দ্য ওয়াল, দ্য চ্যাম্পিয়ন
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেই ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। অধিনায়ক হিসেবে ব্যর্থ দ্রাবিড় ১৭ বছর পর সেই ক্যারিবিয়ানেই শিরোপার দেখা পেলেন। ভারত তো বটেই বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রাহুল তার খেলোয়াড়ী জীবনের অপূর্ণতাই যেন পূরণ করেছেন কোচ হয়ে।
ফুটবলে খেলোয়াড় পরিবর্তন, দল নির্বাচন, একাদশ গঠন সব কিছুই কোচ নির্ভর। ক্রিকেটে নির্বাচকরাই মূলত দল গড়েন। কোচ প্রতিপক্ষ অনুযায়ী গেম প্ল্যান তৈরি করেন। খেলা শুরুর পর ব্যাটিং পুরোটাই ব্যাটসম্যানের ওপর। পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তনে কোচের ভূমিকা থাকে আর বোলার পরিবর্তন-ফিল্ডিং সাজানোর কাজটা অধিনায়কেরই।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
ক্রিকেটে কোচের চেয়ে অধিনায়করা আলোচনায় বেশি থাকেন। কোচ-অধিনায়ক সম্পর্ক ও কোচ-খেলোয়াড় দ্বন্দ্ব কি এটা দ্রাবিড়ের চেয়ে ভালো আর কে জানেন! ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের কোচ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান গ্রেগ চ্যাপেল। এই অজি ক্রিকেটার কোচ হওয়ার পর থেকেই ভারতীয় সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে দ্বৈরথ শুরু হয়। দ্রাবিড় অধিনায়ক থাকায় সকল ঝড় তার ওপর দিয়েই যায়। ২০০৭ বিশ্বকাপে দ্রাবিড়ের দল ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল কোচ-খেলোয়াড় দ্বন্দ্ব।
ভারতীয় ক্রিকেটে মিডিয়ার সমালোচনা-সিনিয়র ক্রিকেটারদের আন্তঃসম্পর্ক বরাবরই ইস্যু হয়। কোহলি থেকে রোহিতের অধিনায়কত্ব নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি। দ্রাবিড় কোচ হিসেবে সব কিছুই দারুণভাবে সামলেছেন। মাঝে রবি শাস্ত্রী টিম ইন্ডিয়ার কোচ ছিলেন। সেই সময় অনেক সমালোচনার জন্ম হয়েছিল। দ্রাবিড়ের ভারতকে নিয়েও মাঝে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে তবে কখনোই সেই সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দ্রাবিড় ছিলেন না। তার কোনো মন্তব্য, আচার-আচরণ, কর্মকান্ড প্রশ্নের সৃষ্টি করেনি।
কপিল, শচীন, সৌরভ, ধোনী ভারতীয় ক্রিকেটের বড় চরিত্র। সৌরভ বাদে বাকিরা বিশ্বকাপের স্বাদ পেয়েছেন। সৌরভ পরবর্তীতে দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পদে আসীনও হয়েছেন। দ্রাবিড় ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার পরও সেই মাঠের ক্রিকেটের সঙ্গেই রয়েছেন। কখনো ভারতের ভবিষ্যত ক্রিকেটার তুলে আনার রুপরেখা করছেন আবার কখনো দলকে বিশ্বসেরা করার দীক্ষা দিচ্ছেন। ধাপে ধাপে ভারতে ক্রিকেটের প্রতি স্তরে কোচিং করিয়ে নিজেকে সর্বোচ্চ স্তরে এনেছেন। কৌশল, ক্রিকেট মানসিকতায় অনেক কিছুতেই দ্রাবিড় পরিবর্তন এনেছেন তার কোচিংয়ের সময়। এরপরও বিশ্বকাপের ট্রফি না জেতায় অধরা ছিল সব কিছুই।
গত বছর ভারতের মাটিতে দ্রাবিড়ের শিষ্যরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ ট্রফি হারিয়েছিল। এরপরই দ্রাবিড় দায়িত্ব ছাড়তে চেয়েছিলেন। ভারতীয় বোর্ডের অনুরোধে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন। এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপের আরেক সংস্করণে চ্যাম্পিয়ন হয়েই কোচ দ্রাবিড় আপাতত এই অধ্যায়ের সমাপ্তি করলেন। সাফল্য-ব্যর্থতার বিশ্লেষণের চেয়ে এই ট্রফি ভারতের ক্রিকেটকেই অনেকটা পরিপূর্ণ করল। যে কোনো পরিচয়েই রাহুল দ্রাবিড়ের নামের পাশে একটি বিশ্বকাপ ট্রফি থাকা যে বড্ড প্রয়োজন! তাই তো কোহলি-রোহিতরা বাড়তি তৃপ্ত এবং সারাজীবন অর্ন্তমুখী স্বভাবের দ্রাবিড়ও করেছেন বাড়তি উচ্ছ্বাস। এ যে বিশ্বকাপ ট্রফি!
টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দশ হাজারের বেশি রান, টেস্টে সবচেয়ে বেশি বল মোকাবেলা, ক্রিজে থাকা আরো অনেক রেকর্ড ব্যাটসম্যান দ্রাবিড়ের রয়েছে। এসব অঙ্ক দ্রাবিড়ের মাহাত্ম প্রকাশ করে না মোটেও। অনেক ম্যাচেই শচীন-গাঙ্গুুলী দ্রুত আউটের পর দ্রাবিড় ভারতের প্রাচীর হয়ে দাড়িয়েছেন। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে দলকে জিতিয়েছেন আবার কখনো হার বাঁচিয়েছেন। এজন্য তিনি দ্য ওয়াল খেতাব পেয়েছেন।
শচীন বিশ্বক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। তবে এক দিক থেকে তিনি রাহুলের পেছনে। ভারতের জয় পাওয়া ম্যাচে শচীনের চেয়ে রাহুলের রান বেশি। রেকর্ড, অবদান অনেক নিরিখেই রাহুল কিংবদন্তী এরপরও পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ছিলেন পার্শ চরিত্রে।
শুধু ব্যাটসমস্যান দ্রাবিড় নিয়ে আলোচনা করলে সেটা ক্রিকেটার দ্রাবিড়ের প্রতি অবিচার। টেস্ট ফিল্ডার হিসেবে সর্বোচ্চ ২১০ ক্যাচ নেয়ার রেকর্ড দ্রাবিড়েরই। মাহেলা জয়াবর্ধনের পাশাপাশি তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা স্লিপ ফিল্ডার। আবার দলের প্রয়োজনে উইকেট রক্ষার কাজও করেছেন নিরলসভাবে।
ক্রিকেটার দ্রাবিড় না কোচ দ্রাবিড় এগিয়ে এ নিয়ে ক্রিকেট বিশ্ব নতুন বিতর্ক করতেই পারে। কারণ দুই ভূমিকায়ই দারুণ সফল তিনি। তবে ক্রিকেটার, কোচ দ্রাবিড়ের চেয়ে ব্যক্তি দ্রাবিড় যে সবচেয়ে বড় এ নিয়ে বিশ্বের কেউ দ্বিমত করবে না। জীবনে ৫০ বসন্ত পার করা দ্রাবিড়ের গায়ে কলঙ্ক তো দূরের কথা কোনো বিতর্ক নেই। ক্রিকেটার, কোচ হিসেবে যেমন পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি, ব্যক্তি দ্রাবিড় তার চেয়েও বেশি। অনেক খেলোয়াড়ই ব্যক্তিজীবনে নানা ঘটনায় খবরের শিরোনাম হন। দ্রাবিড় সেই ধাচের নন। এত বড় ক্রিকেটার ও ভারতের হেড কোচ এরপরও ছেলে দেখতে সাধারণ গ্যালারিতে বসে যান। দ্রাবিড়ের কোনো মন্তব্য ক্রিকেটাঙ্গনে বিতর্কের জন্ম দেয়নি। উল্টো আইসিসি অনেক সভা-সেমিনারে দ্রাবিড়কে বিশেষ বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করেন। বক্তা দ্রাবিড় যেন ক্রিকেটের দার্শনিকও!
ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন, ভালোবাসা, অধ্যবসায় ব্যক্তিত্ব প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি অনন্য উচ্চতায়। সৌরভ গাঙ্গুলী তার বন্ধুস্থানীয়। সৌরভ যখন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রধান তখন দ্রাবিড় বাড়তি কোনো প্রভাব বা সৌরভের অধীনে কাজ-কর্মে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশে তামিম-সাকিব দ্বন্দ্ব তো বোর্ড সভাপতিই প্রকাশ করেছেন। এর প্রভাব এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ। শুধু ক্রিকেটাররাই নন তাদের স্ত্রী-ভাইও ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মন্তব্য-কটাক্ষ করেন। সেটাও গণমাধ্যম ও জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার খোরাক হয়।
এজেড/এইচজেএস