‘আমি বলব প্রত্যাশা বড় রাখা উচিত হবে না। প্রথম পর্ব পার করে সুপার টুয়েলভে গেলে প্রতিপক্ষ দলগুলো বেশ শক্তিশালী। আপনি যদি প্রত্যাশা আকাশচুম্বী রাখেন তাহলে হবে না।’- বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ মিশন শুরুর আগে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দলের সম্ভাবনা এভাবেই বিশ্লেষণ করেন সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান কোচ আফতাব আহমেদ।

বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ যাত্রা নিয়ে এবার বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল অনেকের। নির্বাচক থেকে শুরু করে অধিনায়ক হয়ে দলের সিনিয়র-জুনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে টিম ম্যানেজমেন্ট এমনকি অনেক বোর্ড কর্তাও বলেছেন, এবারের বিশ্বকাপ দলটি বাংলাদেশের ইতিহাস সেরা দল, সেমিফাইনাল খেলার লক্ষ্যর কথা জানান সবাই। 

ক্রিকেট বিশ্লেষকরা খুব বেশি আশা না দেখালেও একেবারে নিরাশ করেননি। তবে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে প্রত্যাশার পারদ নামিয়ে বাস্তবতা তুলে ধরে দলটির সক্ষমতা সামনে এনেছিলেন আফতাব।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ মিশন এক কথায় ব্যাখ্যা দিতে গেলে সাকিব আল হাসানরা তুলতে পারেননি ‘পাস’ মার্ক। ব্যর্থ বলা ছাড়া উপায় নেই। বেশ নাটকীয়তার পর কোনরকম সুপার টুয়েলভের টিকিট পেলেও টানা হারে দুমড়ে-মুষড়ে পড়েছে গোটা দল। শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারের পর সবার আগে কার্যত শেষ হয়ে গেছে বাংলাদেশ দলের সেমিফাইনালের স্বপ্ন। মাঠের পাফরম্যান্স আর মাঠের বাইরের সমালোচনায় দিশেহারা টাইগাররা। পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে।

ঢাকা পোস্টকে আফতাব ব্যাখ্যা করলেন এমন দুর্দশার কারণ, ‘দেখেন আমি কথাগুলো বলছিলাম কারণ সম্প্রতি আমরা যে ম্যাচগুলো খেলেছি, অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, আমাদের সবথেকে বড় সমস্যাটা হয়েছে ওখানেই। এই ম্যাচগুলোতে আমাদের যে ১১০-১২০ রান চেজ করার মানসিকতা তৈরি হয়েছে, এই জিনিসটাই কাল হয়েছে বিশ্বকাপে। আমি বিশ্বকাপ শুরুর আগে আপনাকে বলেছিলাম, ওখানকার উইকেটগুলো কিন্তু স্পোর্টিং হবে। ১৫০-১৬০ রান খুব ভালো চেজ হচ্ছে। এখনো টুর্নামেন্টের বেশ কিছু অংশ বাকি। সামনে যেগুলো ম্যাচ আছে সেগুলো ১৭০-১৮০ রানও চেঞ্জ করতে দেখা যেতে পারে।’

বিশ্বকাপের আগে নেওয়া প্রস্তুতিকে কাঠগড়ায় তোলেন আফতাব, ‘অবশ্যই প্রস্তুতির বড় ঘাটতি ছিল আমাদের। আমি বিশ্বকাপে যাচ্ছি আমার প্রস্তুতি কি থাকবে? বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে দুটো সিরিজ খেললাম যেখানে প্রতিপক্ষ টিমের মূল স্কোয়ার্ড আসেনি। সুযোগটা নিয়ে আমি যদি স্পোর্টিং উইকেট এ খেলতাম, যেমন ধরেন ১৫০-১৭০ রান চেজের, তাহলে আমাদের ব্যাটসম্যানরা যেমন রান পেত, তেমনি আত্মবিশ্বাসও পেত। আমরা খেললাম কিসে? অতিরিক্ত স্পিন ট্রাকে। এখানে মুস্তাফিজের কাটার, নাসুমের স্পিন সহজেই ধরেছে। সবদিক দিয়ে দেখেন ব্যাটে-বলে দুই জায়গাতেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে যেতে পারিনি।’

বিশ্বকাপের এই স্কোয়াডটাকে অনেকেই নিজেদের ইতিহাসের ‘সেরা’ দল বলছেন। আফতাবের আপত্তি এখানেই। যে দলে একজন জুতসই হার্ডহিটার বা ফিনিশার নেই, সে দলের সক্ষমতা নিয়ে আছে প্রশ্ন। বিশেষত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে।

