ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত
ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যর্থতা কেন?
চট্টগ্রাম টেস্টের তৃতীয় দিন ছিল গতকাল (বৃহস্পতিবার)। বাংলাদেশকে ফলোঅনে ফেলে দুই দুইবার অলআউট (একদিনে উইকেটের পতন হয় ১৬টি) করে ইনিংস ব্যবধানে ম্যাচটা জিতে নেয় সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্যাটিং স্বর্গে এমন বিপর্যয়ের পর হতাশা লুকাতে পারেননি টাইগার অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। ব্যাটারদের ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করে অকপটে বলেই ফেললেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে এ রকম ফলাফলই হবে’।
সর্বশেষ দুই মাসে বড় দুটি টেস্ট সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। ভারতের মাটিতে ভরাডুবির পর দেশের মাঠেও চিত্রটা বদলায়নি। অথচ পাকিস্তানে গিয়ে স্বাগতিক দলকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হারিয়ে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গেই থাকার কথা ছিল নাজমুল হোসেন শান্তদের। কিন্তু ভারতেই যেন খেই হারালেন। শুরুতে গোয়ালিয়র টেস্টে ২৮০ রানের বড় ব্যবধানে পরাজয়। পরে কানপুর টেস্টেও ৭ উইকেটের হার।
বিজ্ঞাপন
সদ্য বিদায়ী ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করা হচ্ছিল। অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ দল নিয়েই বাংলাদেশ সফরে পা রেখেছিল আফ্রিকানরা। সেই সঙ্গে ছিলেন না নিয়মিত অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাও। কিন্তু এই সিরিজেও বাংলাদেশের জন্য একরাশ লজ্জা উপহার দিয়ে গেলেন সফরকারীরা। প্রোটিয়া তিন জন ব্যাটার নিজেদের ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি হাঁকালেন। বোলিংয়ে কীর্তি গড়েন পেসার কাগিসো রাবাদাও।
সিরিজের প্রথম টেস্টে মিরপুরে ৭ উইকেটের পরাজয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল বাংলাদেশ। সর্বশেষ গতকাল চট্টগ্রাম টেস্টে ইনিংস এবং ২৭৩ রানে হারের মধ্যে হোয়াইটওয়াশ হয়ে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের প্রায় দুই যুগ পূর্ণ হলেও এখনো যেন কেবল নবীন বাংলাদেশ।
সর্বশেষ চার টেস্টের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কয়েকটি কারণে হারের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ।
টেস্ট ক্রিকেটের টেম্পারমেন্ট
সাধারণত বিশ্বের বড় দলগুলোর টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করার পেছনে অন্যতম একটা কারণ নিজেদের ধৈর্য্য শক্তি। টেস্ট ক্রিকেটে ভালো ব্যাটিং করতে হলে অবশ্যই সেশন বাই সেশন খেলতে হয়। দিনের এক সেশনে ভালো করার পর অন্য সেশনে দ্রুত উইকেট হারালে বড় রান করা কঠিন হয়ে যায়। বাংলাদেশ দলের জন্য এই সমস্যা প্রবলভাবে দেখা যায়। দেশের ব্যাটারদের বিশেষ করে এই সমস্যা রয়েছে। এদিকে একটু বোলিংবান্ধব উইকেট না হলেই বোলাররা সুবিধা করতে পারেন না।
চট্টগ্রাম টেস্টে মেহেদী হাসান মিরাজের দিকে খেয়াল করলে বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে উঠে। টাইগার এই স্পিনার ৩৯ ওভার হাত ঘুরিয়ে কোনো উইকেট সংগ্রহ না করেই খরচ করেছেন ১৭১ রান। মূলত একটানা ভালো জায়গায় বোলিং করতে ব্যর্থ বাংলাদেশের বোলাররা। পেসারদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র ফুটে উঠেছে। সে তুলনায় বিদেশের মাটিতে ভালো করেছে পেসাররা। সদ্য পাকিস্তান ও ভারত সিরিজই যার বড় উদাহরণ।
টপ অর্ডার ব্যর্থতা
দেশের ক্রিকেটে একটা কথা খুব চালু আছে। দু’তিন জন ব্যাটার বিদায় নিলেই বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে। ব্যর্থতার নেপথ্যেও বড় কারণ টপ অর্ডারের ব্যর্থতা। দীর্ঘ সময় ধরে ওপেনিং কিংবা ওয়ানডাউনে কেউ সুবিধা করে উঠতে পারছেন না।
সবশেষ চার ম্যাচেও সেই চিত্রটাই আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। জাকির হাসান, সাদমান ইসলাম, মাহমুদুল হাসান জয় আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এক ইনিংসে কোনোরকমে কিছু রান করতে পারলেও পরের তিন ইনিংসে দাঁড়াতেই পারছেন না।
