পাবজি, এসপিসি, ই-অরেঞ্জ: গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন মাশরাফি-তামিমরা?
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা কারা? এমন তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন ক্রিকেটাররা। দিন দুয়েক আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক জালাল ইউনুস যেমন বলছিলেন, ‘নিউজিল্যান্ডে ওদের নামকরা ক্রিকেটাররা রাস্তা দিয়ে গেলেও কেউ চেনে না, কথাও বলে না। এখন আমাদের মূল একাদশের একটা খেলোয়াড় বাইরে গেলে, রাস্তায় গেলে কত ভিড় হয়ে যাবে।’
ক্রিকেট এদেশের মানুষের হৃদয়ে। ক্রিকেটকে ভালোবেসে সমর্থকরা ক্রিকেটারদের বসিয়েছেন ‘দেবতা’র আসনে। এই জনপ্রিয়তার ফায়দা নিচ্ছেন ক্রিকেটাররা। নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপনের বাজারে হাঁকাচ্ছেন উচ্চ দর। কোনো রকম বিবেচনা ছাড়াই নামি-বেনামি, অখ্যাত সব পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবালদের।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপনের বাজারে ‘পাবলিক পালস’ বেশ ভালোই জানা আছে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর। চিত্রনায়ক শাকিব খানের পরিবর্তে জাতীয় ক্রিকেট দলের নবীন কোনও মুখকেও বিজ্ঞাপনী চিত্রে ব্যবহার করতে পারলে খুব সহজেই ভোক্তার দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব। বর্তমান সময়ে এমন পরিস্থিতিও দেখা যায় যে, টেলিভিশনে কোনও ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে বসলে নির্দিষ্ট ক্রিকেটারকে যতক্ষণ না বাইশ গজে পারফর্ম করতে দেখা যায়, তার থেকে বেশি সময় দেখা যায় মাঝের বিজ্ঞাপন বিরিতিতে!
বিজ্ঞাপন ইস্যুতে বিতর্ক নতুন নয়। এই বাজারে চড়া মূল্য সিনিয়র ক্রিকেটারদের, তবুও বারবার যেন ভুলগুলো তারাই বেশি করে বসেন। কোনও বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি খেলোয়াড়রা সরাসরি নিজে সারেন না। থাকে একাধিক অ্যাজেন্ট, তারাই বিষয়াদি, টাকা-পয়সার হিসাব নির্ধারণ করেন। সেটি খেলোয়াড়রা ব্যক্তিগত আইনজীবীকে দেখিয়ে তবেই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। যেখানে ভুল হওয়ার সুযোগ থাকে সামান্যই। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞাপন ইস্যুতে কাঠগড়ায় ক্রিকেটাররা। তাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ।
সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার বিষয়টিই ধরা যাক। ‘এসপিসি গ্রুপ’ নামক এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করেছিলেন। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সফলতম অধিনায়ককে নিজেদের ‘শুভেচ্ছা দূত’ হিসেবে পেয়েছিল গ্রুপটি। চুক্তির বিনিময়ে তার এলাকা নড়াইলে ১০০টি সিসিটিভি স্থাপনসহ আরও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করার কথা ছিল এসপিসি গ্রুপের, এ কারণেই অনেকটা অপরিচিত এই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন মাশরাফি। সাবেক এই অধিনায়ক তেমনটিই দাবি করেছেন।
চুক্তির বিনিময়ে তার এলাকা নড়াইলে ১০০টি সিসিটিভি স্থাপনসহ আরও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করার কথা ছিল এসপিসি গ্রুপের, এ কারণেই অনেকটা অপরিচিত এই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন মাশরাফি। সাবেক এই অধিনায়ক তেমনটিই দাবি করেছেন।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করা ‘এসপিসি গ্রুপ’ চুক্তির পর থেকেই মাশরাফিকে নিজেদের ‘ব্র্যান্ড এম্বাসেডর’ দাবি করে চকটদার বিজ্ঞাপন প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটির কাজের ধরণ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও নেহায়েত কম হয়নি। এই ইস্যুতে ভোক্তাদের তোপের মুখে পড়তে হয় মাশরাফিকে।
