পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর যে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে ভারতে গিয়েছিল বাংলাদেশ, সেটার শেষ দেখতে খুব একটা বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি ক্রিকেটারদের। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে টাইগার ক্রিকেট ঠিক কতটা নাজুক, তার প্রমাণ চোখের সামনেই যেন দেখিয়ে দিল ভারতের বিপক্ষে সিরিজটা। টেস্ট ক্রিকেট বাংলাদেশের ধাতে নেই অনেক দিন থেকেই। তবে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের এমন ছন্নছাড়া চেহারাও প্রত্যাশা ছিল না কারোরই। 

২০০৬ সাল থেকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। এরপরের বছরেই বিশ্বকাপে গিয়ে মোহাম্মদ আশরাফুল আর আফতাব আহমেদদের হাত ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো। সেই সময়ে বাংলাদেশের খেলার ধরণ ছিল খানিকটা আগ্রাসী। দেশের ক্রিকেটভক্তরা ভাবতে শুরু করেছিলেন, নিজেদের জন্য আদর্শ একটা ফরম্যাট বুঝি পেয়েই গিয়েছে বাংলাদেশ। 

কিন্তু পরের দেড়যুগে টি-টোয়েন্টিতে প্রত্যাশা তো পূরণ হয়নি। বরং বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি খেলার সামর্থ্য আছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠানো যেতে পারে। ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে দুই দলের ব্যাটিং অ্যাপ্রোচেই তা স্পষ্ট। পুরো সিরিজে ভারত যেখানে হাঁকিয়েছে ৪৪ ছক্কা। বাংলাদেশ সেখানে হাঁকিয়েছে ১২টি।

বিগ শট খেলার ধারায় নেই বাংলাদেশ 

সাঞ্জু স্যামসনের ব্যাকফুটে খেলা ছক্কাটার কথা একবার চাইলে স্মরণ করতে পারেন। মুস্তাফিজুর রহমানের বলে এক্সট্রাকাভারের ওপর দিয়ে হাঁকানো সেই ছক্কা স্তব্ধ করেছিল সবাইকে। কিংবা দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে হার্দিক পান্ডিয়ার সেই ‘নো লুক শট’। দুইবারই বাংলাদেশসহ পুরো ক্রিকেট দুনিয়া বিষ্মিত চোখে দেখেছে এভাবেও ছক্কা হাঁকানো যায়। 

তবে এসবের বিপরীতে বাংলাদেশের ছক্কা হাঁকানোর প্রবণতা নেই বললেই চলে। পুরো সিরিজে ১২ ছক্কা মেরেছেন টাইগার ক্রিকেটাররা। প্রতি ম্যাচে ৪টা হিসেবে। গড় কিংবা সামন্তরিক ধারার গণিত ক্লাসের আদর্শ উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশের ছক্কা নিয়ে এই পরিসংখ্যান। অথচ, গতকালের এক ম্যাচেই ১৭৩ রানের জুটি গড়তে গিয়ে সূর্যকুমার যাদব আর সাঞ্জু স্যামসন মেরেছিলেন ১৩ ছক্কা! 

সবমিলিয়ে অবশ্য বাংলাদেশের ছক্কার রেকর্ডই বেশ খারাপ। নিয়মিত টেস্ট খেলুড়ে ১০ দেশের মাঝে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের চেয়ে কম ছক্কা আছে কেবল জিম্বাবুয়ের। শর্টার ফরম্যাটের ক্রিকেটে বাংলাদেশ ১৭৯ ম্যাচে মেরেছে ৭০১ ছক্কা। প্রায় ৪০ ম্যাচ কম খেলা আফগানিস্তানের ছক্কা ৮৩৩টি। ১৯৪ ম্যাচ থেকে ইংল্যান্ডের ছক্কা ১ হাজার ১০৮টি।

বিগ শট খেলতে না পারার এই অদক্ষতাই মোটা দাগে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে অনেকখানি। ভারত তাদের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২৩৮ ম্যাচে গড়ে ৬টির বেশি ছক্কা হাঁকিয়ে ১৪৭০টি ছক্কা আদায় করেছে। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচপ্রতি ছক্কাও ৬ এর বেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে ১ হাজার ৫১৯টি ছক্কা হাঁকিয়েছে। তাদের ম্যাচপ্রতি ছয়ের মার ৭এর বেশি। 

২০২৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা হয়েছে তুলনামূলক ধীরগতির ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। বেশ কয়েক ম্যাচের ফলাফল সেই অনুপাতে পক্ষে এলেও নিজেদের বিগ শট খেলতে না পারার কারণেই হারাতে হয়েছে সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ। 

এমনকি আফগানিস্তানও প্রতিটি টি-টোয়েন্টিতে গড়ে ৬.০৩টি করে ছক্কা হাঁকিয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ছক্কার মার গড়ে ৪ এর একটু নিচে। যে ফরম্যাটে বিগ শট খেলাই সাফল্যের মন্ত্র, সেখানে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণও হয়ত এই অদক্ষতা, অপারগতা। 

টি-টোয়েন্টি খেলার অভ্যেস নেই বাংলাদেশের 

বাংলাদেশ এবং নিউজিল্যান্ডই বিশ্বের দুই ক্রিকেটীয় রাষ্ট্র, যাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে মাত্র ১টিই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু আছে। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে চালু আছে সুপার স্ম্যাশ, বাংলাদেশে বিপিএল। দেশের ক্রিকেটে আরও একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু করার ব্যাপারে কিছু কথা উঠলেও, সেটা শেষ পর্যন্ত ‘কথা ওঠা’ পর্যন্তই আটকে আছে। 

