মাগুরার আলোকদিয়া থেকে মিরপুর। আটলান্টিক পাড়ের ক্যারিবিয়ান দ্বীপ হয়ে বেসিন রিজার্ভ থেকে ইডেন গার্ডেনস এরপর লর্ডস… গেল দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই সাকিব আল হাসান। ব্যাটে-বলে কিংবা ফিল্ডিংয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন অজস্রবার। সাকিবের লম্বা এই ক্যারিয়ারে ছিল বহু বিতর্ক, তবে ছিল অজস্র আনন্দ-বেদনার উপলক্ষ্য। 

সব ছাপিয়ে এবার যেন শেষের কাউন্টডাউনের শুরু। বাংলাদেশ দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আজ টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন টাইগার এই অলরাউন্ডার। খেলা চালিয়ে যাবেন কেবল ওয়ানডে ফরম্যাটে। তবে সেটাও পাবেন কেবল ছোট এক সময়ের জন্য। সব ঠিক থাকলে ২০২৫ সালের প্রথমাংশ পর্যন্ত! 

ব্যক্তি সাকিবকে নিয়ে অনেক কথা সমালোচনা থাকতেই পারে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নির্বাক ভূমিকা কিংবা তারও আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময়কার বিতর্ক সাকিবকে ঠেলে দিয়েছে অনেকটা দূরে। তবে ক্রিকেটার সাকিব অনবদ্য-অনন্য। এশিয়া কাপে ভারতকে হারানো কিংবা বিশ্বকাপে লঙ্কানদের বিপক্ষে ম্যাচজয়ী ইনিংসটা হয়ত এখনো ক্রিকেট ভক্তদের মনে জেগে আছে। জীবনানন্দ দাসের সেই কবিতার লাইনটা বলতে হয়, 'প্রেম ধীরে ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।' সাকিবের সাথে ক্রিকেট সমর্থকদের দূরত্বও বেড়েছে গেল জুলাই মাস থেকে। 

যদিও সাম্প্রতিক সময়টা ব্যাট হাতে ভালো যাচ্ছে না তার, এমনকি সবশেষ চেন্নাই টেস্টে বল হাতেও ব্যর্থ সাকিব। ছিল ইনজুরি সংক্রান্ত আলোচনা, এর মাঝেই জানিয়ে দিলেন অবসরের সিদ্ধান্ত। আচমকা সাকিবের এমন সিদ্ধান্তে ক্রিকেট অঙ্গনে নতুন করে দিয়েছে আলোচনার খোরাক। 

সাকিবের এমন অবসরের সিদ্ধান্তের পর ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপ করেছেন তার শৈশবের কোচ সাদ্দাম হোসেন গোর্কি। এছাড়া কথা বলেছেন জাতীয় দলের সাবেক দুই প্রধান কোচ স্টুয়ার্ট ল এবং জেমি সিডন্স। ঘরোয়া ক্রিকেটের নামকরা কোচ সোহেল ইসলামও কথা বলেছেন সাকিবের অবসর প্রসঙ্গে। 

মাগুরা থেকে গোর্কির কথা হয় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। আজকের সাকিবকে যিনি মাগুরা থেকে গড়ে তুলেছিলেন একেবারে কাঁচা হীরের মতো করে। প্রিয় শিষ্যর বিদায় ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবেই ভারাক্রান্ত মন গোর্কির। বলছিলেন, ‘অবসর নিয়েছে… অবসর নিয়েছে এটা একটা কষ্টের বিষয়। তারপরও সে যেটা ভালো মনে করেছে, নিজের সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত সেটাকে সম্মান করি। তবে সে চাইলে আরো কিছুদিন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা চালিয়ে যেতে পারত। টেস্ট থেকে অবসর নিছে সেটাকে সঠিক বলবো।’ 

চোখের সমস্যা নিয়ে গেল কিছু মাস থেকে ব্যাটিং করতে ভুগছিলেন সাকিব। গোর্কি জানালেন, ‘চোখের বিষয় নিয়ে তার সাথে যখন আমার আলাপ হয়েছিল। তখন আমি তাকে বলেছিলাম যে চোখটা একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে। যদি চোখ ঠিক না রেখে তুমি খেলতে নামো তাহলে পারফরম্যান্স করাটা কঠিন হয়ে যাবে। সাকিব বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে দেখেছিল। তারপরও কি একটা ক্রিকেটারের আসলে পারফরম্যান্স টা আপ-ডাউন হতেই পারে। যখন খারাপ করে তখন মানুষের কথাটা ওকে কষ্ট দেয়। তার জন্য শুভকামনা।’ 

