‘আমরা যখন ঘরের মাঠে খেলি, তখন ১৪০-১৫০ রানের উইকেটই হয়। ব্যাটসম্যানরা ওই রানটা কীভাবে করতে হয়, সেটা জানে। কিন্তু আমরা জানি না কীভাবে ১৮০ করা যায়।’ গোয়ালিয়রে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হারের পর নাজমুল হোসেন শান্ত ঠিক এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন নিজেদের ব্যাটিং দুর্বলতা। যে পিচে ১২৮ রান পার করতে ভারত খেলেছে ১২ ওভারেরও কম। সেখানেই বাংলাদেশ ১২৭ করতে খেলেছে প্রায় ২০ ওভারের পুরোটা। 

অবশ্য বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের হতশ্রী এই চেহারা কেবল এবারই নয়। ২০২০ সালের পর থেকে হিসেব করা হলে বাংলাদেশ খেলেছে ৮৫ টি-টোয়েন্টি। তবে এরমাঝে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি স্কোর ১৭০ পার করেছে কেবল ১০ বার। ২০০ রান পার করেছে ৩ বার। সেই তিনবারে অবশ্য প্রতিপক্ষ ছিল আয়ারল্যান্ড এবং জিম্বাবুয়ে। 

আইরিশদের বিপক্ষে দুইবার দলীয় স্কোর ২০০ পার করেছে বাংলাদেশ। দুটোই এসেছে ২০২৩ সালের মার্চে। আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দলীয় ২০০ রান এসেছিল ২০২০ সালে। এরপর থেকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্কোর যতবারই ১৭০ পেরিয়েছে তাতে জিম্বাবুয়ে বা শ্রীলঙ্কার নামটাই এসেছে সবচেয়ে বেশি। 

২০২১ সালে বাংলাদেশ খেলেছে ২৭টি টি-টোয়েন্টি। তার মধ্যে টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে কেবল ২বার ১৭০ এর বেশি স্কোর করেছে বাংলাদেশ। একবার প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। অন্যবার শ্রীলঙ্কা। বিশ্বকাপের ম্যাচে লঙ্কানদের বিপক্ষে করা ১৭১ রানের দলীয় সংগ্রহ অবশ্য বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতাতে পারেনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করেছিল ১৯১ রান। অন্য ইনিংসটি পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে। সেটাও বিশ্বকাপের মঞ্চে।

২০২২ সালেই বাংলাদেশ যা একটু বড় স্কোর করে দেখিয়েছে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে। তার মাঝেও অবশ্য জিম্বাবুয়ে আর শ্রীলঙ্কার আধিপত্যই বেশি। হারারেতে ১৮৮ রান তুলেছিল টাইগাররা, ১৮৩ রান করেছে দুবাইয়ে এশিয়া কাপের ম্যাচে। দুই ম্যাচেই অবশ্য হার জুটেছে কপালে। সেই বছরই জিম্বাবুয়ে-শ্রীলংকা চক্র ভেঙে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৭৩ রান করে বাংলাদেশ। ক্রাইস্টচার্চে সেই ম্যাচেও হারতে হয় বাংলাদেশকে। 

সবমিলিয়ে ২০২০ পরবর্তী ১৭০ পেরুনো ১০ ইনিংসের মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এসেছে ৩ ইনিংস, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আছে ৩ ইনিংস। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২ ইনিংস। বাকি দুই ইনিংসের ১টি পাকিস্তান ও ১টি পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে। 

২০১৯ সালে মিরপুরে টি-টোয়েন্টির প্রথম ইনিংসে গড় স্কোর ছিল ১৬৮। যেটা ২০২১ সালে নেমে যায় ১২০ এর নিচে। ২০২৩ সালে ১৩৭ পর্যন্ত উঠেছিল গড় স্কোর। ২০১৮ ও ২০১৯ সাল বাদ দিলে বাকি সব বছরেই গড় স্কোর ছিল ১৬০ এর নিচে। সারাবছর স্লো উইকেটে খেলে অভ্যস্ত বাংলাদেশ দল দেশের বাইরে তাই দেখিয়েছে হতশ্রী পারফরম্যান্স। 

