দুপুর গড়ানোর আগেই খবর মিলল হোটেল বন্দি থাকবে বাংলাদেশ দল। হ্যাটট্রিক হারের পর টানা দুই দিনের বিশ্রাম। অনুশীলন না থাকলেও দুবাইয়ের ফেস্টিভাল সিটির ক্রাউন প্লাজা থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের। জৈব সুরক্ষা নামের কারাগার তো আছেই। তবে আমরা যারা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে সংযুক্ত আরব আমিরাত এসেছি, তাদের তো এতো বাধ্য বাধকতা নেই। আর ট্যুরে এসে হোটেলের চার দেয়ালে বন্দি থাকারও কোন মানে হয় না। শনিবার বিকেল আর সন্ধ্যা কী করে কাজে লাগানো যায় তাই ভাবছিলাম।

সফরে আমার সঙ্গী মাইদুল আলম বাবু, বেশ করিৎকর্মা। ঢাকার দৈনিক আমাদের সময়ের ক্রীড়া সম্পাদক। ট্যুর প্ল্যানে দক্ষ মাইদুলের প্রস্তাব, ‘ঘুরে আসি দুবাই শপিং মলে চলেন।’ নামটা কানে আসতেই চনমনে হয়ে উঠল চারপাশ। বিশ্বকাপ কাভার করতে যখন আমিরাত আসবো বলে পরিকল্পনা করেছি, তখন থেকেই মাথায় ঘুরছে, দুবাই মল। অন্তর্জালের রাজ্যে ডুব দিয়ে তখন কত কী যে জেনেছি, বিস্ময়কর-বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মল!

কল্পনা আর গুগলের দুনিয়া তো আর বাস্তবের তৃপ্তি দেয় না। তাই সময়টা কাজে লাগিয়ে দুপুর গড়াতেই ছুটলাম দুবাই মলে। আমরা যেখানে উঠেছি সেখান থেকে দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়, ১৩.৫ কিলোমিটার পথ। যেতে ট্যাক্সি পথে সময় লাগে ১৭ মিনিট। কিন্তু শনিবার দিনটাতে বেশ জ্যামও দেখলাম দুবাইয়ে। নির্ধারিত সময়ের বেশি লাগলেও শপিং মলে পা দিতেই মনে হলো যেন স্বপ্নের রাজ্যে পা রেখেছি!

শত, সহস্র মানুষ। সবাই ছুটছেন! প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, এশীয় মানুষের ভিড়ে প্রাণবন্ত চারপাশ। ঢুকে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোথায় যাবো। এত বড় রাজ্যে এসে সব এলোমেলো হয়ে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। দুবাই মলের গল্প শুরুর আগে এই তথ্যটা জানিয়ে রাখছি, এটি প্রায় ১৩ মিলিয়ন বর্গ মিটার আয়তনের মল। আরেকটু সহজ করে বলা যায় ৫০টি ফুটবল মাঠের সমান এটি। এবার অনুমান করে নিন-এক মাথা থেকে আরেক মাথায় গেলে হাপিয়ে উঠবেন কি না!

পানির নিচের জলজ প্রাণীদের চিড়িয়াখানা! বিনা টিকিটে অবশ্য শুধুই ট্রেলর দেখা যায়। পুরো চমক দেখতে হলে কাটতে হবে টিকিট। ৫০ দিরহামের সেই টিকিট কেটে ঢুকতেই চোখের সামনে খুলে গেল আরেক রাজ্য। কাঁচে ঘেরা টানেলে হাঁটতে পথে মনে হলো সমুদ্রের নীচ দিয়ে যেন হেঁটে চলছি। ২৭০ ডিগ্রির সেই টানেল মাঝ রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে কতো যে বিস্ময়! দাঁত বের করে আসা হাঙ্গর ভয় ধরিয়ে দেবে যে কাউকে। রাশিয়ান এক দম্পতি অবশ্য ভয়ের বদলে মজাই করছিলেন, সেই টানেলে। এতো কাছ থেকে এবারই প্রথম দেখলেন শার্ক। ভাঙা ইংরেজিতে বলছিলেন, ‘শার্কের দাঁত দেখুন, মনে হচ্ছে যেন আরেকটু কাছে গেলেই কাঁচ ভেঙে আমাদের খেতে আসবে!’ বলেই কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন।

