সুজনের সঙ্গেই সবার ঝগড়া বাধে কেন?
ফেব্রুয়ারি, ২০২১। কক্সবাজার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে চলছে বাংলাদেশের সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের নিয়ে লিজেন্ডস চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। মিলনমেলার এই ক্রিকেট লিগে আনন্দটাই মুখ্য, সেখানেই কি না কিংবদন্তি ক্রিকেটার, ম্যাচ রেফারি রকিবুল হাসানকে মারতে গেলেন তারই অনুজ এক ক্রিকেটার! অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে আশপাশ থেকে অন্যরা না আটকালে চরম ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটতে পারত।
জুন, ২০২১। এবার দুটি ঘটনা। প্রথমটা তো রীতিমতো আন্তর্জাতিক শিরোনাম। মাঠে তর্কের এক পর্যায়ে সাকিব আল হাসানকে মারতে তেড়ে যান ওই একই ব্যক্তি। সাকিবও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সেই ম্যাচে পাল্টা জবাবে আস্তিন গুটিয়ে ফেললেন। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে উত্তাপ ছড়াল মিরপুরের শেরেবাংলায়। দৃষ্টিকটু সেই ঘটনা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
সবশেষে জুনের শেষ দিকে আকরাম খানকে কথার তোড়ে, বাক্যবাণে আক্রমণ করেন সেই মানুষটিই। গণমাধ্যমের সামনে অগ্রজ অধিনায়ককে নিয়ে অনেক বেঁফাস কথাই বলেন। বাজার গরম করা সেই কথার পর যা নিয়ে শেষ অব্দি সালিশ বসাতে হয় বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপনকে। দুজনকে ডেকে অবশ্য হাত মিলিয়েও দিয়েছেন। তবে অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটা তো ঠিকই ঘটে গেছে।
এই তিন ঘটনার প্রতিটির সঙ্গে একটি নাম ‘কমন’; তিনি খালেদ মাহমুদ সুজন। দেশের ক্রিকেটের বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক কিছুর সঙ্গেই তিনি জড়িত। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক। গেম ডেভলপমেন্টের চেয়ারম্যান। সিলেকশন কমিটির মেম্বার। টিম অপরারেশন্সের ভাইস চেয়ারম্যান। স্বার্থের সংঘাত নামের ব্যাপারটাকে যাদুঘরে পাঠিয়ে তিনি আবাহনী লিমিটেডের কোচ। না এখানেই শেষ নয়, কোচদের উপদেষ্টা, ঢাকা ডায়নামাইটসের কোচ। বাংলা ক্যাট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত। পাশাপাশি জাতীয় দলের ম্যানেজারের বড় দায়িত্বও পালন করেছেন।
মিরপুরের বাতাসে গুঞ্জন আকরাম খানের সঙ্গে এবার তার সমস্যাটা জিম্বাবুয়ে সফরে টিম লিডার হিসেবে যাওয়া কেন্দ্র করে। যেখানে এমন কিছু শর্ত দিয়েছিলেন সাবেক এই ক্রিকেটার, যা মেনে নিতে কোনভাবেই রাজি হচ্ছিলো না বোর্ড। যেখানে সুজন মনে করেছিলেন তার শর্ত আটকে গেছে ডেভলপমেন্ট কমিটির আকরাম খানের টেবিলে আসার আগেই।
তারপরই আইসিসি ট্রফি জয়ী আকরামকে গণমাধ্যমের সামনে তুমুল আক্রমণ করেন সুজন। বলেন, ‘আমার মনে হয় খেলোয়াড়দের আকরাম ভাইয়ের সাথে সেভাবে দেখাও হয় না। কারণ আকরাম ভাই যে বোর্ডে কখন আসেন, সব সময় যে আসেন তাও কিন্তু না। আমি তো মাঠের লোক মাঠে থাকি, বোর্ডে যাই। সবার সাথে দেখা হয়, কথা হয়। আকরাম ভাই হয়তো ব্যস্ত থাকে, উনার ব্যবসা আছে। উনার অনেক ব্যস্ততা থাকে তারপরেও অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু হয়তো খেলোয়াড়দের সাথে ওই সময় উনার দেখা হয় না। আমার সাথে যেভাবে ফ্রিলি কথা বলতে পারে সেটা হয়তো আকরাম ভাইয়ের সাথে পারে না, ওই সম্পর্কটা গড়ে ওঠে না। যেকোনো টপিক নিয়ে আমাকে বলতে পারে, ওই সময় আকরাম ভাইকে তো তারা পায় না।’
