বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তারকার নাম সাকিব আল হাসান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই বাংলাদেশ দলকে তিনি কাঁধে নিয়ে চলছেন, এমন সময় খুব কমই এসেছে যে সাকিবকে বোঝা হিসেবে বয়ে চলতে হয়েছে দলকে। তবে অফফর্ম যে আসেনি সেটাও বলা ভুল, যতবার ফর্ম নিয়ে সমালোচনা হয়েছে ঠিক ততবারই জবাব দিয়েছেন পারফর্ম করে। যার সবশেষ উদাহরণ গতকাল (বৃহস্পতিবার) নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অপরাজিত ৬৪ রানের ইনিংস। 

গত সপ্তাহের সবকটি দিনই সাকিব ছিলেন দারুণ সমালোচিত। কারণটাও অমূলক নয়, চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে পারফর্ম করতে ব্যর্থ ছিলেন টাইগার এই অলরাউন্ডার। শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করেন মোটে ১১ রান, পাননি কোনো উইকেটও। যে কারণে সমর্থক থেকে শুরু করে ক্রিকেট বিশ্লেষকদের অনেকেই সাকিবের শেষটাও দেখে ফেলেছিলেন। তবে কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা নিজেদের এপিটাফ যে এমন রঙহীনভাবে লিখতে চান না! ব্যতিক্রম নন সাকিবও। জানান দিলেন আমি তোমাদেরই আছি, যাইনি ফুরিয়ে।

নন্দিত সাকিব কখনও কখনও হয়ে যান নিন্দিত। অবশ্য মাঠের বাইরের বিষয়ই তাকে বেশিরভাগ সময় নিন্দিতদের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। পারফরম্যান্সের জন্য এই চিত্রটা তাকে দেখতে হয়েছে তুলনামূলক কম–ই। তবে সাকিবের তো জানা এসব বন্ধ করতে কোন প্রতিষেধক প্রয়োজন, সেটাই গতকাল করে দেখালেন। হয়তো কখনও প্রেমে পড়েছেন, আর প্রিয়তমাকে ভালোবেসেছেন পাহাড়সম আবেগ-অনুভূতি দিয়ে। সেই প্রিয়তমার মতো সাকিব আল হাসানও এমন প্রেম, যে ভালোবাসতে বাধ্য করেন বারবার। যে ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে বছরের পর বছর সমর্থকদের আনন্দাশ্রু উপহার দিয়েছেন তিনি। সবাই যেখানে শেষ দেখেন সাকিব সেখান থেকেই শুরু করেন, তার স্ত্রীর মতো করেই বলতে হয় বিশ্বাস (রাখতে হয়)!

ফিফটির পর একাধিক মাইলফলকও স্পর্শ করেছেন সাকিব

গতকাল দলের হয়ে চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে সাকিব খেলেছেন দুর্দান্ত এক ইনিংস। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৪৬ বলে ৬৪ রান খুব বেশি যে দুর্দান্ত সেটা বলা যায় না, তবে উইকেট কিংবা দলের পরিস্থিতি অনুযায়ী আসলেই সেটি প্রশংসা পাওয়ার মতোই। যা নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সবাই পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন এই অলরাউন্ডারের। পরবর্তীতে বল হাতে উইকেট না পেলেও, সাকিব প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের ঠিকই চেপে রেখেছিলেন। তিনি জানেন পারফরম্যান্সের মন্ত্রটা, যা করলে বন্ধ হবে সব আলোচনা। যারা আসলেই সাকিবের শেষটা দেখে ফেলেছিলেন, নিশ্চয়ই তারা এখন নতুন করে ভাবনায় পড়েছেন! 

এই প্রসঙ্গ যখন আসলো, তখন সাবেক ভারতীয় তারকা বীরেন্দর শেবাগের দুদিন আগে করা একটি মন্তব্যও সামনে চলে আসে। গত মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টাইগারদের হারের পর এক আলোচনায় তিনি সাকিবকে নিশানা বানিয়ে বলেন, ‘আপনি (সাকিব) এতই সিনিয়র খেলোয়াড়, অধিনায়ক ছিলেন দলের, এটা শেষ আসর। কিছু তো লজ্জা থাকা উচিৎ। বলা উচিৎ, আমি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিচ্ছি। আমার বোলিং ভালো হচ্ছে না, ব্যাটিং ভাল হচ্ছে না। দলের জন্য আমি কিছু করতেই পারছি না। তাহলে আমি খেলে কী করব?’ সাড়ে ১৩ হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে বসে সাকিবের গতকালকের ইনিংসটাও নিশ্চয়ই দেখেছেন শেবাগ!

