# দ্বিপাক্ষিক সিরিজে জয়ই সান্ত্বনা, টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মাত্র একবার
# সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে শত গুণ, প্রশ্নবিদ্ধ পারফরম্যান্স ও নিবেদন
# বিসিবি’র মনোযোগ ক্রিকেটে নাকি স্টেডিয়াম-টিভি-রিজার্ভে!
# ‘ভঙ্গুর’ ঘরোয়া ক্রিকেট ব্যবস্থা!
# ‘তুলোধুনো’ সালাউদ্দিন, পাপন ‘জিন্দাবাদ’!

আফগানিস্তানের কাবুলে যখন রাজ্যের আনন্দ, বাংলাদেশের ঢাকায় তখন ঘোর অমানিশার হতাশা। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে, আর প্রায় হাজার কোটি টাকা রিজার্ভ থাকা ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দল সুপার এইটে সব ম্যাচ হেরে দেশে ফেরার অপেক্ষায়। এ যেন আফগান সাফল্য আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নির্মম বাস্তব চিত্র নিদারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। 

১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ মঞ্চে খেলছে। দুই যুগেরও বেশি সময়ে সাতটি ওয়ানডে ও নয়টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে মোট ১৬টি বিশ্বকাপ খেলেছে বাংলাদেশ। দুই ফরম্যাটের বিশ্বকাপ মিলিয়ে টাইগাররা খেলেছে মোট ৯৪টি ম্যাচ। এর মধ্যে জয় মাত্র ২৮টিতে। যা শতাংশের হিসাবে ৩০–এর নিচেই।

অন্যদিকে, ২০০৭-১৫ পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছে আয়ারল্যান্ড। তারা ২১ ম্যাচের মধ্যে সাতটিতে জয় পেয়েছে। যা শতকরা হারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ২০১০ সাল থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা আফগানিস্তান ২৯ ম্যাচের মধ্যে ১২টিতে জিতেছে। সাকিব–শান্তদের পরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়া দুই দেশেরই জয়ের শতাংশ ঢের বেশি।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল খুব সামান্য প্রস্তুতিতে। অভিষেক বিশ্বকাপেই তারা দুই ম্যাচে জিতেছিল। আর দুই যুগ পর ২০২৩ সালেও ক্রিকেটাররা কোটি টাকার মালিক ও দশের অধিক কোচিং স্টাফ নিয়ে দুই ম্যাচই জেতেন! দেড় যুগ আগে প্রতিপক্ষ তিনশো’র অধিক রান করলেও বাংলাদেশের লক্ষ্য থাকতো ৫০ ওভার ব্যাট করে সম্মানজনক ব্যবধানে হার। এতদিন পরও সেই মানসিকতার বৃত্তেই আটকে আছে বাংলাদেশ।

১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ দিয়ে বাংলাদেশের বৈশ্বিক মঞ্চে পদার্পণ। অভিষেক আসরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে বাংলাদেশ। এর পরের ২০০৩ বিশ্বকাপে কেনিয়া সেমিফাইনালে খেলে। অথচ বাংলাদেশ কখনও সেমিফাইনালে উঠতেই পারেনি। ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ২-৩ ম্যাচ জয় ও সুপার এইট/কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত খেলেই তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। 

ওয়ানডে বিশ্বকাপে ১৬ জয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ তিনটি এসেছে আফগানিস্তানের বিপক্ষে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দু’টি করে জয়। একটি করে জিতেছে ভারত, পাকিস্তান, নেদারল্যান্ডস, শ্রীলঙ্কা ও বারমুডার বিপক্ষে। পক্ষান্তরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ বার, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বিপক্ষে ৪ বার করে; আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ বার করে; পাকিস্তান ২ বার, কানাডা, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে একবার করে হারের রেকর্ড রয়েছে। 

