অসুস্থ মাকে ঘরে রেখে আসা রহমানউল্লাহ গুরবাজ, শরণার্থী শিবির থেকে উঠে আসা গুলবাদিন নাইব, একটা দেশের ক্রিকেটকে একাকী নাবিকের মতো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোহাম্মদ নবী। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর বৈদেশিক সামরিক আগ্রাসন যাদের বিধ্বস্ত করে রেখেছিল দুই দশকের বেশি সময়, তারাই এখন বিশ্বক্রিকেটের মঞ্চে পতাকা উঁচিয়ে ধরেছে পরিপূর্ণ গৌরবে। 

দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে অস্ট্রিয়া কিংবা মঙ্গোলিয়ার মতো দেশের বিপক্ষেও ক্রিকেট খেলেছেন মোহাম্মদ নবী। দফায় দফায় অধিনায়ক হয়েছেন, সমসাময়িক সবাই ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নবী যেন এক প্রাচীন বটবৃক্ষ। নওরোজ মঙ্গল, দৌলত জাদরান কিংবা শাপুর জাদরানদের সঙ্গে ক্রিকেট শুরু করেছেন। এখন খেলছেন রশিদ খান, মুজিব উর রহমানদের সঙ্গে। 

মোহাম্মদ নবীর এই গল্পটা ক্রিকেট ছাড়া আর কে এত পূর্ণতা দিতে পারত? নিজেদের বাড়ি নেই, জীবন নেই, বাতাসে বুলেট আর বোমার তীব্র গন্ধ, সেই ধ্বংস্বস্তুপ থেকেই আফগান ক্রিকেটের পোস্টারবয় হয়ে ছুটেছেন সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলেছেন, আফগানিস্তান ক্রিকেটকে যেন নিজের কাঁধে নিয়ে ছুটেছেন সারাবিশ্বে। 

সেই ফলাফলটাই এবার পেলেন মোহাম্মদ নবী। বেলায় বেলায় অনেকটা সময় পার করেছেন। পারফরম্যান্সে ভাটা পড়েছে। তবু দলে আছেন। ভাগ্যিস ছিলেন! নয়ত বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল নামের এমন অনিন্দ্য সুন্দর এক উপাখ্যান কী দেখতে পেতেন? 

রহমানউল্লাহ গুরবাজের কথাই বলা যাক। এই ম্যাচেও আফগান ব্যাটিং লাইনআপকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ কদিন আগেই অসুস্থ মাকে দেখে এসেছেন হাসপাতালে। কিন্তু মা আর দেশ তো একইসূত্রে গাঁথা! গুরবাজ খেললেন দেশের জন্য। উগান্ডা ম্যাচে একবার আহত হয়েছিলেন। তবু খেলা ছাড়েননি। 

এবারের বিশ্বকাপে ইব্রাহিম জাদরানকে নিয়ে ৩ বার শতরানের পার্টনারশিপ গড়লেন। এক আসরে এতটা ধারাবাহিক ছিলেন না কোনো ওপেনারই। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচেও শেষ পর্যন্ত ছিলেন না তিনি। ইনজুরির কারণে উঠে গিয়েছিলেন মাঠ থেকে। কিন্তু ম্যাচ জয়ের পরেই তার কান্না বুঝিয়ে দিয়েছিল এমন এক জয়ের জন্য বহু রাতই নিজের জীবনকে শাসিয়েছিলেন এই ব্যাটার। 

গুলবাদিন নাইবের জীবনটা আরও বেশি রঙিন। আফগানিস্তানের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ শিকার তিনি। শরণার্থী শিবিরে ১১ বছর পার করার পর একসময় জানতেন না নিজের নামটাও। সেই ধ্বংসস্তুপের জীবনে ক্রিকেট এলো অক্সিজেন হয়ে। বাঁচার তাগিদে ব্যাট আর বলেই ভরসা রাখলেন পুরোদমে। 

তবে সেটাও তো খুব একটা সহজ ছিল না। বাধ্য হয়ে পারিবারিক ব্যবসায় পর্যন্ত নামতে চেয়েছিলেন। সেই মানুষটিই কদিন আগে অস্ট্রেলিয়াকে হারালেন, দলকে টেনে নিলেন বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত। 

বোমা আর বারুদের গন্ধ থেকে উঠে আসা আফগানিস্তানের ক্রিকেটের গল্পটা কোনো উপন্যাসের চেয়ে কম রোমাঞ্চের না। জীবনের গল্পটাই যেখানে জিতে যায় বারবার। ক্রিকেট নামের নিছক একটা খেলা যেখানে সামরিক অস্ত্রের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আফগানিস্তান সেই খেলাটাই খেলেছে জীবন দিয়ে। 

বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল সেই অসাধারণ জীবনের গল্পের একটা অধ্যায় মাত্র। এরচেয়ে বড় কিছুও হয়ত সামনে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। 

জেএ