ততক্ষণে সেমিফাইনালের আশা শেষ হয়ে গেছে বাংলাদেশের। আফগান বোলিং তোপে ব্যাটিং বিপর্যয়ের মুখে ম্যাচ জেতা নিয়েই ঘোর অনিশ্চয়তা। এমন সময় ক্যামেরায় ধরা পড়ে সাকিব আল হাসানের একটা দৃষ্টিকটু মুহূর্ত। ডাগআউটে চেয়ারের ওপর পা ঝুলিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখা যায় বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ খেলা অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডারকে। আয়েশী সাকিবের এই ছবিটা চাইলে প্রতীকী হিসেবে দেখতে পারেন আপনি। বিশ্বকাপজুড়েই যাকে সিরিয়াস হিসেবে খুব একটা দেখা মেলেনি।

একটু পেছনে ফেরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে চলমান বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাংলাদেশ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। টুর্নামেন্ট শুরুর আগমুহূর্তে আইসিসির সহযোগী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিরিজ হারের পর ব্যাকফুটে থেকেই আসর শুরু করেছিল তারা। গ্রুপপর্বের চার ম্যাচের তিনটিতে জিতে সুপার এইটে খেলবে বাংলাদেশ— এমন আশা হয়তো করেননি টাইগারদের অন্ধ সমর্থকও। যুক্তরাষ্ট্রে মিরপুরের মতো পিচে বোলারদের কল্যানে সেটিই হয়েছে।

গ্রুপপর্বের পর সুপার এইটে টানা দুই ম্যাচে বাজেভাবে হারের পর টাইগারদের বিদায় কার্যত নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তবে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে গ্রুপ জমিয়ে দেয় আফগানরা। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে সুযোগ এসে যায় বাংলাদেশের সামনেও। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ ভারতের ভূমিকা অস্বীকার করার জো নেই। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে তেইশ বিশ্বকাপ ফাইনালের বদলা নিয়েছে রোহিতরা। তাদের জয়ে সেমির দৌড়ে আশা বেঁচেছে বাংলাদেশেরও। 

ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছেন সাকিব। ছবি-সংগৃহীত

তবে সুবর্ণ সুযোগটা আর কাজে লাগানো গেল কই! অবশ্য শেষ চার নিশ্চিতের লক্ষ্যে শুরুতে ঠিকই আশা দেখিয়েছিলেন টাইগার বোলাররা। মাত্র ১১৫ রানে রশিদ খানদের আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেমিতে যেতে আফগানিস্তানের দেওয়া ১১৬ রানের লক্ষ্য ১২.১ ওভারের মধ্যে তাড়া করতে হতো নাজমুল হোসেন শান্তদের। সাত সকালে চোখ কচলাতে কচলাতে টিভি সেটের সামনে বসা ‘বেহায়া’ সমর্থকরা আশায় ছিলেন, শুধু জেতার জন্য নয়, সেমিফাইনালের লক্ষ্যেই ব্যাট করবে বাংলাদেশ।

কিন্তু ম্যাচের একটা সময়ে দলের ব্যাটারদের দেখে মনে হয়েছে পরের পর্বে যাওয়ার ইচ্ছাটাই যেন নেই কারও! কোনো রকমে ম্যাচটা জিতলেই যেন বেঁচেবর্তে যায়। ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে, ভীড়ুদের নয়। ঝুঁকিপূর্ণ ক্রিকেট খেলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত জয়টাও পাওয়া হয়নি। বৃষ্টি আইনে ৮ রানের জয়ে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে আফগানিস্তান। 

বাংলাদেশের গেম প্ল্যান কী ছিল?

বিশ্বকাপের পয়েন্ট টেবিল কখনো কখনো রোমাঞ্চকর হয়ে উঠে। টুর্নামেন্টের সময় যত গড়ায়, ততই যেন জমতে থাকে লড়াই। এই পয়েন্ট টেবিলের সমীকরণের মারপ্যাঁচে কয়েক ঘণ্টার জন্য যেমন বাংলাদেশের সমর্থক বনে গিয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটে শক্তিধর অস্ট্রেলিয়া। আরও খোলাসা করে বললে, বাংলাদেশের হাতে নির্ভর করছিল অস্ট্রেলিয়ার ভাগ্য। 

প্রতিপক্ষের বোলিং ইউনিট কিংবা নিজেদের ব্যাটিং বা কন্ডিশন বিবেচনায় নিলে ১২.১ ওভারে ১১৬ রানের টার্গেট তাড়া করে জেতা সহজ ছিল না। কিন্তু আপনার সামনে যখন এমন সুযোগ আসবে, সেটা কেন হেলায় হারাতে চাইবেন? তার ওপর আপনার যেখানে কার্যত হারানোর কিছু নেই। সেমির সমীকরণ ছাড়া এই ম্যাচে জয়-পরাজয়টাও আদতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। তবুও নিজেদের কম্পোর্ট জোনে খেলতে গিয়ে বাংলাদেশ সুযোগটা নিতে পারেনি। পরে আমও গেছে, ছালাও গেছে। 

আসলে চলমান বিশ্বকাপের সুপার এইটের শেষ ম্যাচে এসে ঝুলেছিল তিন দলের (বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া) ভাগ্য। এমনকী আফগানিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচের প্রথম ইনিংস শেষেও তিন দলেরই সমান সুযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে আফগানিস্তান। বাংলাদেশ কেন পারেনি?