পরে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে মাশরাফি জানান, ‘এসপিসির সঙ্গে চুক্তি ছিল আমাদের সিসি ক্যামেরা দেবে। সেটাও আমরা এসপির অধীনে দিয়ে দিয়েছি। সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য চুক্তি করেছিলাম। দুই মাসের ভেতর বের হয়ে এসেছি। এরপর উনাকে উকিল নোটিশ দিয়ে মামলা করেছি। আমরা পরে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছি যে আমার চুক্তির সময়ের কেউ যদি অর্থ দাবি করে, তাহলে দিতে হবে।’
সম্প্রতি ই-অরেঞ্জ নামে একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মাশরাফির চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়েও পণ্য দিচ্ছে না বলে দাবি করা হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা এরপর মাশরাফির বাড়ির সামনেও জড়ো হন। তাদের সঙ্গে দেখা করেন মাশরাফি। এরপর ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন এই সংসদ সদস্য। আরেকবার নতুন করে বিতর্কের মুখে মাশরাফি।
নিজের অবস্থান ব্যাখ্যায় সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, ‘ই-অরেঞ্জের সঙ্গে আমার ছয় মাসের চুক্তি ছিল। সেটা শেষ হয়েছে। আমি এখন এটির সঙ্গে নেই। তবুও একজন গ্রাহক যেখান থেকে বলছে, তাদের পাশেই আমাকে থাকতে হবে। এটার তো আইনগত জায়গায় খুব বেশি কিছু করার নেই। তবুও সাধারণ মানুষের কারণে কথা বলেছি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তাদের পাশে দাঁড়াবো।’
আরও জানান মাশরাফি, ‘সাধারণত যখন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সিইও এসে চুক্তি করে। আমার এজেন্ট নাফিসের মাধ্যমে সাজু ভাই যিনি নাটক করে উনি এসেছিলেন। এরপর চুক্তি করেছি।’
এদিকে বর্তমান ওয়ানডে দলের অধিনায়ক তামিম ইকবাল অনলাইন গেমস পাবজির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। এই গেমস নিয়ে আছে বিতর্ক। ‘পাবজি খেলতে খেলতে উত্তেজনায় কিশোরের মৃত্যু’, ‘টানা ৬ ঘন্টা পাবজি গেমস খেলে কিশোরের মৃত্যু’, ‘পাবজি খেলতে না পেরে ইন্টারনেটের তার কাটতে গিয়ে ছাত্রের মৃত্যু’- এমন শিরোনাম সংবাদের পাতায় দেখা যাচ্ছে নিয়মিতই।
এমন কি দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজির মতো ক্ষতিকারক গেম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবুও নিশ্চুপ তামিম। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমর্থকদের ভর্ৎসনা শিকার হতে হচ্ছে।
এমন কি দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজির মতো ক্ষতিকারক গেম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবুও নিশ্চুপ তামিম। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমর্থকদের ভর্ৎসনা শিকার হতে হচ্ছে।
একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ২০১৯ সালে টেলিকম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন সাকিব আল হাসান। চুক্তির খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পর বিসিবি অভিযোগ করে তাদরেকে না জানিয়েই সাকিব গ্রামীণফোনের সঙ্গে এই চুক্তিটি করেছেন এবং এর মাধ্যমে সাকিব বিসিবির সাথে তার চুক্তির বরখেলাপ করেছেন। এজন্য সাকিবকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয় বোর্ড। এই চুক্তির কারণে ওই সময়ের জাতীয় দলের স্পন্সর রবি বারবার নোটিশ দিয়ে প্রতিকার না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সরর দাঁড়ায়।
ক্রিকেটারদের এমন ভুতূড়ে সব বিজ্ঞাপনী চুক্তি নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে বৈকি। পাবজি, এসপিসি, ই-অরেঞ্জ কাণ্ডের পর খেলোয়াড়দের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সাকিব, তামিম, মাশরাফিরা সেটিকে আরও নিচে নামতে দিতে চাইবেন না নিশ্চয়ই?
টিআইএস/এটি