২০০৭ সালে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের বিশ্বকাপ শুরু হয়। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৪৫টি ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে জয় মাত্র ১২ ম্যাচে। সর্বোচ্চ তিনটি জয় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এরপর দু’টি করে জয় নেপাল ও ওমানের সঙ্গে। পাপুয়া নিউগিনি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতেছে একটি করে ম্যাচ। অর্থাৎ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মঞ্চে বাংলাদেশের প্রাপ্ত জয়ের অধিকাংশই দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গে, প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট শক্তির সঙ্গে জয়ই নেই! যাদের সঙ্গে রয়েছে তা-ও সেটি একবারের বেশি নয়।

ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ২৪ ম্যাচ খেলে একবারও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি স্কটল্যান্ড, হংকং, আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একবার করে হারের রেকর্ড রয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ৩২ ম্যাচের বাকি হারগুলো যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দু’টি করে। 

দ্বিপাক্ষিক সিরিজে জয়ই সান্ত্বনা, টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মাত্র একবার

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের ওয়ানডে অভিষেক হয় এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে। এরপর তিন যুগে বাংলাদেশ ত্রিদেশীয়, মহাদেশীয় ও বৈশ্বিক অনেক টুর্নামেন্টই খেলেছে। এখন পর্যন্ত মাত্র একটি টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে বাংলাদেশ পুরুষ দল। ২০১৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে আয়ারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো কোনো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। টুর্নামেন্টে ব্যর্থতার বিশ্লেষণ ও উন্নতির চেয়ে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতেই তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন ক্রিকেটার ও বোর্ড কর্তারা। সেই জয়ও অধিকাংশ ঘরের মাঠে। যেখানে উইকেট নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বরাবরই।

ওয়ানডেতে বাংলাদেশ মাত্র পাঁচবার টুর্নামেন্টের (বহুজাতি সিরিজ) ফাইনালে উঠেছে। তবে বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বৈশ্বিক আসরের সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি এখনও। বাংলাদেশ মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে মাত্র দুই বার। ২০১২ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে হারের পর ১৮ সালে দুবাইয়ে ভারতের বিপক্ষে হেরেছিল। ঢাকায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই বার ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে হেরেছে বাংলাদেশ। একমাত্র জয় ২০১৯ সালে আয়ারল্যান্ডে হওয়া ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে।

ওয়ানডেতে একটি টুর্নামেন্ট জিতলেও টি-টোয়েন্টিতে একটি ফাইনালও জিততে পারেনি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। ২০১৬ এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তারা ভারতের বিপক্ষে হেরেছিল। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় নিদহাস ট্রফিতে ভারতের বিপক্ষে শেষ বলে হেরেছিল বাংলাদেশ। পুরুষ ক্রিকেটাররা ব্যর্থ হলেও, নারী ক্রিকেট দল এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঠিকই। 

সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে শত গুণ, প্রশ্নবিদ্ধ পারফরম্যান্স ও নিবেদন

নব্বই দশক পর্যন্ত দেশের দুই শীর্ষ খেলা ছিল ফুটবল ও হকি। সত্তর-আশি দশকের ক্রিকেটাররা অনেকটা ভালোবেসেই ক্রিকেট খেলেছেন। দেশের হয়ে খেললেও পেতেন না কিছুই। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন ও ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর সেই চিত্র বদলাতে শুরু করে। এরপরও হাবিবুল বাশার সুমন, খালেদ মাসুদ পাইলটরা এখনকার সুযোগ-সুবিধার চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলেন। ২০০৭ সাল পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আয়ের পরিধি ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। 

কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটাররা ক্যাটাগরিভেদে বছরে ১৫ লাখ থেকে কোটি টাকার কাছাকাছি পান। মাসিক বেতন ছাড়াও, ম্যাচ ফি, বোনাস তো রয়েছেই। এরপর বিপিএল, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় লিগে খেলেও অর্থ আয় করেন তারা। অনেকে দেশের বাইরে লিগ খেলেন এবং তারকা ক্রিকেটাররা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দূত হিসেবেও আয় করেন কাড়ি কাড়ি অর্থ।

