মাহমুদউল্লাহর টেস্ট অবসর, শেষ হয়েও হইল না শেষ!
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে এমন সৌভাগ্য কজন ক্রিকেটারের হয়েছে? আঙুলের কর গোনার প্রয়োজন পড়বে না। যারা টাইগার ক্রিকেট নিয়ে একটুআধটু খোঁজখবর রাখেন, তারা নিমিষেই বলে দিতে পারবেন মাঠ থেকে ঘটা করে অবসর নিতে পারা বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারের নাম। এই সৌভাগ্য একজনেরই আছে, তিনি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেননি তিনি। তবে টেস্ট ফরম্যাট থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।
দীর্ঘদিন পর টেস্ট দলে ফিরেই জিম্বাবুয়ের হারারেতে ১৫০ রানের রাজসিক এক ইনিংস খেলেন মাহমুদউল্লাহ। সেটি ছিল তার ৫০তম টেস্ট। এই দেড়শ রানের ইনিংসটিই তার সাদা পোশাকের ক্যারিয়ারে সেরা ইনিংস। অথচ প্রত্যাবর্তনের এমন ছবি একেও বিষাদে ভরিয়ে দিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটকে, হারাতে টেস্টে সেঞ্চুরির পর ড্রেসিংরুমে সরীর্থদের জানিয়ে দেন টেস্ট ক্রিকেট ছাড়ার কথা। দীর্ঘদিন পর মাহমুদউল্লাহর অবসর ইস্যুতে নাটক জমেছে বেশ। বলতেই হয়, শেষ হয়েও হইল না শেষ!
বিজ্ঞাপন
মাহমুদউল্লাহ সতীর্থদের অবসরের বিষয়টি অবগত করেন হারারে টেস্টের তৃতীয় দিন সকালে। জিম্বাবুয়ে সময় বিকেল নাগাদ সে খবর ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে, তখন শেষ হয় তৃতীয় দিনের খেলা। এরপর রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেটে। খোদ বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এনিয়ে কথা বলেন।
সে সময় পাপন বলেন, ‘আমাকে অফিশিয়ালি কেউ কিছু বলেননি। তবে একজন ফোন করে জানিয়েছে, এই টেস্টের পর আর সে টেস্ট খেলতে চায় না। ড্রেসিংরুমে নাকি সবাইকে সে এটা বলেছে। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক লেগেছে। খেলা তো এখনো শেষ হয়নি! আমার ধারণা, সে হয়তো আবেগের বশে বলেছে।’
পাপন জানিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে কথা বলে ইতিবাচক একটি সুরাহা করবেন। অথচ সেই সুরাহা করার আগেই ঘটে গেল মস্তবড় কাণ্ড! হারারে টেস্টের পঞ্চম দিন সকালে বেশ ঘটা করে মাহমুদউল্লাহকে গার্ড অব অনার দেন তার সতীর্থরা। মাহমুদউল্লাহর মাঠ থেকে নেওয়া বিদায়ের সাক্ষী হয়ে থাকে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। অথচ বিসিবি বলছে, এ আনুষ্ঠানিকতা তাদেরকে না জানিয়ে হয়েছে।
যে ম্যাচ খেলে মাহমুদউল্লাহ অবসরের ঘোষণা দিলেন, সে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার ওঠে তারই হতে। সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। তবে মুখ তখনকার মতো এখনও মুখ খোলেননি অবসর ইস্যুতে।
জিম্বাবুয়ে সফর শেষ করে দেশে ফিরেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে নামে টাইগাররা। এই ফরম্যাটের অধিনায়ক খোদ মাহমুদউল্লাহ, সে সুবাদে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। তবে অবসর ইস্যুতে প্রশ্ন উঠলেই সোজা জানিয়েছেন, ‘আশা করি আপনারা এই বিষয়ে খুব জলদিই জানতে পারবেন।’ তবে সেই অপেক্ষা আর ফুরোচ্ছে না সংবাদকর্মী, সমর্থক, এমন কি বোর্ডেরও!