শান্ত যেমনটা স্বীকার করলেন, লম্বা সময় ধরেই এ রকম হচ্ছে। টেস্টে টপ অর্ডার থেকে যদি জুটি না হয়, তাহলে পরের ব্যাটসম্যানদের জন্য খুবই কঠিন। ওপরে যারা ব্যাটিং করে, তারা কী চিন্তা করে বা কী ধরনের প্রস্তুতি নেয়, আমি জানি না। তবে এভাবে চলতে থাকলে এ রকম ফলাফলই হবে।’
ধারাবাহিকতার অভাব
ক্রিকেটে সবথেকে জরুরি বিষয় ধারাবাহিকতা। অবশ্য জীবনের সব ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। সেই ধারাবাহিকতার অভাব স্পষ্ট দেখা যায় সব ক্রিকেটারের মধ্যেই। সবশেষ চার টেস্টের একটি ম্যাচে ফিফটি করেছেন ওপেনার সাদমান ইসলাম। একজন ওপেনারের সবশেষ ৮ ইনিংসে ১টি ফিফটি, যা দেখলে বোঝা যায় ধারাবাহিকতার অভাব ঠিক কতটা।
ব্যাটারদের পাশাপাশি বোলারদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পিচের সুবিধা না পেলেই দেশের বোলাররা রান বিলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে একেকজন ‘দানবীর’ হয়ে ওঠেন। সবশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজেও এটি দেখা গেছে। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার হয়তো ঠিকই বলেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ ‘অধারাবাহিকতায় ধারাবাহিক'!
অভিজ্ঞরা যখন অনভিজ্ঞ
বাংলাদেশ ক্রিকেটে ২০১৭ সালে অভিষেক নাজমুল হোসেন শান্তর, মেহেদী হাসান মিরাজের অভিষেক ২০১৬ সালে। কথিত পঞ্চপাণ্ডবের পর তাদের ওপরই দেশের ক্রিকেটের হাল। জাতীয় দলে অভিষেকের নিরিখে তারা এখন আর তরুণ নন, অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ক্যাটাগরিতেই থাকার কথা। একইভাবে তাসকিন আহমেদ, লিটন দাস, জাকির হাসানরাও অনেকদিন ধরে জাতীয় দলে। সিনিয়র ক্রিকেটারদের যেভাবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা, তার ধারেকাছেও যেতে পারছেন না।
সর্বশেষ ১০ টেস্ট ইনিংসে শান্তর ব্যাট থেকে এসেছে ২৬৯ রান, গড় মাত্র ২৬.৯। অন্যদিকে দলে এখন সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম সর্বশেষ ১০ টেস্ট ইনিংস মিলিয়ে ১৪০ রান করেছেন, গড় ১৫.৫৬। লিটন দাস, জাকির হাসানরাও বলার মতো কিছুই করতে পারেননি সবশেষ চার টেস্টে। যে কারণে টানা চার টেস্ট পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায় সিনিয়র ক্রিকেটার বা অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের ব্যর্থতা।
পরিকল্পনায় গলদ
পৃথিবীর যে কোনো কাজে অবশ্যই পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। ক্রিকেট মাঠেও এর ব্যতিক্রম কিছু না। আর সেই খেলাতেই পরিকল্পনার ঘাটতি দেখা যায় বাংলাদেশ দলের। সবশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে মিরপুরে টাইগার একাদশে ছিলেন এক পেসার।
তবে মাঠের চিত্র দেখা গিয়েছিল উইকেটে সুবিধা পাচ্ছেন পেসাররা। প্রথম দিনেই পরিকল্পনার ভুল দেখা গিয়েছিল সেদিন। এরপর নানা সময়ে দেখা গিয়ে লাঞ্চ বিরতি, চা বিরতি কিংবা ড্রিংকস বিরতির ঠিক আগেই আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন ক্রিকেটাররা। পরিকল্পনার অভাবের যে স্পষ্ট ছাপ সেটা দেখা যায় টাইগারদের মধ্যে সবশেষ টেস্ট সিরিজগুলোতে।
নিবেদনে ঘাটতি
বছর খানেকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে দর্শকদের বড় একটি অভিযোগ হচ্ছে ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটারদের সর্বোচ্চ নিবেদন না থাকা। নানা সময়ে দেখা গিয়েছে স্রেফ হতাশাজনক পারফরম্যান্স। কখনো ক্যাচ মিস, বাজে বোলিং আর ধারাবাহিক ব্যাটিং ব্যর্থতা। তরুণ কিংবা অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদেরও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে প্রশ্ন হচ্ছে। একটা দেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ববোধ থাকবে এমনটি বিশ্বাস করেন সবাই।
যে দেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট আবেগ, ভালোলাগা ও ভালোবাসার জায়গা, সে দেশ কেন ভালো করতে পারছে না? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে হতাশ হওয়ার মতো অনেক কিছুই বেরিয়ে আসে।
এসএইচ/এফআই