আর্থিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা পেয়ে থাকেন অন্যান্য সর্বোচ্চ সুবিধাও। অনুশীলনে একাধিক বিদেশি কোচিং স্টাফ, সর্বাধুনিক ক্রীড়া সরঞ্জাম ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। এর সঙ্গে রয়েছে অগণিত ক্রীড়াপ্রেমীর ভালোবাসা। এত কিছুর পরও ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নবিদ্ধ। ধারাবাহিকভাবে রান কিংবা উইকেট নিতে পারেন না অনেকেই।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ের পর

দলীয় খেলা ক্রিকেটে বাংলাদেশ বড় ব্যবধানে হেরেছে, অথচ দেখা যায় কারও ব্যক্তিগত ফিফটি বা কয়েক উইকেট নিয়ে চলে বন্দনা। ক্রিকেট বোর্ডের এত বিনিয়োগ ও দেশবাসীর প্রত্যাশা অধিকাংশ সময় পূরণ করতে ব্যর্থ হন ক্রিকেটাররা। এতে তারা যেন থোড়াই কেয়ার! অনেকেই সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে। অনেকে নিজেদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডকে এতটাই প্রাধান্য দেন যে ক্রিকেটটা হয়ে উঠে গৌণ!  

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল খুব সামান্য প্রস্তুতিতে। অভিষেক বিশ্বকাপেই তারা দুই ম্যাচে জিতেছিল। আর দুই যুগ পর ২০২৩ সালেও ক্রিকেটাররা কোটি টাকার মালিক ও দশের অধিক কোচিং স্টাফ নিয়ে দুই ম্যাচই জেতেন! দেড় যুগ আগে প্রতিপক্ষ তিনশো’র অধিক রান করলেও বাংলাদেশের লক্ষ্য থাকতো ৫০ ওভার ব্যাট করে সম্মানজনক ব্যবধানে হার। এতদিন পরও সেই মানসিকতার বৃত্তেই আটকে আছে বাংলাদেশ। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার এইটের শেষ দুই ম্যাচে সঠিক মানসিকতা-ও ছিল না। ভারতের বিপক্ষে লক্ষ্য ছিল হার এড়ানো আর পরের ম্যাচে আফগানদের বিপক্ষে সেমিফাইনালের চেয়ে কোনোমতে জয় নিয়ে দেশে ফেরে বাহবা নেওয়া! ফলে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সামর্থ্য ও মানসিকতার উন্নতি কোথায় সেই প্রশ্নই ঘুরে-ফিরে আসছে। 

বিসিবি’র মনোযোগ ক্রিকেটে নাকি স্টেডিয়াম-টিভি-রিজার্ভে!

২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থতার পর তদন্ত কমিটি করেছিল বিসিবি। তদন্ত কমিটি দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎ পেতেই গলদঘর্ম হয়েছে। কয়েক মাস ধরে চলা সেই তদন্তের কার্যকরি কোনো পদক্ষেপই দৃশ্যমান হয়নি। দুই বছর আগে ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর বোর্ড সভাপতি ও বর্তমান ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন বলেছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য পরের বিশ্বকাপ।’ সেই ‘‘পরের বিশ্বকাপে’’ বাংলাদেশের অভিযান শেষ হয়েছে গতকাল। আমেরিকার বিপক্ষে সিরিজ হার দিয়ে শুরু, এরপর বিশ্বকাপের সুপার এইটে যাওয়াই বোর্ডের জন্য এখন তৃপ্তির ঢেকুর তোলার পর্যায়ে। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তো বলেছেনই, ‘সুপার এইটে যা পাওয়া যাবে সেটাই বোনাস।’