ক্লান্ত হয়ে উঠার আগে শুরুতেই আমরা চলে গেলাম মলের ৪ নম্বর গেটের কাছে। যেখানে অবিরাম দেয়াল বেয়ে ঝরে পড়ছে জলের ধারা। দৃশ্যটা দেখার মতো। সেখানে অন্য অনেকের মতো ছবি তোলার সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। তবে হাতে সময় কম থাকায় এরপরই চলে গেলাম দুবাই মলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ-অ্যাকুরিয়ামে ডাউনটাউন। জলের নিচের বিস্ময়কর এক জগৎ। 

মলের মধ্যেই সেই অ্যাকুরিয়ামে তুলে আনা হয়েছে সমুদ্রের নীল জল। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ১০ মিলিয়ন লিটার জলের এই ধারায় চোখের সামনে দেখলাম হাঙ্গর, পিরানহা, কুমির, টিকটিকি, অক্টোপাস, সাপ কী নেই এখানে? পানির নিচের জলজ প্রাণীদের চিড়িয়াখানা! বিনা টিকিটে অবশ্য শুধুই ট্রেলর দেখা যায়। পুরো চমক দেখতে হলে কাটতে হবে টিকিট। ৫০ দিরহামের সেই টিকিট কেটে ঢুকতেই চোখের সামনে খুলে গেল আরেক রাজ্য। কাঁচে ঘেরা টানেলে হাঁটতে পথে মনে হলো সমুদ্রের নীচ দিয়ে যেন হেঁটে চলছি। 

২৭০ ডিগ্রির সেই টানেল মাঝ রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে কতো যে বিস্ময়! দাঁত বের করে আসা হাঙ্গর ভয় ধরিয়ে দেবে যে কাউকে। রাশিয়ান এক দম্পতি অবশ্য ভয়ের বদলে মজাই করছিলেন, সেই টানেলে। এতো কাছ থেকে এবারই প্রথম দেখলেন শার্ক। ভাঙা ইংরেজিতে বলছিলেন, ‘শার্কের দাঁত দেখুন, মনে হচ্ছে যেন আরেকটু কাছে গেলেই কাঁচ ভেঙে আমাদের খেতে আসবে!’ বলেই কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন।

যদিও খুব বেশি সাহস না থাকলে টানেলে না গিয়ে বাইরে থেকেই সমুদ্রের সেই রহস্যময় জগত দেখা ভালো। ২০০৮ সালে মল চালুর বছর দুয়েক পর শার্কের আক্রমণে সেই কাঁচের দেয়াল কিছুটা ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত কিছুদিনের জন্য দুবাই মল বন্ধও ছিল। এখন অবশ্য সেই শঙ্কা নেই। 

যেমনটা বলছিলাম হাতে সময় কম, আবার রোদের তাপটাও কমে এসেছে। আমরা ছুটলাম দুবাই মলের ঠিক বাইরে। যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা মেলে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং বুর্জ আল খলিফার।

১৬৩ তলা সুবিশাল সেই বিল্ডিংয়ের সামনেই ছোট্ট লেক। তার পাশে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল দৃষ্টিনন্দন কতো যে অট্টালিকা। নান্দনিক সব ডিজাইন। অবশ্য আমিরাতে যেখানেই যাচ্ছি আলাদা করে চোখে পড়ছে নানা ডিজাইনের সব ইমারত। নিখুঁত সব ঘরবাড়ি। একটার চেয়ে যেন আরেকটা সুন্দর! যা দ্য দুবাই ফাউন্টেন নামে পরিচিত। এখানে ছবি তুলতেই ভিড় করেন সবাই।

সামনের যে লেক ছিল নীল জলের সেখানে আচমকা দেখলাম একে একে সবাই জড়ো হচ্ছেন। কারণটা বুঝতে আমরাও হাজির। এরপর রীতিমতো জলের খেলায় মুগ্ধ হওয়ার পালা। ফাউন্টেইন কোরিওগ্রাফি মনে হয় আরেক আশ্চর্য! জলের ফোয়ারা আকাশ ছুঁয়ে যায়। আরবি ক্লাসিক কোরাস গানের সঙ্গে জলের খেলা মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না! সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে আধঘণ্টা পরপরই চলতে থাকে এই ফাউন্টেইন কোরিওগ্রাফি। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, আমাদের দেশেও তো এমন হতে পারতো। রাজধানীর হাতিরঝিলে এমন কিছু করার পরিকল্পনা তো ছিলই। কিন্তু কে জানে, কেন সুযোগ থাকার পরও আমরা এমন করে কিছুই সাজাতে পারি না!

কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতে পাশে চেয়ারে বসতেই চোখে পড়ল এই দিকটা বেশ শান্ত। আসলে এই শপিং মলে শুধু কেনাকাটা করার জন্য আসতে হবে এমনটা নয়। এটি সত্যিকার অর্থেই বিনোদন স্পট। দেখার জন্য, দারুণ কিছু মুহুর্ত কাটানোর জন্য সব আয়োজনই হাজির পর্যটকদের জন্য। 

শুধু পকেট ভর্তি দিরহাম থাকলে দুবাই মল একটা স্বর্গ! আসা-যাওয়ার পথে নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষ দেখতে দেখতে কখনো যে সূর্যটাও হেলে পড়ল। তখন আরেক সৌন্দর্য দুবাই মলের। রাতের আলোতে যেন রূপকথার কোন এক রাজ্য।

সামনের যে লেক ছিল নীল জলের সেখানে আচমকা দেখলাম একে একে সবাই জড়ো হচ্ছেন। কারণটা বুঝতে আমরাও হাজির। এরপর রীতিমতো জলের খেলায় মুগ্ধ হওয়ার পালা। ফাউন্টেইন কোরিওগ্রাফি মনে হয় আরেক আশ্চর্য! জলের ফোয়ারা আকাশ ছুঁয়ে যায়। আরবি ক্লাসিক কোরাস গানের সঙ্গে জলের খেলা মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না! 

এই মল নির্মাণের সঙ্গে ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকরাও ছিলেন জড়িত। নান্দনিক সেই মল যার প্রতিটি দেয়ালে, কারুকার্যে উঠে এসেছে আরব ঐতিহ্যের জয়গাঁথা, সেখানে কোন বাংলাদেশির একটু স্পর্শ আছে এটাই বা কম তৃপ্তির কোথায়?

সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে আধঘণ্টা পরপরই চলতে থাকে এই ফাউন্টেইন কোরিওগ্রাফি। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, আমাদের দেশেও তো এমন হতে পারতো। রাজধানীর হাতিরঝিলে এমন কিছু করার পরিকল্পনা তো ছিলই। কিন্তু কে জানে, কেন সুযোগ থাকার পরও আমরা এমন করে কিছুই সাজাতে পারি না!

জলের এই খেলা শেষে ফের ফিরলাম দুবাই মলে। এরপর চটজলদি ভিআর পার্ক, রেইনফরেস্ট ক্যাফেতেও ঢু মারলাম। যদিও সেখানে দাম এতোটাই বেশি যে পর্যটকদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়। দুবাই ডিনো, কিডজ জোন আর রিল সিনেমাজ শুধু বাইরে থেকেই দেখতে হলো। যার ভেতরে ২২ সিনেপ্লেক্স, থিম পার্ক, এলাহি কাণ্ড! তবে এটুকু বুঝলাম চারতলা এই দুবাই মল পুরোপুরি দেখতে হলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পুরোটা দিন নিয়ে যেতে হবে। না হলে আক্ষেপ তো থেকেই যাবে।

ফেরার পথ ধরার আগে পার্কিং দেখেও বিস্ময়ের ঘোর কাটল না। আন্তর্জাল ঘেটে দেখলাম, এখানে একসঙ্গে ১৪ হাজারে বেশি গাড়ি পার্ক করা যায়! আরেকটা তথ্য খুঁজে পেয়েও কোথায় যেন একটা স্বস্তিও কাজ করল। কারণ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে দঁড়িয়ে থাকা দুবাই মলে যে এই বাংলাদেশেরও ছোঁয়া আছে। 

এই মল নির্মাণের সঙ্গে ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকরাও ছিলেন জড়িত। নান্দনিক সেই মল যার প্রতিটি দেয়ালে, কারুকার্যে উঠে এসেছে আরব ঐতিহ্যের জয়গাঁথা, সেখানে কোন বাংলাদেশির একটু স্পর্শ আছে এটাই বা কম তৃপ্তির কোথায়?

দুবাই ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়েই ভারতীয় চালক-প্রশ্ন রাখলেন, ‘কী? বেড়াতে এসেছিলেন বুঝি? এখানে এই দুবাই মলে একবেলায় আসলে কিছুই দেখা হয়ে উঠে না। পুরোটা আনন্দ নিতে সকাল-সন্ধ্যা সময় করে আসতে হয়।’ ঠিক তাই, অনেক কিছুই না দেখার আক্ষেপ নিয়ে ফিরছি। স্বপ্নলোকের এক জগত থেকে দেরা দুবাইয়ে ছুটে চলছে আমাদের ট্যাক্সি, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি এক জীবন বাঁচিয়ে রাখার মতো অমূল্য কিছু স্মৃতি!

এটি/এমএইচ/এনইউ