বিধ্বস্ত? না, এই একটা শব্দ দিয়ে বাংলাদেশ দলের মানসিক অবস্থা ঠিক বুঝানো যাচ্ছে না। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের মনের ভেতর কী বয়ে যাচ্ছে সেটা শুধু তারাই ভালো জানেন। দেশ ছাড়ার আগে মাথা উঁচু করেই বলেছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে লক্ষ্য সেমি ফাইনাল। সেই মিশন বাছাই পর্বে প্রথম ম্যাচে হোঁচট খেলেও এরপরই ঘুরে দাঁড়ায় দল। জায়গা করে নেয় মূল পর্বে। কিন্তু এখানে কিছুই করা হচ্ছে না!


একটি-দুটি নয়, টানা তিন ম্যাচ হেরে সেমিতে উঠার স্বপ্নটা ভেঙেছে একদিন আগেই। সামনে আরও দুটি ম্যাচ। অপেক্ষায় দুই মহা শক্তিধর অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু তাদের মুখোমুখি হওয়ার আগে দল কী মনোবলটা পুরোটা হারিয়ে ফেলেছে? আনুষ্ঠানিকতার সেই দুই ম্যাচ নিয়ে আপাতত টিম ম্যানেজম্যান্ট ভাবছে কোথায়?

সামনে যখন আরও দুটি ম্যাচ তখন টানা দুই দিন বিশ্রামে থাকছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা। দলের মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমাম জানালেন, সামনের দুই দিন অনুশীলন করছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা। শনি-রোববার বিশ্রাম। সোমবার দল দুপুর ২টা থেকে অনুশীলন করবে দুবাইয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) একাডেমি মাঠে।

হয়তো এখনো ক্রিকেটারদের মাথায় টানা হারের হিসাব-নিকেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতার কাছে গিয়েও মিলেনি সমীকরণ। প্রতিপক্ষকে ১৪২ রানে আটকে রেখে জয়ের কাছাকাছিই ছিল দল। মনে হচ্ছিল সেমির আশা বাঁচিয়ে রাখবেন সাকিব-মুশফিকরা। শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের উইকেট মন্থর। তাই বলে এখানে ২০ ওভারের ম্যাচে ওই রান টপকে যাওয়াটা মিশন ইমপসিবল নয়। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপটাও তো বেশ লম্বা। কিন্তু উইকেট বাঁচিয়ে রাখলেও ম্যাচটা বাঁচানো হয়নি। 

শেষ ওভারে ১৩ আর শেষ বলে ৪ রান তুললেই ম্যাচটা জেতা হয়ে যেত। কিন্তু পারলেন না মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শুক্রবার রাতে আত্মপক্ষ সমর্থনের পথে না হেঁটে আত্মসমর্পনই করলেন। ৩ রানে হারের পর বললেন, ‘শেষ বলটা আমি জানতাম যে, আন্দ্রে রাসেল ব্লক হোলে করবে। কারণ, লেগ সাইডে যেহেতু চারটা ফিল্ডার ছিল। আগের দুইটা বলও ভালো ইয়র্কার করেছিল, সেগুলো আমি তুলতে পারিনি। এটা আমার দোষ, আমি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারিনি ওই শেষ বলটায়।’

গত কয়েক দিন পালিয়ে বেড়ালেও শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে দেখা মিলল রিয়াদের। এর আগে জুনিয়র ক্রিকেটার আর কোচদের পাঠিয়ে নিজেরা আড়ালেই ছিলেন। আসলে মাঠ ও মাঠের বাইরে এতসব বিতর্কের মাঝে মুখ বন্ধ রাখাটাই শ্রেয় মনে করেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। যখন সাফল্য আসে না, তখন চারপাশ থেকেই সমালোচনার ঝড় উঠে। তার ওপর ‘শব্দ বোমা’য় একে অন্যকে আক্রমণ তো চলছিলই। 