পাকিস্তানের আসিফ আলীর প্রসঙ্গে টানলেন আফতাব, ‘সব থেকে হতাশাজনক ব্যাপার হচ্ছে আমাদের ৬-৭ নম্বর ব্যাটিং পজিশন। পাকিস্তানের আসিফ আলীকে দেখেন, এই জায়গাতে ব্যাট করে দুটি ম্যাচ বের করে এনেছে। আমাদের এমন একটা পাওয়ার হিটার খুবই প্রয়োজন টি-টোয়েন্টিতে জিততে গেলে।’

দীর্ঘদিন জাতীয় দলে খেলেছেন আফতাব। তার বয়সী অনেকেই এখনো বাইশ গজ মাতালেও তিনি ক্রিকেট ছিড়ে কোচিংয়ে থিতু হয়েছে। কোচিংয়ের সুবাদে বর্তমানে আরো বেশি পরিচিত ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোর সঙ্গে। ওপেনিং জুটি বা লিটন দাস, সৌম্য সরকারের যে সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেটি যৌক্তিক বলেই দাবি করছেন আফতাব। তবে আঙুল তুলে যেন বলতে চাইলেন, সৌম্য-লিটনদের বিকল্প কোথায়? বিকল্প তৈরি না হওয়ার যে ব্যর্থতা, সে দায় কে নেবে?

আফতাবের ভাষায়, ‘দেখেন আমরা কিন্তু মূল জায়গাগুলোতে কেউই নাই। সবাই কথা বলতে ব্যস্ত বাইরের বিষয়গুলো নিয়েই। দেখেন আজকে ওপেনিং নিয়ে এত কথা হচ্ছে, লিটন দাস, সৌম্য সরকার নিয়মিতভাবে রান পাচ্ছে না, তাদের জায়গায় আসলে কে খেলবে? তাদের রিপ্লেসমেন্ট যদি বাংলাদেশ টিমের না থাকে এই ব্যর্থতার দায় কে নেবে?’

আরো বলেন আফতাব, ‘লিটন দাস রান পাচ্ছে না তাকে দিয়ে আপনি বিশ্বকাপটা খেলালেন। কিন্তু এরপর পাকিস্তান সিরিজ। তার জায়গায় আপনি যে কাউকে ওপেন করাবেন, কিন্তু কাকে করাবেন? আপনি সৌম্যকে খেলাতে চাচ্ছেন না, কিন্তু তার পরিবর্তে কাকে খেলাবেন, নামটা বলেন? এই ব্যর্থতার দায় কে নেবে? আমার মনে হয় সবার আগে এই জবাবটা নেওয়া উচিত।’

এ বছর বিশ্বকাপ শেষ হলে বছর খানেকের মধ্যে আরো একটি বিশ্বকাপ। মধ্যপ্রাচ্যের কন্ডিশন অনেকটা বাংলাদেশের মতই। তবুও সুবিধা করতে পারল না দল। অস্ট্রেলিয়ায় নিশ্চয়ই আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে? ওই বিশ্বকাপের প্রস্তুতি কি আসন্ন পাকিস্তান সিরিজ দিয়েই শুরু করা উচিত? আফতাব বাতালেন সমস্যা নিধনের পথ।

আফতাব আহমেদ বললেন, ‘সবথেকে বড় যে ব্যাপারটা সেটি আমাকে আগে চিন্তা করতে হবে। দলের যে তিন-চারজন সিনিয়র ক্রিকেটার আছেন, তারা সর্বোচ্চ আর দুই-তিন বছর ক্রিকেট খেলবেন। আমি যদি চিন্তা করি যে আগামী ৩-৪ বছর আমাকে প্রত্যেকটা জায়গায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে, তাহলে এটা কষ্টদায়ক। আমার কাছে যেটা মনে হয়, ৩০ জন ক্রিকেটার নিয়ে একটি টিম তৈরি করতে হবে। আগামী ৩-৪ বছর তাদেরকে দিয়েই খেলাতে হবে। হার-জিত এটা বড় কোন বিষয় নয়। চিন্তাটা থাকবে এই ৩০ জন ক্রিকেটার থেকে আমি এমন ১৫ জনকে বের করব, যারা আমাকে আগামী বিশ্বকাপ অথবা বড় কোন টুর্নামেন্টে ভালো ফল এনে দিবে।’

টিআইএস/এমএইচ