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নয়ন নেই। সাকিব-তামিমের যোগ্য বিকল্প ওঠে আসছে না। জাতীয় দল বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্রমাগত ব্যর্থ। এসব নিয়ে বোর্ড ভাবনাহীন। বছর বছর বোর্ডের রাজস্ব আয় বেড়ে রিজার্ভ হাজার কোটির কাছাকাছি, এটাই তাদের বড় তৃপ্তি। এখন নতুন ধ্যানজ্ঞান শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ। দেশের সকল ক্রীড়া স্থাপনা নির্মাণ করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এই স্টেডিয়াম বিসিবি নিজেদের অর্থে নিজেরাই তৈরি করছে। বিসিবি নিজেই টিভি চালু করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। যে কারণে ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সর্বশেষ এজিএমে অনুমোদন নিয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে ক্রিকেট বোর্ডের মনোযোগ কি আদৌ ক্রিকেটে রয়েছে?

‘ভঙ্গুর’ ঘরোয়া ক্রিকেট ব্যবস্থা!

দুই যুগেরও বেশি সময় টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। এরপরও ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি। এর পেছনে মূল কারণ– বোর্ডে পদ ধরে রাখতে নানা পরিকল্পনা আঁটেন কর্তারা। সেই নীল-নকশার বলি হয় ঘরোয়া ক্রিকেট। এর প্রভাব পড়ে জাতীয় দলে এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের অর্জন হ্রাস পাচ্ছে ক্রমাগত। 

বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রে একজনের এক ভোট। হঠাৎ ক্রিকেট বোর্ড গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে প্রিমিয়ার লিগের সুপার লিগে শীর্ষ ছয় দলকে দুই ভোট প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। বৈষম্যমূলক এই সিদ্ধান্তের জন্য বেশ কয়েক বছর প্রিমিয়ার লিগে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে একটি দলকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বেশি। প্রিমিয়ার লিগে জাতীয় দলের প্রায় সব ক্রিকেটাররাই খেলেন। এই লিগে যদি আউট-নট আউট হয় বা নট আউট-আউট হয়, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রিকেটারদের সঠিক পারফরম্যান্স প্রত্যাশা করা সমীচীন নয়!

ক্রিকেটের স্বার্থেই নাকি সুপার লিগের ৬ ক্লাবকে দুই ভোট প্রদান প্রয়োজন ছিল। এমন বুলি আওড়ানো কর্মকর্তারাই আবার সম্প্রতি গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে এক ভোটের নিয়মে ফিরেছেন। ক্রিকেটীয় স্বার্থের চেয়ে কর্তাদের চেয়ার ধরে রাখার স্বার্থই যেন বড়। 

সর্বোচ্চ স্তর প্রিমিয়ার লিগে যখন এই অবস্থা তখন নিচের স্তর, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। ঢাকার নিচের স্তরের ক্রিকেটে আম্পায়ারিং ও ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ ভয়াবহ। জুনিয়র ক্লাব পর্যায়ে ক্রিকেটার ও কর্তাদের অনুযোগ, কোন বিভাগ থেকে কোন দলকে উঠানো হবে, কোন দলকে নামানো হবে সেটা নাকি আগেই নির্দেশিত। আম্পায়াররা সেই নির্দেশিত চিত্রনাট্যই বাস্তবায়ন করেন। ফলে জুনিয়র পর্যায় থেকে মেধাবী ও প্রকৃত ক্রিকেটার আসার পথ প্রায় রুদ্ধ। এর প্রভাব সরাসরি জাতীয় দলে পড়ে।

চলতি বিশ্বকাপেও তুমুল উন্মাদনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যালারিতে ছিলেন বাংলাদেশি সমর্থকরা

ক্রিকেট বোর্ডের কোষাগারে রয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। অথচ অনেক জেলায় ক্রিকেট খেলার জন্য ভালো উইকেট নেই। একেবারে নিম্নমানের উইকেটে খেলা হয় জাতীয় পর্যায়ের বেশকিছু টুর্নামেন্টও। মানহীন উইকেটে খেলে ভালো মানের আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় পাওয়ার প্রত্যাশা বাতুলতা ছাড়া কিছু নয়। অনেক জেলায় ঘরোয়া লিগ নেই দীর্ঘদিন। নামকাওয়াস্তে জাতীয় লিগে অংশগ্রহণ করে, তবে ঠিকই আবার তারা কাউন্সিলরশিপ ধরে রাখে। যে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের এমন দশা, সেই দেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো করবে এই প্রত্যাশা করা বাড়াবাড়ি! 

