২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে মনোনয়নের ভিত্তিতে  সভাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। নাজমুল হাসান পাপনের বোর্ডে আসা সেই সুবাদেই। পরের বছর থেকে শুরু হয় নির্বাচিত হয়ে বিসিবির সভাপতিত্ব। ২০১৩ সালের পর থেকে পরের তিন মেয়াদে এভাবেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সভাপতি হয়েছিলেন নাজমুল হাসান পাপন। এর পরের গল্পটায় আছে আনন্দের উপলক্ষ্য, আছে বিতর্ক আর ব্যাপক সমালোচনা। 

বোর্ড সভাপতির পাশাপাশি পাপন ছিলেন রাজনীতির মানুষ। ক্রিকেট বোর্ডেও ছিল এর প্রভাব। বলা চলে মিরপুর শের-ই বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এককভাবে রাজ করেছিলেন সদ্য সাবেক এই সভাপতি। পাপনের সঙ্গেই একসময় বিরোধে জড়িয়ে প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ফারুক আহমেদ। ভাগ্যের ফেরে তিনিই হয়েছেন নতুন বোর্ড সভাপতি। 

টানা ১২ বছর সভাপতি থাকায় ক্রিকেট বোর্ডের প্রায় সবখানেই নিজের পছন্দের লোক বসিয়েছেন তিনি। নাইমুর রহমান দুর্জয়, ইসমাইল হায়দার মল্লিকরা ক্রিকেট বোর্ডে প্রভাবশালী হয়েছেন পাপনের মেয়াদে থাকা অবস্থায়। অবশ্য এই প্রভাবের পেছনে আওয়ামী রাজনীতিরও ব্যাপক ভূমিকা ছিল। 

স্বেচ্ছাচারিতার এমন এক পর্যায়ে পাপন ছিলেন, যেখান থেকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকে দেখিয়েছেন বৃদ্ধাঙ্গুলি। বোর্ডের নিয়মে দুজন সহ-সভাপতি থাকার কথা থাকলেও পাপনের বোর্ডে ছিলেন না কেউই। যে কারণে ৫ আগস্ট তিনি আত্মগোপনে চলে গেলে ক্রিকেট বোর্ডের স্বাভাবিক নিয়মে চলে আসে স্থবিরতা। 

অর্থের প্রাচুর্য আর ইমেজের সংকট 

নাজমুল হাসান পাপনের একমাত্র সাফল্য বলা চলে দেশের মাঠ মিরপুরকে দুর্গ বানিয়ে ফেলা। পিচ কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার অধীনে স্পিন সহায়ক উইকেট বানিয়ে মিরপুরের মাঠকে বড় দলগুলোর বধ্যভূমিই করে ফেলেছিলেন। আইসিসির কাছ থেকেও একাধিকবার ডিমেরিট পয়েন্ট পেতে হয়েছে হোম অব ক্রিকেটকে। তবে সেসব উন্নয়নে যেন নজর ছিল না কখনোই। বরং একের পর এক সিরিজ জয়েই তৃপ্ত হয়েছেন তিনি। 

দ্বিপাক্ষিক সিরিজের বাইরে নাজমুল হাসান পাপনের সাফল্য নেই কোনো দিক থেকেই। ক্রিকেটারদের বাজে পারফর্মের পর বারবার তদন্ত কমিটি করেছিলেন। তবে আলোর মুখ দেখেনি সেসব। ২০২৩ বিশ্বকাপের তদন্ত কমিটির কথাই এক্ষেত্রে সবশেষ উদাহরণ। 

২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের বাইরে ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে এশিয়া কাপের ফাইনাল বাংলাদেশ খেলেছে। তবে এসময় ক্রিকেটারদের কোচ নিয়েও দেখা গিয়েছে সমস্যা। একের পর এক কোচ বাংলাদেশকে বিদায় বলেছেন অপমান এবং যন্ত্রণা নিয়ে। 