ব্যাটারদের মধ্যে নেই ধারাবাহিকতা 

কমপক্ষে ২০ ইনিংস খেলেছেন এমন বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে ভালো গড় তাওহীদ হৃদয়ের। সেটাও ২৭ এর নিচে। স্ট্রাইক রেটের হিসেবেও তিনিই সবার ওপরে। সংখ্যায় তা ১২৮ দশমিক ৪২। এরপরেই গড়ের হিসেবে আছেন এনামুল হক বিজয় এবং তামিম ইকবাল। একজনের গড় ২৪ দশমিক ৭২। অন্যজনের ২৪ দশমিক ৬৫। দেশের হয়ে আর কেউই টি-টোয়েন্টিতে ২৪ এর বেশি গড় রাখতে পারেননি। 

দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি গড়ে সবার ওপরে হৃদয় 

বিপরীতে বাংলাদেশের গতকালের ম্যাচের প্রতিপক্ষ ভারতের হয়ে ২৭ এর বেশি গড় আছে ১৭ জনের। ৩৫ এর বেশি গড় আছে ৭ জনের। ৪০ এর বেশি গড়ে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার পার করেছেন বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা এবং সূর্যকুমার যাদব। এমনকি মাত্র ২২ ইনিংস খেলা যশস্বী জয়সওয়ালও বাংলাদেশের যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন। 

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৭ এর বেশি গড়ে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার পার করেছেন ১২ জন। টাইগারদের প্রিয় প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কায় ২৭ এর বেশি টি-টোয়েন্টি গড় আছে ৬ ব্যাটারের। এমনকি আফগানিস্তানেও ৫ জন ব্যাটার আছেন যাদের গড় বাংলাদেশের তাওহীদ হৃদয়ের চেয়ে বেশি। ব্যাটিং ব্যর্থতা আর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ঠিক কতটা পিছিয়ে তার একটা নমুনা হতে পারে গড় সংক্রান্ত এই সহজসরল পরিসংখ্যান। 

ব্যর্থতার প্রশ্নে কাঠগড়ায় মিরপুরের উইকেট

অধিনায়ক শান্ত গোয়ালিয়রে ব্যাটিং ব্যর্থতার পর টেনে এনেছেন উইকেটের প্রসঙ্গ। তার জন্য এমন কথা অবশ্য এবারই প্রথম না। সময়ের কাঁটা পেছনে ঘুরিয়ে ১১ মাস পেছনে নিলে অধিনায়ক শান্তর মুখে একইরকমের বক্তব্য পেয়ে যাবেন। ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক ছিলেন শান্ত। সেই ম্যাচে হারের পরেও একই কথা বলেছিলেন তিনি। 

১০ বছরে টি-টোয়েন্টির প্রথম ইনিংসে মিরপুরে গড় রান

শান্তর দাবি অযৌক্তিক নয় তার প্রমাণ মেলে মিরপুরের শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দিকে তাকালে। ২০১৪ সালের পর থেকে এই মাঠে টি-টোয়েন্টি প্রথম ইনিংসের গড় স্কোরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতার পেছনে কিছুটা দায় আছে এমন স্লো উইকেটের। 

২০১৯ সালে মিরপুরে টি-টোয়েন্টির প্রথম ইনিংসে গড় স্কোর ছিল ১৬৮। যেটা ২০২১ সালে নেমে যায় ১২০ এর নিচে। ২০২৩ সালে ১৩৭ পর্যন্ত উঠেছিল গড় স্কোর। ২০১৮ ও ২০১৯ সাল বাদ দিলে বাকি সব বছরেই গড় স্কোর ছিল ১৬০ এর নিচে। সারাবছর স্লো উইকেটে খেলে অভ্যস্ত বাংলাদেশ দল দেশের বাইরে তাই দেখিয়েছে হতশ্রী পারফরম্যান্স। 

সিলেট ও চট্টগ্রামে বড় রানের কথা বলা হলেও সেখানে ম্যাচের সংখ্যা অপ্রতুল। গড় রানের গ্রাফেও তাই ওঠানামা অনেকটাই বেশি। অবশ্য অজুহাতের বাইরে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টি মানসিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতেই পারে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ১২ দশমিক ১ ওভারে ১১৬ রান করতে না পারার কথাটাও যে সহসা ভুলবার মতো নয়। 

টাইগার ব্যাটারদের ধারাবাহিক এই ব্যর্থতার প্রভাব পড়ছে খেলার মাঝেও। ঘরের মাঠে বিগত চার বছরের মাঝে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে সিরিজ হারানোর নজির থাকলেও মোটাদাগে ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছর এরইমাঝে ১০ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে হারের স্বাদ পেয়েছে নাজমুল শান্তর দল। এর আগে ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৬ ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ। সেই রেকর্ড অক্ষত থাকবে বছর শেষে, এটাই আপাতত পরিসংখ্যানের স্বান্তনা। 

জেএ