অথচ এই মাহমুদউল্লাহ বাংলাদেশ ছাড়ার আগে ঢাকার এমন কোন পত্রিকা, টেলিভিশন আর অনলাইন বাকি রাখেননি যেখানে তিনি 
‘একান্ত’ সাক্ষাৎকার দেননি। কিন্তু বিশ্বকাপের মাঠে এসে হিসাবটা যখন মিলছিল না, তখন আড়ালেই ছিলেন। তবে তার আগে বিতর্কটা কিন্তু উস্কে দেওয়ার পেছনে তার ভূমিকাটাও কম নয়। বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন, বাছাই পর্বে স্কটল্যান্ডের কাছে হারের পর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। যেটা কাঙ্ক্ষিত ছিল না অনেকের কাছেই। তার প্রতিক্রিয়ায় খোদ মাহমুদউল্লাহ জানিয়ে রেখেছিলেন, তারা রক্ত-মাংশের মানুষ। এমন সমালোচনার উত্তাপ তো গায়ে লাগবেই!

এরপর অনেক জল গড়িয়েছে। মাঠে একের পর এক ভুল করেছে বাংলাদেশ, উত্তাল হয়ে বিতর্ক, কথার ঝড়। ক্রিকেটে আর ফিরতে পারেনি বাংলাদেশ। যার সবশেষে নজির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হার। টি-টোয়েন্টি এমনিতেই দলটির অবস্থায় নড়বড়ে অনেক দিন ধরেই। দেশের মাঠে মিরপুরের উইকেটে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারানো যে বেঞ্চমার্ক নয়, সেটা তো এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতেই দেখা মিলছে। 

কেন এমন হচ্ছে, কেন ব্যাট করতে ভুলে যাচ্ছেন দেশসেরা ব্যাটসম্যানরা। দল যখন জয়ের স্বপ্ন বুনছে তখন কেন সহজতম ক্যাচ ফেলছেন ফিল্ডাররা? তামিম ইকবালের এমন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিংয়ে উন্নতি প্রসঙ্গে মাশরাফি বিন মতুর্জা দিয়েছেন লাগসই এক পরামর্শ। যার সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন।

মাশরাফি বলছিলেন, ‘আমাদের সবাইকে আরেকটু সাহসী হতে হবে। ফিল্ডিংটা হচ্ছে অনেক সাহসী একটা ব্যাপার। আর সত্যি বলতে, আমার কাছে মনে হয় বর্তমান প্রেক্ষাপটে, যেকোনো টুর্নামেন্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব খেলোয়াড়ের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করা উচিত। আমি এটা আমার সময়ে করতে পারিনি, তাই হয়তো বলা ঠিক না। কিন্তু বিসিবি থেকে কঠোর নিয়ম করা উচিত এ বিষয়ে। কারণ, যে চাপগুলো আসে, এগুলো সম্পূর্ণভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আসে। আজকাল খুব বাজেভাবে ক্রিকেটারদের আক্রমণ করা হয়। যদি ক্রিকেটাররা সেটা সহ্য করতে পারত, তখন ভিন্ন হিসাব হতো। কিন্তু এখন তো ক্রিকেটাররা এগুলো নিতে পারছে না।’

তার মানে অন্তর্জালে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রামে ব্যস্থতা ক্ষতির কারণ হয়েই দাঁড়াচ্ছে। যখনই ওইসব প্লাটফর্মে চোখ যায় চাপটাও বেড়ে যায়। আর সেই চাপ নিতে না পেরে মাঠে একের এক ভুল করে যান ক্রিকেটাররা। যেমনটা হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে। কে জানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আর টিম ম্যানেজম্যান্ট কী ভাবছে! সর্বাঙ্গে যখন ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা-এমন করে ভাবলেই বরং ভালো। খোলনলচে সব পাল্টে ফেলার এইতো সময়!

এটি/এমএইচ