এই মেসি আর্জেন্টিনার, এই মেসি মুগ্ধতার
বুয়েন্স এইরেসের আলো-বাতাসটা মেসির অচেনা না। তবে আর্জেন্টিনার আর দশজন ফুটবলারের মতো চেনা নয়, সেটাও সত্য। রোজারিও থেকে সোজা ধরেছিলেন বার্সেলোনার বিমান। কী কাকতালীয়! ১৬ই অক্টোবর কাতালুনিয়ার ক্লাবের হয়ে প্রথম নেমেছিলেন লা লিগার ম্যাচে। অনেকগুলো বছর পর সেই ১৬ই অক্টোবর গড়লেন নতুন ইতিহাস। ফুটবলের দেড়শ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোলে অবদানের রেকর্ডটা এখন মেসির সঙ্গী।
৩৩৩ দিন পর আর্জেন্টিনার মাটিতে খেলতে নেমেছিলেন মেসি। আর্জেন্টিনার ৬ গোলের ৫টিতেই তাঁর অবদান। গ্যালারিতে এক বিশাল টিফো। তাতে লেখা, ‘এক মুহূর্তের জন্য না, চিরদিনের জন্য না, বরং তারচেয়েও বেশি কিছু।’ ৩৭ বছর বয়সে হ্যাটট্রিকের পর ওই টিফো নজর কাড়লো আলাদাভাবে। এমন তো নয়, হ্যাটট্রিক মেসি আজই প্রথম করেছেন। এর আগে বহুবার সমর্থকদের হাসিয়েছেন, হয়েছেন নির্ঘুম রাতের কারণ। কখনো আবেগের স্রোতে দর্শকদের কাঁদতেও বাধ্য করেছেন।
বিজ্ঞাপন
নিজেও কেঁদেছিলেন। ২০১৬ সালের কথাগুলো ভুলবেন কী করে? তিন ফাইনালে হার, ঘরের মানুষই বলছিলেন– মেসি বার্সেলোনার, আর্জেন্টিনার নয়। মেসি নিজেও বলেছিলেন, এভাবে আর না। এবার অবসর। সেখান থেকে ফিরলেন ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে। ইকুয়েডরের বিপক্ষে সেই হ্যাটট্রিকটা আপনি বহুবার হয়ত দেখেছেন ইউটিউবে বা ফেসবুকের ভিডিওতে।
২০২২ বিশ্বকাপ। মেসি অতৃপ্তি মেটালেন। নায়ক হলেন। ঘরের মাঠে যে মানুষটা অনেকের কাছেই এক দশক আগে ছিলেন ভিলেন। তিনি এখন নায়ক। গ্যালারি থেকে নিজের নামটা শুনে মেসি নিজেও তৃপ্তি পান ভীষণভাবে। দেশের মানুষের ভালোবাসা আর সমর্থনের কথাও ম্যাচ শেষে স্মরণ করলেন আলাদাভাবে।
আরও পড়ুন
ম্যাচ শেষে সাংবাদিক গ্যাস্টন এদুলকে যেমনটা বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনার হয়ে শুধু উপভোগ করতে চাই আমি। এখানে খেলতে আসার পর মানুষ যেই ভালোবাসা আমাকে দেয় তা আমায় অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে। আমি প্রতিটি মূহুর্ত উপভোগ করতে চাই, কারণ আমি জানি এটাই আমার শেষ ম্যাচ হতে পারে।’
৩৭ বছর বয়সে লিওনেল মেসি করলেন মনে রাখার মতো হ্যাটট্রিক। গোল নিজে করেছেন, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন দুটি। ৫ গোলে সরাসরি অবদান। বলিভিয়াকে আর্জেন্টিনা হারালো ৬-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে। প্রতিপক্ষ দূর্বল হলেও মেসি আর তার সতীর্থরা ফুটবলটা খেলেছেন আর্জেন্টিনার চিরচেনা ব্র্যান্ডে। তৃতীয় গোলের পর মেসি উদযাপন করলেন কম। দর্শকদের ধন্যবাদ জানালেন বেশি। আর দর্শকরা তখন ব্যস্ত মুঠোফোনে মেসির ছবির জন্য।
