মিরপুরের শেরেবাংলার সামনে এমন দৃশ্য নতুন নয়। বাংলাদেশের যেকোনো মাঠ কিংবা বিপনি বিতানের সামনেও হরহামেশাই দেখা যায় এমন। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে এই দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না একেবারেই। কিছুটা চমকে গিয়েই দেখলাম কাঠ ফাটা রোদে একজন ফেরি করে বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি করছেন। বিক্রি করছেন লাল-সবুজের রঙে ছোঁয়া মাথার ব্যান্ড!

কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম তিনি বাংলাদেশি। কিছু বলার আগেই লাজুক হাসিতে নিজ থেকেই বললেন, ‘পতাকা নেবেন নাকি ব্যান্ড।’ দামটাও বললেন, ৫ দিরহাম। মানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২৫ টাকার মতো! 

আমি তো পতাকা কিনতে যাইনি। কাঁচে ঘেরা প্রেসবক্সে সেটা উড়ানোর সময়ও নেই। একটু কথা যদি বলা যায় এই উদ্দেশ্যেই এগিয়ে যাওয়া। ভিনদেশে এটাই কি তার পেশা? জিজ্ঞেস করতেই লাজুক হাসি দিয়ে বলছিলেন, ‘না ভাই। শখের বশে পতাকা বিক্রি করছি। আমার উদ্দেশ্য ভিন্ন।’ এবার আগ্রহটা দ্বিগুণ হয়ে গেল আমার। কি সেই উদ্দেশ্য? -ইশারায় দাঁড়াতে বললেন। সামনে ক্রেতা। পতাকা বিক্রি শেষ হতেই বলতে শুরু করলেন, ‘আমি আসলে পেশাদার হকার না। এই দেশে ফেরি করে বিক্রির তেমন প্রচলনও নেই। আমি আসলে একজন ক্রিকেট ভক্ত।’

ক্রিকেট ভক্ত তাহলে আমিরাতের মাঠের সামনে এসে খেলা দেখতে মাঠে না ঢুকে এই কাজ করছেন কেন? তিনি বললেন, ‘দেখুন পুরোটাই শখের বশে করছি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক বড় একজন ভক্ত আমি। বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপে আমিরাতে যে ম্যাচগুলো খেলেছে গ্যালারিতে বসেই দেখেছি সবগুলো ম্যাচ। দুবাইয়ে আমি আছি দশ বছর যাবৎ। দেরা দুবাইয়ের একটা দোকানে কাজ করি। বাংলাদেশের খেলা থাকলে ছুটি নিয়ে চলে আসি। এর আগে এশিয়া কাপের ম্যাচও দেখেছি। এই যে হাতে পতাকা আর ব্যান্ড দেখছেন এগুলো আমি নিজেই তৈরি করেছি। আর আনন্দের সাথে বিক্রি করছি। মনের আনন্দে এটা করি আর মাঝখান থেকে খেলাটাও দেখি।’

সবার হাতে পতাকা থাকুক, প্রিয় লাল-সবুজ থাকুক এটাই চান এই ক্রিকেট ভক্ত। বাংলাদেশের ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিজয় নগরে বাড়ি পাভেল আহমেদের। কাজে থাকলেও টাইগার ক্রিকেটের সব খবরই রাখেন। আলাদা করে প্রিয় ক্রিকেটার বাছতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়লেন, জাতীয় দলের সবাই তার প্রিয়। তবে সাকিব আল হাসান, ইমরুল কায়েস, মাশরাফি বিন মর্তুজার প্রতি ভালো লাগা একটু বেশি।

এবারের আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হাসিমুখেই প্রতিটি ম্যাচে মাঠে গেছেন তিনি। শারজাহ-আমিরাত দুই ভেন্যুতেই খেলা দেখেছেন। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের খেলা হতাশই করেছে তাকে। এমন হার দেখতে তো আর মন চায় না। বলছিলেন, ‘খুব কষ্ট হয় আসলে। আমার অন্য দেশের বন্ধুরা দল জিতলে কত আনন্দ করে। কিন্তু এবার আমরা পারলাম না।’ 

টানা ৫ ম্যাচে হেরে বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়েছে বাংলাদেশের। ব্যাপারটায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পরিণত ক্রিকেট ভক্তের মতোই কথা বলেন এই প্রবাসী দর্শক, ‘দেখুন মন তো খারাপ হয়ই। কিন্তু দেশটা তো আমাদের, সব সময় এটা মনে রাখতে হবে। ১০০ দিরহাম দিয়ে টিকিট কেটেছি বলে যে মনের সব রাগ উগড়ে দিতে হবে সেটা নয়, খারাপ সময়েই তো তাদের পাশে থাকতে হবে!’

এভাবে ভাবতে পারা পাভেল আহমেদদের জন্য হলেও ঘুরে দাঁড়াতে হবে বাংলাদেশকে। একটা বিশ্বকাপ মিশন দুঃস্বপ্নের মতো শেষ। তবে সামনের বছরই আরেক বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়ায় সেই লড়াই শুরুর আগে এখনই ভুল শুধরে প্রস্তুতিটা শুরু করতে হবে বাংলাদেশকে। না হলে আরও একবার এমন করেই মন ভাঙবে, হৃদয় চৌচির হবে পাভেলের মতো নিভৃতচারী লাখ লাখ ক্রিকেট ভক্তের!

এটি/এমএইচ