবাব মরুভূমিতে আজকের রাতের অতিথি আমরা।
ফিরতি পথে কথা হচ্ছিল নেদারল্যান্ডসের নাগরিক ফন জিওভান্নির সঙ্গে। আমার মতো তার চোখে মুখেও মুগ্ধতা। বলছিলেন, ‘পৃথীবির অনেক দেশই ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। কিন্তু আরবরা স্পেশাল। ওরা জীবনটাকে উপভোগ করতে জানে। এটাই হওয়া উচিত। আজ আছি তো কাল নেই!’
রিসোর্টে প্রবেশের পর নিজেকে আবর শেখও মনে করতে পারেন যে কেউ। কারণ ভেতরে প্রায় সবই মিলবে বিনা পয়সায়। মাটিতে কার্পেটের ওপর পেতে রাখা আসনে বসতেই হাজির সফট ড্রিংকস, পানি, চা। ব্যস, এসব শেষ করার পরই শুরু হয়ে গেল মূল আয়োজন। রাতের পার্টি। চারপাশে সবাই জড়ো হয়ে বসলেন, নানা দেশের নানা বর্ণের পর্যটক। সবাই নিজেকে অ্যারাবিয়ানদের মতো করে সাজিয়েছেন।
তবে আমি এতোসব না ভেবে প্রাণ ভরে উপভোগ করছিলাম আরব্য রজনীর উপাখ্যান। কানে বাজছিল আরবের সঙ্গীত আর মঞ্চে বেলি ড্যান্স। এর মাঝে খাবারও চলে এসেছে সামনে। বুফে-যার যা ইচ্ছা যতো খুশি খাওয়ার সুযোগ। আমি আরবের খাবারটাই ট্রাই করলাম, মন্দ নয়! খাবার শেষ হতেই ছোট্ট বিরতি। তারপর ফের পরিবেশন। আরবেরই এক যুবক দেখালেন তার পোশাকে রাখা নানা জিনিস নিয়ে কতো যে ক্যারিশমা। লেসার রস্মির খেলা তো ছিলই। অন্ধকারে পোশাকের আলো নৃত্যশিল্পীর ঘূর্ণনের ছন্দ কী যে সৌন্দর্য ছড়াল! ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে ঘুরতে থাকলেন টানা, যেন থামবেনই না!
ততোক্ষণে রাত বাড়তে থাকল। হাত তালিতে পারফর্মারদের অভিনন্দিত করছিলেন সবাই। কেউ আবার শীশায় ধোয়া তুলে অন্য জগতে চলে গিয়েছিলেন। মঞ্চে পরিবেশনা চলছে তখনও। টেবিলে খাবারও অঢেল। তবে রাত তো ফুরায়। শেষটাতে এসে বেলি ড্যান্সের সঙ্গে যে চমক থাকল তা মনে থাকবে অনেক দিন। মাথায় তলোয়ার নিয়ে কতো কী যে করলেন সেই নারী। মনেই হলো অনেক দিনের সাধনায় এমন কিছু করা সম্ভব। রাতের আলো-আধারিতে কখন যে সময় ফুরিয়ে গেলো।
এবার ফিরতে হবে। এই যাত্রায় অবশ্য সেই রোলার কোস্টার জার্নি নয়, রাতের বেলায় সেটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণও। ফিরতি পথে কথা হচ্ছিল নেদারল্যান্ডসের নাগরিক ফন জিওভান্নির সঙ্গে। আমার মতো তার চোখে মুখেও মুগ্ধতা। বলছিলেন, ‘পৃথীবির অনেক দেশই ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। কিন্তু আরবরা স্পেশাল। ওরা জীবনটাকে উপভোগ করতে জানে। এটাই হওয়া উচিত। আজ আছি তো কাল নেই!’ কথাটা দার্শনিকের মতো শোনালেও মিথ্যে নয়। এমন রোমাঞ্চের জীবন খুঁজতে চাইলে মরুভূমিতে যেন আসতেই হবে!
এটি/টিআইএস