৩৭ বছরের এই লিওনেল মেসিকে এখন আর বার্সেলোনা বা ইন্টার মায়ামির মনে হয় না। তিনি যেন এখন শুধুই আর্জেন্টিনার। নিজেকেও মেসি আকাশী-সাদা জার্সিতে উপভোগ করেন কিশোর বয়েসী ফুটবলারের মতো করেই, ‘আমি উপভোগ করছি সতীর্থদের সঙ্গে। বয়স যাই হোক, এখানে (আর্জেন্টিনা) এলে নিজেকে বাচ্চা ছেলেটি মনে হয়। যত দিন মনে হবে ভালো বোধ করছি, দলকে যেভাবে সাহায্য করতে চাই, সেভাবেই করতে পারছি, তত দিন উপভোগ করব।’
মেসি উপভোগ করছেন। আর তার গুরু লিওনেল স্কালোনি? এককালে সতীর্থ ছিলেন। পরে মেসির গুরু হয়ে কাটিয়েছেন আর্জেন্টিনার শিরোপাখরা। ম্যাচশেষে তার বক্তব্যটাও নাহয় শুনে আসা যাক, ‘একটা পর্যায়ে আমি বসে পাবলোকে (পাবলো আইমার) বলছিলাম, ‘এটা অসাধারণ। ওর খেলা উপভোগ করা, এই বেঞ্চে বসতে পারা আর সে (মেসি) যা করছে বা পুরো দল তাকে যেভাবে সাহায্য করছে (অসাধারণ)।’
মেসির কাছে গেল কয়েকবছর ধরেই একটা প্রশ্ন আসছে বারবার, ‘আর কতদিন?’। ২০২২ বিশ্বকাপ কিংবা ২০২৪ কোপা আমেরিকা তো হলো। ক্যারিয়ারের পূর্ণতার গল্পটাও লেখা শেষ। আর্জেন্টিনার মেসি এখন ফুটবল মহাকাব্যের নায়ক বা মহানায়কের চেয়েও বেশি কিছু। তবু ৩৭ বছরে এসে শেষের অঙ্কটা কষতে হয়। প্রতিদিনই স্ক্রিপ্ট সাজাতে হয় শেষের চিত্রনাট্য লেখার জন্য।
মেসি অবশ্য আশার পালে খানিক হাওয়া দিলেন, ‘আমি এখনই কোনো দিন তারিখ ঠিক করিনি (অবসরের)। শুধু উপভোগ করতে চাই...বছরটা ভালোভাবে শেষ করে পরের বছরের প্রস্তুতি নিতে চাই। ধাপে ধাপে এগোতে চাই। প্রতিটি দিন উপভোগ করতে চাই।’
স্কালোনিও সম্মতি দিলেন। বললেন, ‘সে যত দিন পারে খেলতে দিন। এটাই আমার চাওয়া কারণ ব্যাপারটা আনন্দের।’ আর্জেন্টাইন কোচও হয়ত জানেন, ক্যারিয়ারের গোধূলীবেলাতেও লিওনেল মেসি মুগ্ধতার প্রতিশব্দ। মেসি আর স্কালোনির মতো করে হয়ত সারাবিশ্বের সব ফুটবল ভক্তও বলবেন, হোক না আরও কিছুদিন। সেটা ২০২৬ বিশ্বকাপ হলেও ক্ষতি নেই নিশ্চয়।
ক্ষতি নেই তার প্রমাণ টুইটার ট্রেন্ড। খেলা শেষ হওয়ার প্রায় ৬ ঘণ্টা পরেও সামাজিক এই যোগাযোগমাধ্যমের ট্রেন্ডে আছেন আর্জেন্টাইন মহাতারকার নাম। সারাবিশ্বে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়ের রসদ তো কম নেই। তবু মেসিতে আটকে থাকলো পুরো দুনিয়ার মানুষ। কেউ পড়ছেন, কেউ দেখছেন আবার কেউ লিখছেন। এমন মেসিই তো সকলের চেনা। বুয়েন্স এইরেসের শুভ্রতা পুরো দুনিয়ায় হয়ত এভাবেই ছড়ায়।
জেএ