টাইগারদের প্রিয় খাবার ‘টোপ’!
অনেকে নেহাত শখের বশে মাছ ধরেন। শৌখিন এমন মৎস্য শিকারিদের সবচেয়ে পছন্দের পন্থা হচ্ছে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা। বেশ প্রচলিত ও প্রাচীন এই রীতির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ—পানি না ছুঁয়েও মাছ ধরা যায়।
এই রীতিতে বড়শিতে টোপ দিয়ে মাছকে প্রলুব্ধ করা হয়। ক্ষুধার্ত মাছ যখন খাবার মোড়ানো টোপ দেখতে পায়, তখন ঝাঁপ দিয়ে টোপটা গিলে ফেলে। আর অমনি বড়শিতে বিঁধে ঝুলে থাকে, বেশি নড়াচড়া করতে পারে না।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অবস্থাও অনেকটা এমন হয়ে গেছে; টোপ গেলা মাছের মতো। গিলে ফেলার পর ‘শিক্ষা’ নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তাদের।
আরও পড়ুন
গতকাল (বুধবার) বাংলাদেশের ম্যাচটা যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই দেখার কথা নাজমুল হোসেন শান্ত কীভাবে আউট হয়েছেন। বাংলাদেশ অধিনায়ককে রীতিমতো বড়শির টোপ দিয়ে মাছ বানিয়েছেন মোহাম্মদ নবি!
শান্ত আর মিরাজের জুটি তখন বাংলাদেশকে সহজ জয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে। জমে ওঠা এই জুটি ভাঙতে ২৬তম ওভারে একটা ফাঁদ পাতলেন নবি। ডিপ স্কয়ার লেগ ফাঁকা করে দিলেন, ফাইন লেগেও কোনো ফিল্ডার ছিল না। তবে শর্ট ফাইন লেগে ছিল। শান্ত জোর করে সুইপ করতে গেলেন, ব্যাটে-বলে ভালো টাইমিং না হওয়ায় ধরা পড়লেন শর্ট ফাইন লেগে! এত বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা একজন ব্যাটার, যিনি বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার অন্তত এই ফাঁদ বা টোপ সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি আউট হয়ে বোঝালেন ‘ফাঁদ’ শব্দটা তার ক্রিকেট-জ্ঞানেই নেই, তিনি বুঝতেই পারেননি বিষয়টি!
বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেক প্রতিভাবান ব্যাটার ভাবা হয় সৌম্য সরকারকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার প্রায় এক দশক কেটে গেছে। অথচ এই ফাঁদ আর টোপের গল্প থেকে সৌম্যের চরিত্রটা বাদ দিতে পারলাম না। এই বাঁহাতি ব্যাটার গতকাল যেভাবে শুরু করেছিলেন, তার খেলা শট দেখাটা ছিল চোখের জন্য প্রশান্তি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই প্রতিপক্ষের খোঁড়া গর্তে নিজে গিয়ে পা বাড়িয়ে দিলেন!
১২তম ওভারে আজমতউল্লাহ ওমরজাই বোলিংয়ে ছিলেন। সৌম্যর জন্য ফাঁদ বানানো হয় উইকেটের পেছনে। ফাইন লেগে তার জন্য ফিল্ডার রেখে শরীরের ওপর খাটো লেংথে 'টোপ' দেন এই পেসার, ফাঁদে পা দিয়ে পুল করতে যান সৌম্য, তাতেই হয় ভুল। ফাইন লেগে দাঁড়িয়ে থাকা ফজল হক ফারুকি জায়গায় দাঁড়িয়েই ক্যাচটা নেন।
শান্ত-সৌম্যের এই ফাঁদ বুঝতে না পারার গল্প করতে গিয়ে আরেকটা শব্দ মনে পড়ে গেছে। ক্রিকেটে 'গেম অ্যাওয়ারনেস' বলে একটা কথা আছে। সহজ ভাষায় যার ব্যাখ্যা হল, ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে খেলা। বিশেষ করে ব্যাটারদের ক্ষেত্রে এটা বেশি প্রযোজ্য। কারণ উইকেট, প্রতিপক্ষ, বোলার ও ম্যাচের পরিস্থিতি সবদিক বিবেচনা করে ব্যাটারকে সময়ের সঙ্গে গিয়ার পরিবর্তন করতে হয়। যে ব্যাটারের গিয়ার পরিবর্তনের ক্ষমতা বা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য যত বেশি, তাকে তত বেশি দক্ষ ভাবা হয়। আর এই সবগুলো গুণ মিলেই তৈরি হয় গেম অ্যাওয়ারনেস।