মাহমুদউল্লাহর টেস্ট অবসরের প্রায় দুই মাস হতে চললো, তবে ঠিক কি কারণে তার সাদা পোশাক তুলে রাখার সিদ্ধান্ত, সে প্রশ্ন সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দেয়। সুযোগ বুঝে প্রশ্নটি উঠলো আরও একবার। বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) বসেছিলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ১১তম সাধারণ সভা। সেখানে ক্রিকেটারদের কেন্দ্রীয় চুক্তির বিষয়টির সুরাহা হয়। সভা শেষে বোর্ড সভাপতির কাছে জানতে চাওয়া হয়, রিয়াদ টেস্ট খেলবে জানিয়ে এই ফরম্যাটে কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তবে কি এমন হলো তিনি বিদায় বলে দিলেন?
নাজমুল হাসান পাপন অবশ্য মাহমুদউল্লাহর টেস্ট থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যাপারটি মানতে নারাজ। সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের বানে জর্জরিত হয়ে হোক বা আনমনে, এক ফাঁকে বলেই ফেললেন, মাহমুদউল্লাহ অবসর ‘নেননি।’ সংবাদ সম্মেলনে পাপনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিচালকও হাতের ইশারায় বোঝাতে চাইলেন, ‘না, মাহমুদউল্লাহর টেস্ট থেকে অবসর নেননি।’
পরে নিজেকে সামলে নিয়ে পাপন যেটি বললেন তার মর্মার্থ দাঁড়াল, টানা সিরিজ আর জৈব সুরক্ষা বলয়ের জন্য মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে এই ইস্যুতে আলোচনা সারতে পারেনি বোর্ড। তার অবসরের বিষয়টা এখনো ‘পেন্ডিং’ আছে। যেহেতু তার অবসরের সুরাহা এখনো হয়নি, এজন্য টেস্ট ফরম্যাটের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে রাখা হয়নি এই ব্যাটিং অলরাউন্ডারকে।
পাপন আক্ষেপ করে জানালেন, প্রায় ১৬ মাস পর মাহমুদউল্লাহকে টেস্ট দলে তিনিই ফিরিয়েছিলেন। পাপনের ভাষায়, ‘টেস্ট দলে ছিল না। ওকে আমার বাসায় নিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করেছি, টেস্টে সে আগ্রহী কি না? জানা মতে, তিন সংস্করণের মধ্যে সে সবচেয়ে উপযুক্ত টেস্টে। সে আমাকে প্রতিবার বলেছে খুব আগ্রহী টেস্ট খেলতে। আমরা বলেছিলাম কে কোন সংস্করণ খেলবে লিখে দাও। সে লিখে দিয়েছে টেস্ট খেলবে দলে নেওয়া হলে।’
অনেকের ধারণা অনেকটা জেদের বসেই অবসর বা টেস্ট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। টেস্ট ক্রিকেটে তাকে ‘অচল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন টাইগারদের সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। তাতে সমর্থন দিয়েছিলেন কয়েকজন বোর্ড পরিচালক। এরপর টেস্টে ফেরার জন্য দৃঢ় হন মাহমুদউল্লাহ। কিছু ‘করে দেখানোর’ জেদ ছিল তার। হারারে টেস্ট সবই মিলে যায় ব্যাটে-বলে। আচমকা বিদায় বলে দেন সাদা পোশাকের ক্রিকেটকে।
তবে চাইলেও সহসা এখান থেকে ‘বিদায়’ হতে পারছেন না মাহমুদউল্লাহ। তার সিদ্ধান্ত এখনো ‘পেন্ডিং’ অবস্থায় আছে বিসিবিতে। এতে জোর দিয়েই বলে যায় মাহমুদউল্লাহর টেস্ট অবসর, শেষ হয়েও হইল না শেষ!
টিআইএস/এনইউ