দেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো দেখভাল করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। বাজেট স্বল্পতায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনগুলোকে খুব বেশি আর্থিক সাহায্য করতে পারে না। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বাজেট সীমিত ; নিজস্ব আয়ও কম। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয়ের অন্যতম খাত গেটমানি ও প্রচার স্বত্বের উপর লভ্যাংশ। একমাত্র ক্রিকেট ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো ফেডারেশন গেটমানি ও প্রচারস্বত্ত্বে সেভাবে আয় করতে পারে না। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আবার ক্রিকেট বোর্ডের এই দুই খাত থেকে নিয়মিত ভিত্তিতে অর্থ আদায় ব্যর্থ।

১৯৯১ সালে মন্ত্রীপরিষদ সভায় একটি সিদ্ধান্ত হয়  গেটমানি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ১৫ শতাংশ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে দিতে হবে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনকে। এই সিদ্ধান্ত হওয়ার ১৬ বছর পর এই খাত থেকে প্রথম অর্থ পায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে গেট মানি ২৮ লাখ টাকা দেয়। এ যাবত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে ১ কোটি ৯ লাখ ৩২ হাজার ৩৭৫ টাকা পেয়েছে (২০১৬ পর্যন্ত) । 

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখন দেশের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া সংস্থা। গত এক যুগের বেশি সময় ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোনো অনুদান গ্রহণ করে না। নব্বইয়ের দশকে এক সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থে ক্রিকেট কোচের বেতন দেয়া হতে। 

২০০৮ সালে সেনা শাসনের সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নিজস্ব একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রচারস্বত্ত্বের উপর ভ্যাট, ট্যাক্স, সব কর্তনের পর নীট আয়ের ১০ শতাংশ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনগুলোকে পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ছাড়া দেশের অন্য কোনো ফেডারেশনের টিভি স্বত্ব, মার্কেটিং চুক্তি খুব বড় অংকের হয় না। ফলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডই একমাত্র সম্বল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। 

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আয়ের অন্যতম খাত গেটমানি ও প্রচার স্বত্বের লভ্যাংশ হলেও দেশের ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এই ব্যাপারে একটু নিশ্চুপ ভূমিকায়। ২০১৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে এই খাতের জন্য ২০১২ সাল পর্যন্ত অর্থ দাবি করে সর্বশেষ চিঠি দেয়। সেই চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে এই দুই খাতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পাওনা কয়েক কোটি টাকা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওই সময়ের সচিব ও অর্থ কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে টিকিট বিক্রি ও প্রচারস্বত্ত্বের প্রকৃত আয়ের তথ্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জানতে পারে না। মিডিয়া রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একটি আনুমানিক হিসেব করে। 

২০১৭ সালে সর্বশেষ চিঠির পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড মাসখানেকের মধ্যে একবার ৫০ লাখ আরেকবার ৩০ লাখ টাকা প্রদান করে। ২০১২ সাল পর্যন্ত হিসেবের একটি মধ্যস্থতা বা সমঝোতা হলেও এর পর থেকে আর এই সংক্রান্ত বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোন লেনদেন বা চিঠি চালাচালি নেই। 

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘গেটমানি ও প্রচার স্বত্ব নিয়ে আমাদের মধ্যে ২০১৭ সালে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আমাদের উপর গেটমানির অর্থ প্রত্যাশা করে। সব সিরিজে আমাদের জন্য লাভজনক হয় না। অনেক সিরিজ আমাদের ক্ষতি হয়। আরেকটি বিষয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের প্রচুর ব্যয় হয়। এই বিষয়টিও গেটমানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রচারস্বত্ত্বের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নয়। এটি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি সিদ্ধান্ত।’ অন্যদিকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দাবি, ক্রিকেট স্থাপনার বড় কাজগুলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে করতে হয়। 

দুপক্ষের যুক্তি পাল্টা যুক্তির পর ২০১৭ সালে আলোচনা হয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে বাৎসরিক অর্থ দেবে বিসিবি। এরপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আর চিঠিও দেয়নি, বিসিবিও অর্থ দেয়নি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব পদ সাধারণত ৩ বছর। বর্তমান সচিব মাসুদ করিম চার বছর এই পদে। তিনি সচিব থাকাবস্থায় এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি দেননি বিসিবিকে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ক্রিকেট বোর্ডের প্রাপ্ত অর্থ আমাদের অন্যতম আয়। এটি অবশ্য অনেক দিন থেকে অনিয়মিত আয়ের খাত। আমরা এই ব্যাপারে ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করব।’

ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন সুজন বাৎসরিক বিষয়টি সুনির্দিষ্ট হওয়ার পক্ষে, ‘আলোচনা ছিল আমরা বছরে একটি অঙ্ক দেব। কিন্তু কত দেব তারা কত পাবে সেটা সুনির্দিষ্ট হয়নি। এটা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন।’ 

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রাপ্য অর্থ গত কয়েকবছরের মধ্যে না দিলেও কয়েকটি ফেডারেশনকে অনুদান দিয়েছে। ক্রীড়া পরিষদের অনুমান তাদের অর্থ হয়তো ক্রিকেট বোর্ড অন্য ফেডারেশনকে অনুদান হিসেবে দিচ্ছে। এই বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন ক্রিকেট বোর্ডের সিইও, ‘এটা অবশ্যই না। আমাদের সাথে দেশের সকল ফেডারেশনের সুসম্পর্ক। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়ন ও পারস্পরিক সম্পর্কে আমরা বিগত সময়ে কয়েকটি ফেডারেশনে অনুদান দিয়েছি। এটার সাথে এনএসসির দেনা পাওনার কোনো সম্পর্ক নেই। এনএসসির যেটা প্রাপ্য আমরা সেটা অবশ্যই দেব।’ 

ফুটবল ফেডারেশন বাদে দেশের সব ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনীত দুইজন সদস্য থাকেন। ক্রিকেট বোর্ডে অবশ্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা তিন। অন্যান্য ফেডারেশনের সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনীত পরিচালকদের একটু পার্থক্য রয়েছে। সকল ফেডারেশনে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ২ জন সদস্য মনোনীত করে আর ক্রিকেট বোর্ডে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাবস্থায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তাদের পরিচালক মনোনীত করে। আগের মেয়াদে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কতৃক মনোনীত পরিচালক ছিলেন। 

গেটমানি বাবদ বিসিবির প্রদেয় অর্থ -

৮/১০/২০০৭   ২৮,৭৫,৫২৭
২৬/০১/২০০৯  ৩০,৫৫,৮৪৭
০৭/০৬/২০১২   ২৫,০০,০০০
১৩/০১/২০১৬   ২৫,০০,০০০
২০১৭ (দুই বার)  ৮০,০০,০০০ 
মোট- ১,৮৯,৩২,৩৭৫ টাকা

#পুরো বিষয়টি নিয়ে বিসিবিকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দিয়েছে ১২টি চিঠি (১৯৯১-২০১৭)

এজেড/এটি/এনইউ