'গেম অ্যাওয়ারনেস' ব্যাপারটার সঙ্গে সামর্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটাতে হলে গেম অ্যাওয়ারনেস থাকাটা জরুরি। যেটার ঘাটতি বাংলাদেশের প্রায় ব্যাটারদের মধ্যে দেখা যায়। এমনকি প্রায় দেড় যুগ ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের মধ্যেও সেটার অভাব বোধ হয়।
গতকাল রশিদ খানের গুগলিতে যেভাবে বোল্ড হলেন মাহমুদউল্লাহ, সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আছেন। অফ স্টাম্পের বাইরে পিচ করা গুগলিতে ভুল পড়েছেন মাহমুদউল্লাহ, লেগ স্পিন ভেবে সামনের পায়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে তার ব্যাট আর প্যাডের ফাঁক দিয়ে বল চলে যায় স্টাম্পে।
চোখে সর্ষেফুল দেখা মাহমুদউল্লাহকে অনুসরণ করেছেন মুশফিকও। সাম্প্রতিক সময়ে মুশফিকের আলোচিত এক শটের নাম রিভার্স সুইপ। এই শটের সঙ্গে তার এতটাই প্রেম, যেন তার জন্য নিজেকেও বারংবার বিলিয়ে দিতে রাজি তিনি! একাধিক টেস্ট ম্যাচে দলের বাজে পরিস্থিতির মধ্যেও অতি বিলাসী এই শট খেলতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন মুশফিক! অথচ তার মতো একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের কাছ থেকে গেম অ্যাওয়ারনেসটা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত।
অবশ্য গতকাল মুশফিক রিভার্স সুইপ করার মতো সুযোগ পাননি! গাজানফারের ক্যারম বল অন্ধের মতো পড়েছেন মুশফিক! অফ স্পিন ভেবে সামনে পা এগিয়ে ফ্লিক করতে চেয়েছিলেন, তাতে লাইন মিস করেন মুশফিক। তবে ক্রিজে পা রাখার আগেই উইকেট ভাঙতে ভুল করেননি উইকেটকিপার ইকরাম আলিখিল। যেভাবে আউট হলেন, তা ১৮ বছরের একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
মুশফিকের এমন আউটের সঙ্গে মিল ছিল ইনিংসে প্রথম ব্যাটার হিসেবে আউট হওয়া তানজিদ হাসান তামিমের। এই তরুণ ওপেনার একই বোলারের একই বল পড়তে ভুল করেন। লো হওয়া ক্যারম বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েছিলেন তিনি। তানজিদ এখন পর্যন্ত ১৬টি ওয়ানডে খেলেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা খুব একটা কম সময়ও না। তার পরও তার টেকনিক কিংবা খেলার ধরনে কোনো উন্নতির ছাপ নেই। গতকাল যেভাবে আউট হয়েছেন, ঠিক তার অভিষেক ওয়ানডেতেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাহিশ থিকশানার বলে এভাবেই আউট হয়েছিলেন। ঠিক যেন কার্বন কপি!
তানজিদ তামিম না হয় অনভিজ্ঞ কোটায় ছাড় পেলেন! কিন্তু তাওহিদ হৃদয় কি তার আউটের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? ২৩৬ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ১৩৮ রানে ৮ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। হাতে তখন ২ উইকেট থাকলেও ওভার বাকি ১৭। উইকেটে একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটার হৃদয়। এমন পরিস্থিতিতে তিনি আড়াআড়ি ব্যাটে স্লগ সুইপ করতে গেলেন। হয়েছেন বোল্ড। এই তার গেম অ্যাওয়ারনেস?
অথচ এই সফরে যাওয়ার আগে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অফ সাইডে আপনার শটের রেঞ্জ কম, সেটা নিয়ে কাজ করছেন কি না? জবাবে হৃদয় যা বলেছিলেন তার সারমর্ম এই—বিশ্বের অনেক ব্যাটার আছে, যারা শুধুমাত্র অন সাইডে শট খেলে তারকা হয়েছেন। তাদের সমস্যা না হলে আমারও সমস্যা হবে না। সবমিলিয়ে ৬৩ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা একজন যদি এভাবে নিজের দুর্বলতা লুকানোর চেষ্টা করেন তাহলে তার উন্নতি করার ইচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
এইচজেএস/এফআই