টাইগার ব্যাটারদের ব্যাটিং এপ্রোচ দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, তারা আসলে কোনো টার্গেট নিয়েই খেলেনি। অবশ্য ম্যাচশেষে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। তিনি বলছিলেন, ‘পরিকল্পনাটা এমন ছিল যে আমরা প্রথম ৬ ওভার চেষ্টা করব। পরিকল্পনা ছিল, যদি আমরা ভালো শুরু করি, দ্রুত উইকেট যদি না পড়ে, তাহলে আমরা সুযোগটা নেব। কিন্তু যখন আমাদের দ্রুত ৩ উইকেট পড়ে গেল, তখন আমাদের পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল—যেন আমরা ম্যাচটা জিততে পারি। তারপরও আমি বলব, মিডল অর্ডার ভালো সিদ্ধান্ত নেয়নি। যার কারণে ম্যাচটা আমরা হেরে গেছি।’

প্রতিপক্ষের বোলিং ইউনিট কিংবা কন্ডিশন বিবেচনায় নিলে ১২.১ ওভারে ১১৬ রানের টার্গেট তাড়া মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু আপনার সামনে যখন এমন সুযোগ আসবে, সেটা কেন হেলায় হারাতে চাইবেন? তারওপর আপনার যেখানে কার্যত হারানোর কিছু নেই। সেমির সমীকরণ ছাড়া এই ম্যাচে জয়-পরাজয়টাও আদতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। তবুও বাংলাদেশ সুযোগ নিতে পারেনি। পরে আমও গেছে, ছালাও গেছে। 

বাংলাদেশের এমন হাস্যকার গেমপ্ল্যানকে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক অধিনায়ক মাশরাফিও। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলছিলেন, এই ম্যাচ ১২.১ ওভারে জেতার জন্যই খেলা উচিত ছিল বাংলাদেশের। আর সেটি করতে গিয়ে যদি ৫০ রানেও অলআউট হতো দল দর্শকরা সেটিকে সহজভাবে নিতো। আর যদি এই ম্যাচ জিততাম, বিবেকের কাছে হেরে যেতাম। এই ম্যাচ আর দশটা ম্যাচের মতো ছিল না আমাদের কাছে। এটা ছিল ইতিহাস গড়ার সমান।

যদিও নিজেদের গেম প্ল্যানেও রক্ষা হয়নি। বরং বাংলাদেশ অলআউট হয়ে গেছে ১০৫ রানে। ৪৯ বলে ৫৪ রানে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন লিটন দাস। বাকি ব্যাটারদের কেউ তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি। এ নিয়ে মাশরাফি বলছিলেন, ‘লিটনের ইনটেন্ট আর নন স্ট্রাইকের নিরবতা দেখে বোঝা যায় ক্লিয়ার কোনো মেসেজ ব্যাটিং ইউনিটের কাছে ছিল না। আর যদি থেকেই থাকে তাহলে এক বলা দুই ওভার পরপর পরিবর্তন হয়েছে, যেটা শেষমেশ এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে স্রেফ ম্যাচটা জিতি।’ 

ক্রিকেটারদের দায়বদ্ধতা কতটা ছিল?

সেমিফাইনাল নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ের বিকল্প ছিল না আফগানিস্তানের। তাদের ব্যাটাররা বড় পুঁজি গড়তে না পারলেও বল হাতে বুক চিতিয়ে লড়েছেন নাভিন-ফারুকীরা। বাংলাদেশ নিজেদের সেমিফাইনাল স্পট খোয়ালেও একটা সময় মনে হচ্ছিল, শান্ত্বনার জয় পেতে যাচ্ছে হয়তো বাংলাদেশ। এমন সময়ও হার মানেনি আফগানরা। মাঠে তাদের ক্রিকেটার ও মাঠের বাইরে ডাগআউটে কোচ ও অন্যান্য স্টাফদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কতটা মরিয়া ছিল তারা। অথচ বিপরীত চিত্র ছিল বাংলাদেশ শিবিরে। 