একজন ক্রিকেটারের ২ থেকে ৫ ম্যাচ খারাপ যেতে পারে, সেটা স্বাভাবিকও। তবে তার জন্য ‘লজ্জা পেতে হবে’, শেবাগের এমন মন্তব্য কেবল আগুনে ঘি–ই ঢেলেছে! পারফর্ম করেই সাকিব জানিয়ে দিলেন তিনি ফুরিয়ে যাননি। অবশ্য ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে গতকাল সাকিবকে শেবাগের মন্তব্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সম্মানের সঙ্গেই জানালেন, তিনি কাউকে উত্তর দিতে ক্রিকেট খেলেন না। সেরার খেতাব পাওয়া ব্যক্তিরা বোধহয় এমনই হন, তারা মুখে না বললেও উত্তরের চপেটাঘাট দেন পারফর্ম করে। 

শেবাগের মন্তব্য নিয়ে সাকিব বলছিলেন, ‘একজন খেলোয়াড় কখনও কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে আসে না। খেলোয়াড়ের কাজ হচ্ছে সে যদি ব্যাটার হয় ব্যাটিং করা, দলের জন্য অবদান রাখা, সে যদি বোলার হয় তার কাজ হচ্ছে ভালো বোলিং করা, উইকেটটা ভাগ্যের ব্যাপার থাকে।’

একইসঙ্গে খারাপ পারফর্ম করলে সমালোচনা হবে বলেও অনায়াসে মেনে নিলেন সাকিব, ‘সে (কোনো ক্রিকেটার) যখন ফিল্ডিং করে, তখন তার কাজ হচ্ছে প্রতিটা রান বাঁচানো, যতগুলো ক্যাচ তার কাছে যায় ততগুলো ধরা। এখানে আসলে কাউকে উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। বর্তমান একজন খেলোয়াড় সে দলের হয়ে কতটা কৃতিত্ব রাখতে পারে... সেটা যখন রাখতে পারে না তখন স্বাভাবিকভাবেই কথা হবে এবং আমি মনে করি সেটা খুব খারাপ কিছুও না।’

ভক্ত-সমর্থকরা সাকিবের ওপর সেভাবে বিশ্বাস রাখতে না পারলেও তার বর্তমান কিংবা সাবেক সতীর্থরা ভরসা রেখেছিলেন শতভাগ। বিসিবিও জানে সাকিব নিজের দিনে কি করতে পারেন। ইমরুল কায়েস, তামিম ইকবাল থেকে শুরু করে মাশরাফি বিন মুর্তজা সবাই সাকিবের খারাপ সময়ে পাশে ছিলেন। ইমরুল তো নিজের ফেসবুকে ম্যাচ শেষ না হতেই লিখেন, সমালোচনা কিভাবে বন্ধ করতে হয় সাকিব সেটা জানে।

অপরদিকে, সাকিবকে টুপিখোলা স্যালুট দিয়ে নিজের ফেসবুকে মাশরাফি লেখেন, ‘এবার শুরু হবে আমাদের আসল বিশ্বকাপ। এই উইকেটে কেউ সেরা দল নয়, আমরা বিশ্বাস রাখতে পারলে দারুণ কিছু করা সম্ভব। সাকিবকে টুপি খোলা সালাম, সেই সাথে পুরো দলকে অভিনন্দন।’

শুরুতে বলা সেই কথা দিয়ে শেষ করা যাক, বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেকের প্রথম প্রেম সাকিব আল হাসানকে নিয়ে। যে প্রেম কখনও কাঁদায়, কখনওবা হাসায়। তবে নিজের পারফর্ম দিয়ে সাকিব ঠিকই ভালোবাসতে বাধ্য করেন। কথায় আছে না, আপনি যত যাই করুন না কেন দিনশেষে আপনাকে সাকিব বন্দনায় ফিরতে হবে! ক’জনই বা পারেন এমন ভালোবাসতে বাধ্য করতে, যারা পারেন তাদের মধ্যে একজন মাগুরার ফয়সাল থেকে বিশ্বের সাকিব আল হাসান।

এসএইচ/এএইচএস