পাঁচ বছরে যেভাবে বদলে গেল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট
বেজে গেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগমনী বাঁশি। সর্বশেষ এই দ্বৈরথ দেখা গিয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর চলে গেছে অনেক সময়। বদলে গেছে অনেক কিছু। তেমনি বদলের হাওয়া লেগেছে টি টোয়েন্টিতে। ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম এই ফরম্যাট দিনে দিনে হয়ে উঠেছে আরও প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ।
বদলে গেছে চার-ছক্কার পরিসংখ্যান
ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা ডট বল এড়াতে এক ও দুই রান নেওয়ায় বেশ মনোযোগী থাকেন। এতে বাউন্ডারি না আসলেও তেমন একটা চাপে পড়ে না দল। কিন্তু ২০ ওভারের খেলায় এক রানের চেয়ে চার ছক্কায় অধিক কার্যকরী। আর ব্যাটসম্যানরাও বেশ মানিয়ে নিয়েছেন এই ছক্কা সংস্কৃতির সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
২০১৬ বিশ্বকাপের শেষ আটের খেলাগুলোয় চ্যাম্পিয়ন দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রতি ১৬.৩ বল পরপর হাঁকিয়েছিল ছক্কা। সেখানে এই রাউন্ডে অন্য দলগুলো প্রতি ২২.৫ বলে মেরেছিল একটি ছয়। ২০১৬ এর পর মাঠে গড়ানো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আইপিএলের আসরগুলোতেও দেখা গেছে ব্যাটসম্যানদের এই আক্রমণাত্মক মেজাজ। পরিসংখ্যান বলছে সর্বশেষ আসরগুলোতে ছক্কাপ্রতি বলের অনুপাত ছিল ২০ এর নিচে।
বলা হয় রানের খেলা টি-টোয়েন্টি। ছক্কা হোক কিংবা চার এই ফরম্যাটে সফল হতে বাউন্ডারির বিকল্প নেই। সবচেয়ে বেশিবার আইপিএলের শিরোপা ঘরে তোলা মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের একটি ক্ষুদ্র পরিসংখ্যান দেখলেই স্পষ্ট হবে বিষয়টি।
সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর তিনবার আইপিএলের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মুম্বাই। ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে সেরার মুকুট পরে রোহিত শর্মার দল। প্রতিটি টুর্নামেন্টেই মাঝের ওভারগুলোতে তাদের বাউন্ডারি রেট ছিল যথাক্রমে ৫৪.৮%, ৫৩.৩% এবং ৫৬.২%। সেই তিনটি মৌসুমে অংশ নেওয়া বাকি দলগুলোর এই হার ছিল যথাক্রমে ৫২.৫%, ৫২.২% এবং ৪৯.১%। অর্থাৎ মর্ডান ডে ক্রিকেটে মাঝের ওভারগুলোতে যে দল বেশি বাউন্ডারি বের করতে সক্ষম হচ্ছে তারাই লাভবান হচ্ছে।
বৈচিত্রই মূল অস্ত্র
বোলারদের জন্য সবচেয়ে কঠিন খেলা মনে করা হয় এই টি-টোয়েন্টিকেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকে টি টোয়েন্টির আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত একরকম গদবাধা বোলিংই করে গেছেন পেসার ও স্পিনাররা। পেসারদের ক্ষেত্রে পরিচিত কিছু ডেলিভারি ছিল ইন স্যুইং, আউট স্যুইং, অফ কাটার, লেগ কাটার, রিভার্স স্যুইং এবং বাউন্সার। কালে-ভদ্রে হয়তো একটা স্লোয়ার করতেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, শন পোলক, শোয়েব আখতার, ব্রেট লিরা।
স্পিনারদের ক্ষেত্রেও ছিল অনেকটা একই চিত্র। আশির দশকের আগে ট্রেডিশনাল অফ ও লেগ স্পিনের বাইরে তেমন একটা বল করতে দেখা যায়নি কোন স্পিনারকে। তবে ভুলে গেলে চলবে না খোদ খেলোয়াড়রাই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারক। পাকিস্তানের সাকলাইন মুশতাক ও শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরনের ‘দুসরা’ ছিল এক নতুন সংযোজন। এরপর ধীরে ধীরে বিশ্ব দেখে টপ স্পিন, ফ্লিপার, ক্যারম বল, আর্ম বল। পেসাররা আবিষ্কার করেন নাকল বল, ব্যাক অফ দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার, স্লো বাউন্সার।
বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর কল্যাণে প্রায় সারাবছরই এই ফরম্যাটের অনুশীলন হয়ে থাকে ব্যাটসম্যানদের। মাত্র ২০ ওভারের খেলা হওয়ায় তারা ছাড় দেন না একটি বাজে বলেও। ভালো বলেও বাউন্ডারি মারাটা রপ্ত করে ফেলেছেন অধিকাংশ ব্যাটসম্যান। তাই বৈচিত্র্যে তাদের বিভ্রান্ত করতে না পারলে টিকে থাকাটা খুবই মুশকিল এই ফরম্যাটে।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিং সহায়ক বা স্পোর্টিং উইকেটে বাংলাদেশি বোলারদের বেহাল দশা। বৈচিত্রকে কখনোই খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এদেশের ক্রিকেটে। ক্রিকেট একাডেমিগুলোর ট্রেনিং সেশনেও কোচরা উঠতি বোলারদের লাইন লেন্থের উপর বেশি গুরুত্ব দিতে বলেন। এমন শিক্ষা টেস্ট ক্রিকেট উপযোগী হলেও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভালো লেন্থের বলও মাঠের বাইরে পাঠাতে পারেন ব্যাটসম্যান। মুস্তাফিজুর রহমানের কল্যাণে টাইগার বোলাররা এখন বৈচিত্রের গুরুত্ব কিছুটা বুঝতে পারলেও তা যেন পেসারদের মাঝেই সীমাবদ্ধ।
এবারের বিশ্বকাপে খেলবেন এমন বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান বোলার। এই তালিকায় সবার উপরে থাকবেন ভারতের রবীচন্দ্রন অশ্বিন। ডানহাতি এই অফ ব্রেক বোলার করতে পারেন পাঁচ থেকে ছয় রকমের বল। কাটার মাস্টার মুস্তাফিজও গড়ে দিতে পারেন ব্যবধান।
কবজির জোরে বাজিমাত
গত দশকের আগ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে জয় জয়কার ছিল ফিঙ্গার স্পিনারদেরই (আঙ্গুলের সাহায্যে বল টার্ন করান যারা)। টার্ন কম হলেও লাইন লেন্থ নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলক সহজ ফিঙ্গার স্পিনারদের জন্য। অন্যদিকে রিস্টস্পিনে(কবজির সাহায্যে বল টার্ন করানো) বলের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কিছুটা কঠিন হলেও টার্ন পাওয়া যায় বেশি। বৈচিত্রও বেশি এই ধরণের বোলিংয়ে।
কবজির ব্যবহার করেই মূলত লেগ ব্রেক, ফ্লিপার, গুগলি, স্লাইডার, টপ স্পিন করে থাকেন বোলাররা। গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রুর জন্য সব দলই এই ধরনের বোলারদের উপর ভরসা করে থাকে। একমাত্র বাংলাদেশ বাদে সব দলের বিশ্বকাপ স্কোয়াডেই রয়েছে এক বা একাধিক রিস্ট স্পিনার।
গত দশকে বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়েছেন বেশ কয়েকজন রিস্ট স্পিনার। ইমরান তাহির, যুভেন্দ্র চাহাল, আদিল রশিদ, রশিদ খানদের উত্থান সেই সময়েই। এই বিশ্বকাপেও নজর থাকবে ভারতের বরুণ চক্রবর্তি, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পাদের উপর।
বোলারদেরও জানতে হবে ব্যাটিং
আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ক্রমেই কমে আসছে অলরাউন্ডারদের প্রয়োজনীয়তা। পাঁচজন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান, একজন উইকেটকিপার এবং পাঁচজন স্পেশালিস্ট বোলার নিয়ে খেলে থাকে অনেক দল। এজন্য বোলারদেরও ব্যাট হাতে পালন করতে হয় কিছুটা ভূমিকা। বিগত বছরগুলোর আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সে সুনীল নারিন ব্যাট হাতেও পালন করেছেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
আরও অনেক দলেই দেখা যায় এমন চিত্র। আফগানিস্তানের রশিদ খান, ইংল্যান্ডের জোফরা আর্চার, অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্সরা বল হাতে যেমন উইকেট নিতে পারেন তেমনি ব্যাট হাতেও সীমানাছাড়া করতে পারেন বল। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও ব্যাট হাতে সময়ে সময়ে হয়ে উঠতেন বেশ ভয়ঙ্কর। জাসপ্রিত বুমরাহের মত অসাধারণ প্রতিভা ছাড়া বর্তমানে ব্যাটিং জানা বোলারদেরই অধিক কার্যকর মনে করা হয় টি টোয়েন্টিতে।
সময়ের পালাবদলে হয়তো আরও বদলাবে ক্রিকেট। তবে ক্রিকেটের স্বার্থেই প্রয়োজন এমন গঠনমূলক পরিবর্তন। এমন পরিবর্তনকে ঘিরেই জন্ম নেয় অসাধারণ সব প্রতিভা।
এআইএ/এমএইচ