খেলার জগতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গাটা ক্রিকেটেরই দখলে। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের ফুটবল কেন্দ্রিক আমেজ ক্রমেই কমে এসেছে। সে জায়গা দখলে নিয়েছে ক্রিকেট। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সাফল্য, ২০০৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে উন্নতির গ্রাফ দর্শকদের টেনে এনেছে ক্রিকেটের ২২ গজের গণ্ডিতে। 

কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে জনপ্রিয়তা এবং সাফল্য হাতে হাত রেখেই চলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেকগুলো বছর পার করে ফেললেও এখন পর্যন্ত সেই সাফল্যের সঙ্গে সখ্যতা হয়নি বাংলাদেশ জাতীয় দলের। অবশ্য জাতীয় দল শব্দটা বেশ বড়। নারীদের জাতীয় দল এশিয়া কাপ জিতেছে। দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে ২০১০ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জয়ের নজিরও আছে। 

কিন্তু শাব্দিক অর্থে যাদেরকে ‘জাতীয় দল’ বলে পরিচয় দেওয়া হয়, সেই পুরুষ জাতীয় দলটা দিনে দিনে কেবল ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি করেছে। ভিন্ন চিত্র যুবা দলে। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে সাফল্য উপহার দিয়েছে। ২০২০ সালে যুব বিশ্বকাপের শিরোপাটাই বাংলাদেশ ঘরে তুলেছে। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে পরপর দুই বছর হয়েছে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন। 

কিন্তু, যুব বিশ্বকাপে যারা ছিলেন তারকা, তারাই যেন পরবর্তীতে বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় হতাশার কারণ। সে তালিকায় থাকা নামগুলো বেশ বড়। নাজমুল হোসেন শান্ত, আকবর আলী, তানজিদ হাসান তামিমরা যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নেন, সে তুলনায় ফিরিয়ে দিতে পারেন অনেক কম। 

কিন্তু কেন এমন দৈন্যদশা? সে আলাপে আসতে হলে যেতে হবে অনেকটা দূরে। দেশের ক্রিকেট কাঠামোর অনেকটা ভেতরে। 

ঘরোয়া ক্রিকেটে পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব  

অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে ভারতের জাতীয় দলে আসার পথে ঠিক কোন কোন ধাপ অতিক্রম করতে হচ্ছে ভারতের ক্রিকেটারদের। সেটা একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে ভারতের তরুণদের প্রথম পরীক্ষা হয় সি কে নাইডু ট্রফিতে। চারদিনের এই টুর্নামেন্টে আছে লিগ এবং নকআউট ঘরানার দুই আলাদা পর্ব। 

এরপর দুলিপ ট্রফি, ইরানি ট্রফি, সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি এবং রঞ্জি ট্রফি। এর মাঝে কিছু ওয়ানডে, কিছু চারদিনের আসর। সময়ের প্রয়োজনে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি এখন হয় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। আর সবার ওপরে আছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। এসব ধাপ পূরণ করেই একজন সম্ভাবনাময় তরুণকে হতে হয় তারকা। এরপরেই খোলে জাতীয় দলের দরজা। 

বিপরীতে বাংলাদেশে ন্যাশনাল ক্রিকেট লিগ (এনসিএল), ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) এবং বিপিএলের বাইরে খেলার সুযোগ খুবই কম। অনেকক্ষেত্রেই আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে খ্যাপ খেলে পার করতে হয় সময়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা টাইগার্স বা এইচপি দলের হয়ে কিছুটা সুযোগ বাড়লেও, সেটা ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঠিক কতটা পোক্ত করছে, তা নিয়ে আছে প্রশ্ন। 

ভারতে যখন একজন ক্রিকেটার বিভিন্ন আসরে খেলে নিজেকে প্রমাণ করে জাতীয় দলে আসার সুযোগ পান, তখন বাংলাদেশ সুযোগ দিচ্ছে কেবল যুব পর্যায়ের পারফরম্যান্স বিচারে। পার্থক্যটা তাই বেশ বড় আকারেই ধরা দেয়। 

ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্বল ড্রেসিংরুম 

ঘরোয়া ক্রিকেটে কম টুর্নামেন্টের সঙ্গে আছে দুর্বল ড্রেসিংরুম। দেশের ক্রিকেটে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত তারকাদের মাঝে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার প্রবণতা অনেকটাই কম। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রিকেটারদের। যে কারণে অনেক উদীয়মান তরুণ ড্রেসিংরুমে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের সঙ্গে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না সেই অর্থে। 

২০০৮ সালে আইপিএলের শুরুতেই নির্দেশনা ছিল প্রতিটা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলকে ২ জন করে অনূর্ধ-১৯ দলের ক্রিকেটার দলে নিতে হবে। তাদের জন্য পারিশ্রমিকটাও ছিল বেঁধে দেয়া। এমন সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য ছিল তরুণদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেয়া। আর সেটা কাজেও দিয়েছে. বাংলাদেশে অবশ্য এমন নিয়ম দেখা যায়নি কখনোই।

আর এটাই পরোক্ষ উপায়ে পিছিয়ে দিচ্ছে ক্রিকেটারদের মনমানসিকতায়। বাংলাদেশের সাপেক্ষে ওয়ানডে ফরম্যাটের ডিপিএলে কেবল দেখা যায় তারকা এবং অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের। তরুণ ক্রিকেটারদের মাঝেও তুলনামূলকভাবে ওয়ানডে ক্রিকেটেই ভালো করার প্রবণতা দেখা দেয়। তাওহীদ হৃদয়, নাজমুল হোসেন শান্ত কিংবা তানজিদ তামিমদের পারফরম্যান্স গ্রাফ ওয়ানডে ফরম্যাটেই খানিক স্বস্তি জাগানিয়া। 

অতিমাত্রায় যুবা দলের প্রতি নির্ভরতা 

যুব বিশ্বকাপ যেন খেলোয়াড় তৈরির কারখানা। অন্তত বাংলাদেশের সাপেক্ষে এমন তথ্য বেশ বড় রকমের সত্য। বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপ থেকে বেরিয়ে আসা তারকাদের জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশই সবার চেয়ে এগিয়ে। এখন পর্যন্ত যুব বিশ্বকাপ খেলা ৪১ শতাংশ খেলোয়াড়ই জাতীয় দলের জার্সিতে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। যা টেস্ট খেলুড়ে বাকি সব দেশ থেকে অনেকটাই বেশি। 

এই তালিকায় পরের নাম আফগানিস্তান। যুব বিশ্বকাপ খেলা ৩৮ শতাংশ তারকা খেলেছেন তাদের দেশের হয়ে। এরপরেই আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম। যুব বিশ্বকাপ খেলা ৩৬ শতাংশ তারকা পরবর্তীতে অভিষেক ঘটিয়েছেন দ্বীপরাষ্ট্রটির হয়ে। ইংল্যান্ড এবং ভারতের হয়ে যথাক্রম ২৮ ও ২৭ শতাংশ যুব বিশ্বকাপ খেলা তারকা পরবর্তীতে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন।

যুবা দলের প্রতি অতিমাত্রায় এই নির্ভরতা অনেকটা আড়ালে থেকেই ক্ষতি করছে দলের। ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যান্য পর্যায় থেকে খেলোয়াড়দের উঠে আসার সুযোগ এখন দিনে দিনে কমছে। এই নির্ভরতার কারণেই কমছে প্রতিযোগিতা। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তানজিদ তামিম। ৫ ওয়ানডে খেলেই ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলেছেন। শুধুমাত্র বিকল্প ওপেনার না থাকায় সুযোগ পেয়েছিলেন ৯ ম্যাচের সবকটিতেই। 

