অস্ট্রেলিয়ার ক্যারি প্যাকারের নামের সঙ্গে পরিচয় নেই অনেকেরই। অথচ সত্তরের দশকে তারই হাত ধরে ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার সূচনা। ১৯৭৭ সালে যাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম শিরোনাম করেছিল, ‘শয়তানের হাতে পড়েছে ক্রিকেট’– সেই ক্যারি প্যাকারই মূলত ক্রিকেটে রঙিন পোশাক, ওয়ানডে জনপ্রিয়করণসহ নানা পদক্ষেপ হাতে নেন। 

আইসিসির নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটে অংশ নেয় অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর সেটাকে আরও জনপ্রিয় করতে গঠন করা হয়েছিল বিশ্ব একাদশ। সেখান থেকেই আসে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ভাবনা। যেটা পরের অনেকগুলো বছর ধরেই ছিল ক্রিকেটের বড় আকর্ষণ। 

যদিও ত্রিদেশীয় সিরিজ নিয়ে বাংলাদেশের সুখস্মৃতি কম নেই। ২০১৯ সালে বিশ্বকাপের আগে ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকেই বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম বহুজাতিক শিরোপা পায়। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে টাইগারদের একমাত্র জয়টাও এসেছিল ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকেই। সারাবিশ্বেই ত্রিদেশীয় সিরিজের আবেদন ছিল ভিন্ন মাত্রায়। 

কেনো জনপ্রিয় ছিল ত্রিদেশীয় সিরিজ? 

দ্বিপাক্ষিক সিরিজে যেখানে দুই বা তিন ম্যাচ শেষেই ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়, সেখানে তিন দেশের ক্রিকেটে ফাইনাল পর্যন্ত থাকে আমেজ। এরমাঝে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে হওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনাল হতো ‘বেস্ট অব থ্রি’ নিয়মে। তিন ম্যাচের মাঝে যে দল দুই ম্যাচ জিতবে তারাই পাবে শিরোপা। কিন্তু ব্যাপক জনপ্রিয়তার পরেও ত্রিদেশীয় সিরিজ এখন হারিয়ে যাওয়া এক অতীত। 

১৯৭৯ থেকে ২০০৮– এই দীর্ঘ সময়ে প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়ার সাথে সফরকারী দুই দলকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ত্রিদেশীয় সিরিজ। ২০০৮ সালের পর এই সিরিজের ধারবাহিকতায় ছেদ পড়লেও ২০১২ সালে আবারো ফিরে আসে ত্রিদেশীয় সিরিজ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ঠিকই হারিয়ে যেতে বসেছে ত্রিদেশীয় সিরিজ। আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর মাঝে ত্রিদেশীয় সিরিজ দেখা গেলেও পূর্ণ সদস্যের দেশগুলোতে একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে ত্রিদেশীয় সিরিজ। 

কেনো হারালো এমন জনপ্রিয় ধারণা?

এর পেছনে অবশ্য দায় দেয়া হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ব্যাপক আগ্রাসনকে। লাভজনক এবং দর্শক আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা এই ফরম্যাটের কারণে ওয়ানডে এখন বিলুপ্তপ্রায়। গেল বছর বিশ্বকাপের আগে ওয়ানডে ক্রিকেটকেই সীমিত করে দেয়া বলেছিলেন জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার এবং এমসিসি প্রেসিডেন্ট মার্ক নিকোলাস। তার চাওয়া শুধু বিশ্বকাপেই সীমাবদ্ধ থাকুক ওয়ানডে ক্রিকেট। এমসিসির এমন বার্তাকে খুব একটা হালকাভাবে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। বিশ্ব ক্রিকেটের আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে তারাই কাজ করছে। 

ওয়ানডে ক্রিকেট হারিয়ে যাওয়ার পেছনে মূলত ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটকেই বড় করে দেখা হচ্ছে। ব্যাপক লাভজনক এবং কম সময়ের হওয়াতে বিশ্বের প্রায় সব ক্রিকেট বোর্ডই নিজস্ব একেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট লিগ আয়োজনে ব্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এমনকি নেপালেও আছে টি-টোয়েন্টির বিশেষায়িত লিগ। সেখানে অংশ নিতে গিয়ে চাপ পড়ছে আন্তর্জাতিক সূচির দিকে। 

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২০২২ সালে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নিউজিল্যান্ড একটি টি-টোয়েন্টি সিরিজ আয়োজন করেছিল। তেমন সিরিজও খুব একটা নিয়মিত না। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাবিশ্বেই থাকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আনাগোণা। আইপিএলের আড়াই মাসের লম্বা স্লতে বেশিরভাগ সময়েই বন্ধ থাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। এরপরেই আগস্ট সেপ্টেম্বর স্লটে থাকে উত্তর আমেরিকায় কানাডা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের টি-টোয়েন্টি লিগ। 

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও আইসিসি টুর্নামেন্ট 

এর বাইরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। ৫ দিনের ক্রিকেটকে আরো বেশি অর্থবহ করতে দুই বছরের চক্রে আয়োজন করা হচ্ছে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। এসব কারণে ব্যস্ততা বাড়ছে ক্রিকেট দলগুলোর। সমশক্তির দুই দলকে পাশে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ আয়োজন করা তাই কিছুটা কষ্টসাধ্য। এছাড়া ত্রিদেশীয় সিরিজে ম্যাচের ব্যপ্তিও স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বেশি। 

ক্রিকেটারদের ক্লান্তির কথা বিবেচনা করেই তাই ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরেও ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে ত্রিদেশীয় সিরিজ। পাকিস্তান অবশ্য চলতি বছর নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজ আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঠাসা সূচির মাঝে তা কতটা বাস্তবতা দেখবে তা নিয়ে আছে প্রশ্ন। 

জেএ