বিশ্বমঞ্চে তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এমন টুর্নামেন্টে ফল পক্ষে আনার জন্য একান্ত চেষ্টা ও নিজেদের সামর্থ্যে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি। এই দুটির জোরেই হয়তো সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকে বার্তা দিতে পেরেছে ক্রিকেটে অখ্যাত যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই এ বিষয়টির ঘাটতি দেখছেন বাংলাদেশ দলে। আমাদের ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা দেখে যে কেউ বলবে, আমরা হারার আগেই হেরে বসে আছি।

এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছেন অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এখন পর্যন্ত হওয়া নয়টি বিশ্বকাপেই খেলেছেন সাকিব। অথচ নিজের নবম বিশ্বকাপে এসে একটি হাফ সেঞ্চুরি বাদে বলার মতো কিছুই করতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দৃষ্টিকটুভাবে আউট হয়ে বরং দলের বিপদ বাড়িয়েছেন। বল হাতেও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। 

বিশ্বকাপজুড়ে চরম ব্যর্থ হয়েছেন টাইগার ব্যাটাররা। ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম প্রতিটি ম্যাচে সুযোগ পেলেও তেমন কিছু করতে পারেননি। ৯ ম্যাচের মধ্যে রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে ফিরেছেন ৩ বার। অন্যদিকে, লিটন দাস ও শান্তরা ফর্মের ধারেকাছেও ছিলেন না। যদিও লিটন শেষ ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেছেন। তবে দলকে জেতাতে পারেননি। এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছেন অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এখন পর্যন্ত হওয়া নয়টি বিশ্বকাপেই খেলেছেন সাকিব। অথচ নিজের নবম বিশ্বকাপে এসে একটি হাফ সেঞ্চুরি বাদে বলার মতো কিছুই করতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দৃষ্টিকটুভাবে আউট হয়ে বরং দলের বিপদ বাড়িয়েছেন। বল হাতেও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। 

একাংশের সমর্থকদের যাকে নিয়ে দরদের সীমা নেই, সেই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও ছিলেন পুরোপুরি ফ্লপ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এক ম্যাচ বাদে বাকি কোনো ম্যাচেই প্রত্যাশার ছিঁটেফোটাও পূরণ করতে পারেননি। ব্যর্থতার বিশ্বকাপ শেষে সমর্থকদের কাঠগড়াতেও মোটাদাগে এই দুজন। ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাদের মতে, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহকে এখনই অবসরে যাওয়া উচিত। অবশ্য, অবসর নেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে সেভাবে গড়েই উঠেনি। অথচ বাংলাদেশের হারের পর নিজেদের বিদায় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই অবসর নিয়ে ফেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার তারকা ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার। 

বিশ্বকাপের পর এখন কী হবে?

২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। প্রথম দিকে বেশ আলোচনার জন্ম দিলেও পরে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এবারও কী তেমন কোনো নামকাওয়াস্তে কমিটি হবে? অবশ্য জয়-পরাজয়ের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে এবার বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তারা ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো’ করে বলতেই পারেন, খারাপ না, সফল অভিযানই ছিল। ২০০৭ উদ্বোধনী বিশ্বকাপের পর দ্বিতীয়বারের মতো সুপার এইট নিশ্চিতের পরই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন টাইগার হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। 

এই কোচ বলছিলেন,  ‘আমরা যখন এই টুর্নামেন্ট খেলতে আসি, আমাদের লক্ষ্য ছিল সুপার এইট। আমি মনে করি সেটি আমরা দারুণভাবে (করেছি), বোলাররা আমাদের খেলায় টিকিয়ে রেখেছে। কন্ডিশনের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছি এবং নিজেদের পক্ষে কন্ডিশন কাজে লাগাতে পেরেছি।’ আরও যোগ করেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য বিষয়টা হলো, আমরা এখানে আসতে পেরে খুশি। আর এখান থেকে যা কিছু পাব, তা–ই আমাদের জন্য বোনাস। সেজন্য আমরা এখন অনেক স্বাধীনতা নিয়ে খেলব এবং তিন দলের প্রতিটিকেই যতটা সম্ভব চ্যালেঞ্জ জানাব।’

যে দলের কোচের মানসিকতা এমন হবে, সেই দল আর যাই হোক কখনো বড় কিছুর স্বপ্ন দেখতে পারে না। টাইগার অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়ার আগে বেশি প্রত্যাশা না করতে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন। বিশ্বকাপ শেষে নিজের দায় সেরেছেন সমর্থকদের কাছে সৌজন্য ক্ষমা চেয়ে। এর চেয়ে আর যে কোনো জবাবদিহিতা নেই তাদের। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বকাপ আসবে যাবে, আমরা যেমন তেমনই থেকে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কী!

এফআই