সাকিব আল হাসান সবশেষ চলতি বছরের বিপিএলে খেলেছিলেন রংপুর রাইডার্সের হয়ে। যে দলের প্রধান কোচ ছিলেন সোহেল ইসলাম। আর সে সময়ই সাকিবের চোখের সমস্যা প্রকাশ্যে আসে। সাকিবের অবসর ঘোষণার পর অবশ্য সোহেল খানিকটা অবাক, ‘অবশ্যই একটু অবাক হতে হয়েছে। কেননা অন্যদের ক্ষেত্রে একটু বোঝা যায় অবসর নেবে এরকম কিছু।’ 

তবে সাকিবের অবসরের পেছনে সোহেল কারণ হিসেবে দেখছেন চোখের সমস্যাকে, ‘এতদিন ক্রিকেট খেলার পরে সেই বুঝতে পারে যে এখন অবসর নেওয়ার সময় কিনা। কোন ফরম্যাট কতদিন ধরে খেলবে এখন তার ব্যাপার সেটা। তার শারীরিক অবস্থা কেমন সেই বলতে পারবে। চোখের সমস্যাটা ফ্যাক্ট না আমার মনে হয়। এগুলো আসলে ও বলতে পারবে, আমার দূর থেকে আসলে বলাটা কঠিন। অবাক একটা ব্যাপার থাকে বয়সটা একটা ফ্যাক্ট। এটা যে আজকে হবে আর দুদিন পর হবে এরকমই ছিল, কিছুটা আগে পরে।’ 

সাকিবের ক্যারিয়ারে যখন সোনালি অধ্যায় শুরু হয় তখন জাতীয় দলের প্রধান কোচ ছিলেন জেমি সিডন্স। ডেভ হোয়াইটমোরের তরুণ সাকিবকে বিশ্বমানের করে তুলেছিলেন এই সিডন্স। অবসর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর যোগাযোগ করা হয় অজি এই কোচের সঙ্গে। ক্ষুদে বার্তায় জানালেন সাকিবকে মিস করার কথা। একইসঙ্গে শুভকামনাও জানাতে ভুললেন না।

সিডন্স বলছিলেন, ‘আমি শুধু বলতে পারি বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব কী অসাধারণ অবদান রেখেছে। এতদিন ধরে সে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। সে একজন বিশ্বমানের ক্রিকেটার ছিলেন এবং তাকে খুব মিস করব। আমি তার অবসরে মঙ্গল কামনা করি। একইসঙ্গে আমি বলতে চাই এবং খুব খুশি পুরো ক্যারিয়ারে তার সাথে কাজ করতে পেরেছি।’ 

সাকিব কেন আলাদা সেটাও স্পষ্ট করে সিডন্স জানালেন, ‘অনেক ভালো খেলোয়াড়ের মতো সাকিবও জিততে চাই এবং সেরা হতে চাই সবসময়। সে অন্যরকম প্রতিযোগী। সাকিব অন্যদের তাকে অনুসরণ করার জন্য মান নির্ধারণ করেছে।’ 

জাতীয় দলের আরেক সাবেক প্রধান কোচ স্টুয়ার্ট ল জানিয়েছেন সাকিবের অবসর প্রসঙ্গ নিয়ে। শুরুতে বলছিলেন, ‘সাকিব আল হাসান ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা না হলেও বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা। জাতীয় দলে তার অবদান এত বছর ধরে খেলছে দুর্দান্ত। দীর্ঘ বছর ধরে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার থাকা তার প্রতিভার এক প্রমাণ।’ 

অবশ্য ল বিশ্বাস করেন এখানেই শেষ না সাকিবের পথচলা। তরুণদের প্রয়োজনে সাকিব এগিয়ে আসবেন এমনটাই মনে করেন তিনি, ‘জাতীয় দল অবশ্যই একজন খেলোয়াড় হিসেবে সাকিবকে মিস করবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে কোনো তরুণ খেলোয়াড়ের আত্মবিশ্বাসের যোগানোর জন্য সাকিব কেবল একটি ফোন কলের দূরত্বে থাকবে। একটি দুর্দান্ত ক্যারিয়ারের জন্য অভিনন্দন, শুভকামনা সাকিবকে।’ 

এসএইচ/জেএ