‘তুলোধুনো’ সালাউদ্দিন, পাপন ‘জিন্দাবাদ’!

দেশের দুই শীর্ষ খেলা ফুটবল ও ক্রিকেট। অন্য সব ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক নির্ভর হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও ফুটবল ফেডারেশন পুরোটাই সভাপতির কর্তৃত্বে। ক্ষমতা যেমন সভাপতির, তেমনি জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতাও তাদের ওপরই বর্তায়। 

কাজী সালাউদ্দিন বাফুফেতে ১৬ বছর আর নাজমুল হাসান পাপন বিসিবিতে প্রায় ১২ বছর প্রধান পদে রয়েছেন। ২০০৮-১৪ পর্যন্ত কাজী সালাউদ্দিনের সমালোচনা হলেও সেটা সামান্য পর্যায়ের। ২০১৫ সাল থেকে ফুটবলের ব্যর্থতায় সরাসরি সালাউদ্দিনের সমালোচনা শুরু। জাতীয় দল কমিটি থাকলেও সমালোচনার দায়ভারে বিদ্ধ হন তিনি-ই। ফুটবলের ব্যর্থতা ও ফেডারেশনের নানা কর্মকাণ্ডের জন্য সাবেক ফুটবলার ও সংগঠকরা কয়েক বছর ধরেই ‘সালাউদ্দিন হটাও’ ও পদত্যাগের দাবি তুলে আসছেন। শুধু গণমাধ্যম, সাধারণ ফুটবলাঙ্গন বা সামাজিক মাধ্যমেই নয়, কাজী সালাউদ্দিন চাপে থাকেন নির্বাহী কমিটিতেও। অনেক কর্মকর্তা সভায় সালাউদ্দিনের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা ও সমালোচনা করেন। যদিও সালাউদ্দিনের ইচ্ছা-ই বাস্তবায়ন হয় শেষ পর্যন্ত।

এরপর কমিটির অনেকেই আড়ালে-আবডালে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। বার্ষিক সাধারণ সভায় কাউন্সিলররাও সরাসরি কাঠগড়ায় দাঁড় করান সালাউদ্দিনকে। যদিও ২০১৬ ও ২০২০ সালে বেশি ভোট পাওয়ায় তৃতীয় ও চতুর্থ মেয়াদে সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১২ সালে অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বসেছিলেন বাফুফের প্রধান এই পদে।

বিসিবি-বাফুফের দুই প্রধান নাজমুল হাসান পাপন ও কাজী সালাউদ্দিন

অন্যদিকে, ক্রিকেটের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্বিপাক্ষিক কিছু সিরিজে সাফল্য ছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট গত এক যুগে বড় কোনো সাফল্য নেই (অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্যতীত)। সেই সাফল্যের অধিকাংশও তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গে। ক্রিকেট দলে শৃঙ্খলা, ঐক্য ও পেশাদারিত্বের সংকট যেমন আছে, তেমনি বোর্ড পরিচালকদের বক্তব্যই আবার নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। ক্রিকেট বোর্ডের এক পরিচালক প্রায়ই বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। যা বোর্ডের জন্য রীতিমতো বিব্রতকর। 

বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্রমাগত ব্যর্থতা, ঘরোয়া ক্রিকেটের ভঙ্গুর অবস্থা এসব নিয়ে ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের কাছে সভাপতি হিসেবে নাজমুল হাসান পাপন জবাবদিহি করতে বাধ্য। ক্রিকেট বোর্ড পরিচালকদের সভা কিংবা বার্ষিক সাধারণ সভা, এ নিয়ে কোথাও পাপনকে সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয় না, পদত্যাগ চাওয়া তো অনেক দূরের কথা। পরিচালকরা যেমন তোষামোদে ব্যস্ত, কাউন্সিলররাও তাদের চেয়ে একঢের এগিয়ে।