কিন্তু সুজনের এই কথার যৌক্তিকতা আদতে খুঁজে পাওয়া যায় না। আশ্চর্যজনক বিষয়-সাকিব আল হাসান ভারতে আইপিএল খেলতে যাওয়ার আগে বলেছিলেন ‘পাপন ভাই -আর সুজন ভাই ছাড়া কেউ বোর্ডে কাজই করে না।’ অথচ সেই সাকিবের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল তার। একে অন্যের দিকে তেড়ে গেলেন আস্তিন গুটিয়ে। সেই ঘটনায় সাকিব নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে আর্থিক জরিমানাও দিয়েছেন। বোর্ড বিচার করল সাকিবের কিন্তু মাঠে সবার সামনে যে ঘটনার জন্ম দিলেন সেই সুজনের বিচার করা হলো না! বিশ্লেষকরা মনে করেন তাকে অন্তত সতর্ক করা যেতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি, কারণ আর কিছু নয়, তিনি বিসিবির প্রভাবশালী পরিচালক, তাই সবকিছুতেই তিনি সর্বদাই ‘নটআউট’!
অতীতেও এমন অনেক ঘটনার কোনো বিচার দূরে থাক, তাকে সতর্কও করা হয়নি-
বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় কলঙ্ক ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএলে)। যেখানে ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন মোহাম্মদ আশরাফুল। এরপর কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় তাকে। বলা যায় সে কারণেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে দেশের ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টারের। আশরাফুল ছিলেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরের ক্রিকেটার।
যাদের বিপক্ষে ম্যাচ গড়াপেটার করেছেন বলা হচ্ছে সেই চিটাগংয়ের ম্যানেজার ছিলেন সুজন, গণমাধ্যমে এসেছিল তার নামও। অথচ সুজনের গায়ে আচড়ও পড়েনি একটু।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা দেশের ক্রিকেটে এমনসব পরিস্থিতি নিয়ে দারুণ শঙ্কিত। যিনি জাতীয় দলের হয়ে খেলা ছাড়লেও এরপর ম্যানেজার হিসেবেও জড়িত ছিলেন ক্রিকেটের সঙ্গে। বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেলেও এখনো যিনি ক্রিকেটের খোঁজ খবর রাখেন।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন, ‘যা হচ্ছে তা অবশ্যই একটা অশনি সংকেত। প্রেসিডেন্ট তো ওর ব্যাপারে অনেক কিছুই হাইড করেছেন। ও নাকি একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। তারপর থেকেই ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সে এতগুলো দায়িত্বের ভার নিতে পারছে না। হেড কোচ কিংবা ম্যানেজার হওয়ার মতো ক্যাপাবেল না ও। কারণ বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা তাকেই রেসপেক্ট করে যাদের সেই ব্যক্তিত্ব রয়েছে।’
তার সঙ্গেই কেন বাধে সবার? কেন এমন সব কাণ্ডের সঙ্গে বারবার তার নাম জড়িয়ে যাচ্ছে? শনিবার ঢাকা পোস্টের এমন প্রশ্নের মুখে খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, ‘কোনো প্রসঙ্গেই কথা বলবো না আমি। আপাতত ইউটিউব, ফেসবুক, অনলাইন কোথাও কথা বলবো না। আপনি যদি কথা বলতে চান তবে তিন মাস পর যোগাযোগ করবেন।’ কথা বলতে বিসিবি থেকে নিষেধ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে দুঃখপ্রকাশ করে সুজন বলেন, ‘না তেমনটা নয়। আপাতত আমি এসব নিয়ে কথা বলবো না, এটাই শেষ কথা।’
খেলায় তর্ক-বিতর্ক থাকবে। কিন্তু প্রতিবারই সব সমস্যার একপাশে শুধু একজনের নাম থাকে কেন? সুজনেরই সঙ্গেই কেন সবার ঝামেলা বাধে? ক্ষমতার বলয়ের উত্তাপ সবাই বোধ করি সইতে পারে না। ক্রিকেট তাহলে এখন ‘নো মোর জেন্টেলমেন্স গেম!’
এটি/এমএইচ