পেসার তানজিম হাসান সাকিব কিংবা শামীম পাটোয়ারির অতিদ্রুত দলে চলে আসার পেছনেও অতিমাত্রায় যুবা দলের প্রতি নির্ভরতাকে দায় দিতেই পারেন। 

প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব এবং ‘অটো চয়েজ’ 

জাতীয় দলে কোনো ক্রিকেটারই অটোচয়েজ নন। প্রায় সময়ই এমন একটা বাক্য আউড়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, নির্বাচক থেকে শুরু করে অনেকেই। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন চিত্র। জাতীয় দলে পর্যাপ্ত প্রতিযোগিতার অভাবে পারফর্ম না করেও টিকে থাকার নজির আছে অজস্র। আবার বাদ পড়ে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ না করেই জাতীয় দলে ঢুকেছেন অনেকে। 

এর পেছেন বড় কারণ প্রতিযোগিতার অভাব। অনেক ক্ষেত্রেই ক্রিকেটাররা সুযোগ পাচ্ছেন বাকি কেউ ভালো না খেলার সুবাদে। লিটন কুমার দাসকে চলতি বছর শ্রীলঙ্কা সিরিজের মাঝপথে বাদ দেয়া হয়েছিল ‘নতুন বলে দূর্বলতা’র কারণে। কিন্তু এরপর তার বিকল্প আর কাউকেই মাঠের পারফরম্যান্সে খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। বাধ্য হয়েই ফের তাকেই ডাকতে হয়েছে দলে। 

টি-টোয়েন্টি সিরিজে তার অধিনায়কত্ব প্রশংসা কুড়ালেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তার ব্যাটিং। উদাহরণ হিসেবে লিটন দাসের নামটা সামনে এলেও জাতীয় দলে অনেকেরই ক্যারিয়ার লম্বা হচ্ছে পর্যাপ্ত বিকল্প না থাকায়।  

এখন পর্যন্ত যুব বিশ্বকাপ খেলা ৪১ শতাংশ খেলোয়াড়ই জাতীয় দলের জার্সিতে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। যা টেস্ট খেলুড়ে বাকি সব দেশ থেকে অনেকটাই বেশি। যুবা দলের প্রতি অতিমাত্রায় এই নির্ভরতা অনেকটা আড়ালে থেকেই ক্ষতি করছে দলের। ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যান্য পর্যায় থেকে খেলোয়াড়দের উঠে আসার সুযোগ এখন দিনে দিনে কমছে। 

পরিকল্পনা, সুযোগ এবং তদারকির অভাব

তবে সবকিছুর উর্ধ্বে বড় সত্য, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দলগুলোর একটি। প্রতিভা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সেসব আনকোরা তারকাদের ঠিক কতটা আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে পারছে– তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।  

অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারদের অনেকেই যেন চলে যান আড়ালে। কদিন আগেই ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ২০২০ সালে যুব বিশ্বকাপজয়ী পেসার অভিষেক দাস অরণ্যের সঙ্গে। চার বছর ধরে যিনি ইনজুরির কারণে খেলার বাইরে। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে নিজেই বলেছিলেন, কিছুটা দেরি করেই শুরু হয়েছিল তার চিকিৎসা। 

আবার অনেক ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের গড়ে তোলার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না বিসিবির পরিকল্পনার ভুলে। ২০০৮ সালে আইপিএলের শুরুতেই নির্দেশনা ছিল প্রতিটা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলকে ২ জন করে অনূর্ধ-১৯ দলের ক্রিকেটার দলে নিতে হবে। তাদের জন্য পারিশ্রমিকটাও ছিল বেঁধে দেয়া। এমন সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য ছিল তরুণদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেয়া। আর সেটা কাজেও দিয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্য এমন নিয়ম দেখা যায়নি কখনোই। ফলাফলটাও চোখের সামনেই থাকছে সবার জন্যে।