২০০৭ সাল পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আয়ের পরিধি ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটাররা ক্যাটাগরিভেদে বছরে ১৫ লাখ থেকে কোটি টাকার কাছাকাছি পান। মাসিক বেতন ছাড়াও, ম্যাচ ফি, বোনাস তো রয়েছেই। এরপর বিপিএল, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় লিগে খেলেও অর্থ আয় করেন তারা। অনেকে দেশের বাইরে লিগ খেলেন এবং তারকা ক্রিকেটাররা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দূত হিসেবেও আয় করেন কাড়ি কাড়ি অর্থ।

বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এখন ক্রীড়ামন্ত্রী। মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি বিসিবির পদে আছেন। বিসিবি সভাপতি হিসেবে এখনও তার মেয়াদ রয়েছে এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও বিসিবি আইনে বাধা না থাকায় দু’টোই চালিয়ে যাচ্ছেন একসঙ্গে। যদিও বিষয়টি নৈতিকভাবে সমীচীন নয়, কারণ আর কিছু নয়– ‘স্বার্থের সংঘাত’। মাস তিনেক আগে সর্বশেষ ক্রিকেট বোর্ডের এজিএমে কাউন্সিলররা পাপনকে এই মেয়াদে তো বটেই আগামীতেও তিনি যেন থাকেন সেই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। 

ক্রিকেট বোর্ডের তিন পরিচালক আবার ফুটবল ফেডারেশনের কাউন্সিলর। আবার ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির দুই জন কর্মকর্তা ক্রিকেট বোর্ডেরও কাউন্সিলর। দুই ফেডারেশনের কমন কাউন্সিলর প্রায় ৪০-৫০ জন। সেই কাউন্সিলরদের অনেকে ফুটবল ফেডারেশনের  এজিএমে রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেও ক্রিকেট বোর্ডের এজিএমে থাকেন থাকেন ভিন্ন চরিত্রে। বিসিবিতে গঠনমূলক সমালোচনা তো দূরের কথা, শুধু বোর্ডের স্তুতি গাইতে ব্যস্ত থাকেন তারা। এর কারণ সম্পর্কে অনেকের সঙ্গে আলাপ করে যা জানা যায় তার সারাংশটা এমন দাঁড়ায়– সমালোচনা বা বিরুদ্ধে কিছু বললে কাউন্সিলরশিপ হারানোর ভয় থাকে।

সেই ভয় একেবারে শুরুতেই ধরেছে। ২০১২ সালে পাপন সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে সভাপতি হয়েছিলেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি নির্বাচিত সভাপতি। ওই বছরই ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনে কাউন্সিলরশিপ নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। দীর্ঘদিন নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মিকু কাউন্সিলর হতে পারেননি। পরবর্তীতে অবশ্য বিসিবি জেলা-বিভাগীয় সংগঠকদের কাছে টেনে নেয়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে তাদের পুরোনো অফিস সুসজ্জিত করে ব্যবহারের অনুমতি দেয় সেই ফোরামকে। ফলে মিকুরাও এখন ‘পাপন জিন্দাবাদ’–এর নেতৃত্ব দেন। বছর খানেক আগে জেলা-বিভাগের সংগঠকরা অনুষ্ঠান করে পাপনকে সম্মাননাও দিয়েছেন। সেই সংগঠকদের অনেকেই জেলার ক্রিকেটে তেমন উন্নতি না করলেও, ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে অবশ্য কার্পণ্য করেন না। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া দুটি বিশ্বকাপেই সৌজন্যতার খাতিরে সরাসরি দেখেছেন অনেক কাউন্সিলর। ফলে বিসিবি’র এজিএমে সিইও-পরিচালকরা কিছু তোলার আগেই পাশ হয়ে যায়! 

এজেড/এএইচএস