পার্শ্ববর্তী ভারতে ১৮টি অঙ্গরাজ্যে নিজস্ব টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আছে। যারমাঝে তামিলনাড়ু বা অন্যান্য রাজ্য লিগেও থাকে তারকাদের ভিড়। এছাড়া বোর্ডের তত্ত্বাবধানে আইপিএলের বাইরেও আছে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি। 

অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান তো বটেই এমনকি কেনিয়াতেও একপর্যায়ে চালু ছিল দুইটি ভিন্ন ভিন্ন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগ। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আটকে আছে সেই বিপিএলে। আবার বিপিএলের মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। 

টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও স্লো উইকেটে ভরসা 

১৭৯ ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের মাঠভিত্তিক টি-টোয়েন্টি পরিসংখ্যানে একবার নজর দেয়া যাক। ঘরের মাঠে বাংলাদেশ খেলেছে ৬০ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। জিতেছে ৩৩টি। জয়ের শতকরা হার ৫৫। দেশের বাইরে অবশ্য ৫৭ ম্যাচ থেকে জিততে পেরেছে মোটে ১৮ ম্যাচে। হেরেছে দ্বিগুণ ম্যাচে। জয়ের শতকরা হার মাত্র ৩১.১৮। 

আর নিরেপেক্ষ ভেন্যুতে খেলা ৬২ ম্যাচ থেকে মাত্র ১৭ ম্যাচে জয়ের হাসি ছিল বাংলাদেশের। শতকরা হিসেবে যা ২৭ এর কিছু বেশি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ভাল উইকেটে অবস্থা ঠিক এতটাই নাজুক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টাইগার ক্রিকেটাররা নিউজিল্যান্ড ব্যতীত অন্য কোনো দেশেই টি-টোয়েন্টির দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলার আমন্ত্রণ পাননি। 

 নিয়মিত টেস্ট খেলুড়ে ১০ দেশের মাঝে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের চেয়ে কম ছক্কা আছে কেবল জিম্বাবুয়ের। শর্টার ফরম্যাটের ক্রিকেটে বাংলাদেশ ১৭৯ ম্যাচে মেরেছে ৭০১ ছক্কা। প্রায় ৪০ ম্যাচ কম খেলা আফগানিস্তানের ছক্কা ৮৩৩টি। ১৯৪ ম্যাচ থেকে ইংল্যান্ডের ছক্কা ১ হাজার ১০৮টি।

বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় এক দশকের বেশি সময় কোনো দ্বিপাক্ষিক সফরে ছিল না টাইগাররা। মিরপুরের স্লো উইকেটের বাইরে তাই খেলার সুযোগ এসেছে বিশ্বকাপ কিংবা এশিয়া কাপের মতো মঞ্চে। সেখানে বাজে ফলাফলই হয়েছে সঙ্গী। ২০২৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা হয়েছে তুলনামূলক ধীরগতির ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। বেশ কয়েক ম্যাচের ফলাফল সেই অনুপাতে পক্ষে এলেও নিজেদের বিগ শট খেলতে না পারার কারণেই হারাতে হয়েছে সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ। 

প্রশ্ন আছে মানসিকতা নিয়েও 

কানপুর টেস্টে ফলাফল বের করতে মরিয়া ভারত আড়াই দিন নষ্টের পরেও খেলেছিল টি-টোয়েন্টি ঘরানার ক্রিকেট। ফল বের করে আনার চেষ্টায় সফলও হয়েছিল তারা। গোয়ালিয়র, দিল্লি বা হায়দরাবাদের তিন টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও ভারতের কাছে দেখা গিয়েছে চ্যাম্পিয়ন মানসিকতার। আগ্রাসী ক্রিকেটে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার পরিকল্পনায় টেস্ট কিংবা টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটেই সফল ছিল বাংলাদেশ। 

বিপরীতে লিটন দাসের ২৫ বলে ৪২ রানের ইনিংস বা তাওহীদ হৃদয়ের ৪২ বলে ৬৩ রানের ইনিংস বাদ দিলে খুব একটা টি-টোয়েন্টিসুলভ ব্যাটিং দেখা যায়নি বাংলাদেশের ব্যাটারদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে ৩৯ বলে ৪১ রানের ইনিংস নিয়ে এসেছে আলাদা পোস্ট। 

এমনকি ক্রিকেটারদের কোচ নিক পোথাস ভারত সফর করতে পারাকেই বেছে নিয়েছেন সৌভাগ্যের মানদণ্ড হিসেবে। সঙ্গে উল্লেখ করেছেন শেখার কথাও। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিশ্বের সবদেশই যাত্রা শুরু করেছিল সমসাময়িক সময়ে। তবু ভারত সফরে বাংলাদেশ জানান দিলো শেখার কথা। আর সফরকে আখ্যা দেয়া হয়েছে সৌভাগ্য হিসেবে। মানসিকতার দিক থেকেও বাংলাদেশ ক্রিকেট ঠিক কতটা পিছিয়ে, তা হয়ত আলাদা করে উল্লেখ না করেও উপসংহার টানা যায়। 

জেএ