এতকিছুর পরেও বিসিবি সভাপতি হিসেবে পাপনের তৃপ্তি ছিল এফডিআর অ্যাকাউন্টে ৯০০ কোটি টাকা। যদিও শেষদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট স্পন্সর সংকটে ভুগেছে সেটাও সত্য। বর্তমান স্পন্সর ‘রবি’ বাংলাদেশ ক্রিকেটে যুক্ত হয়েছে আগের মেয়াদের ১৪ কোটি টাকা কম অর্থের চুক্তিতে। সেটা চুক্তি স্বাক্ষরের দিনেই স্বীকার করেছিল বিসিবি। এর আগে নভেম্বরের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর একটা বড় সময় স্পন্সর ছাড়াই থাকতে হয়েছিল শান্ত-সাকিবদের। 

মানহীন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, প্রশ্নবিদ্ধ ঘরোয়া ক্রিকেট 

দেশের ক্রিকেটের মেরুদণ্ডটাই এক অর্থে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল বিগত ১ যুগে। যে দেশ থেকে একসময় সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল কিংবা মুশফিকুর রহিমরা উঠে এসেছেন, সেখানেই এখন ধারাবাহিক পারফর্ম করা ক্রিকেটারদের অভাব। রুবেল হোসেন, ইমরুল কায়েসদের মতো অনেকেই অভিযোগ করেছেন এই বোর্ডের অধীনে ক্রিকেটারদের প্রতিভা নষ্ট হয়েছে। 

দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিপিএল। ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটে সারাবিশ্বে জনপ্রিয়তা যখন আকাশ ছুঁয়েছে, তখন বিপিএলকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। নিম্নমানের পিচে একের পর এক ম্যাচ খেলিয়ে বিপিএলকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল ধ্বংসের প্রান্তে। যদিও সেখান থেকে ফিরে আসার কার্যকরী কোনো উদ্যোগ বোর্ড বা বোর্ড প্রেসিডেন্টের কাছে কখনোই দেখা যায়নি। 

আর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিম্নমানের আম্পায়ারিং নিয়েও কখনোই মুখ খুলতে দেখা যায়নি নাজমুল হাসান পাপনকে। বোর্ড সভাপতি হয়ে পাপন ছিলেন আবাহনীর পৃষ্ঠপোষক। সেই ফায়দাও দেখা গিয়েছে অজস্রবার। সাকিবের স্ট্যাম্পে লাথি মেরে ভাঙার ঘটনা আজও সবার চোখে ভাসলেও সেইসব অপকর্ম নিয়ে বরাবরই নীরব ছিলেন পাপন। 

অপব্যয় এবং শুধুই অপব্যয় 

খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম, বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম কিংবা নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামগুলোতে ক্রিকেট নেই আজ দীর্ঘদিন। পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে কিছু স্টেডিয়াম হয়েছে নষ্ট। কোথাও গজিয়েছে মাদকের আড্ডাখানা। বিপরীতে পুর্বাচলে শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পরামর্শকের জন্যই নাজমুল হাসান পাপনের বোর্ড খরচ করেছে ৭৬ কোটি টাকা। এমনকি সবশেষ বাজেটেও এই স্টেডিয়ামের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৫০ কোটি টাকা। 

স্টেডিয়ামের মান উন্নয়ন আর ক্রিকেট ছড়িয়ে দেয়ার বদলে অপব্যয়ে সময় পার করেছে নাজমুল হাসান পাপনের বোর্ড। বিপিএলের নামে কোটি টাকার অপব্যয় যেমন ঘটেছে প্রতিবছরে। তেমনি শুধু মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের কনসার্টে বিসিবি খরচ করেছে ২০ কোটি টাকা। দেশের স্থানীয় কোচরা যেখানে জীবন চালাতেই হিমশিম খেয়েছে, তখন অভিভাবক হিসেবে বিসিবি দেখিয়েছে অর্থ অপব্যয়ের নতুন নজির।   

জেএ/এফআই